বিক্রমপুর ও বিক্রমপুর দিবস
প্রকাশ : 2022-12-28 14:04:13১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন জনপদ বিক্রমপুর। যে সময় নবদ্বীপ, সোনারগাঁও, ঢাকা ও সপ্তগ্রামের মতো প্রসিদ্ধ জনপদের নাম বঙ্গের মানুষের কাছে ছিল অপরিচিত, তারও বহু আগে শিক্ষা-সভ্যতায় ও উন্নতিতে বিক্রমপুর ছিল একটি সর্বজন পরিচিত নাম। এমনকি মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানও খ্যাতি লাভ করেছে বিক্রমপুরের বহু পরে। প্রাচীন বিক্রমপুরে বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার বেশিরভাগ অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হলেও বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বিস্তৃত অংশসহ পদ্মাগর্ভে বিলীন অঞ্চল নিয়ে বিক্রমপুর বিস্তৃত ছিল। বৈদিক যুগ থেকে মুসলিম বিজয়ের আগ পর্যন্ত বিক্রমপুরসহ প্রাচীন গৌড়-বঙ্গ শাসন করেছিলেন চন্দ্র, বর্ম ও সেন রাজবংশ। বিশেষত ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিক্রমপুর ছিল প্রাচীন বঙ্গের রাজধানী। চন্দ্রবংশীয় রাজারা দশম হতে দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পযন্ত এই রাজধানী হতে বঙ্গ শাসন করতেন। বর্ম রাজারাও রাজধানী বিক্রমপুর থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। প্রাচীনযুগে বঙ্গ রাজত্বের শেষসময়ে বিক্রমপুর সেন রাজবংশের অধিকারভুক্ত হয়। বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন, বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষণ সেন, লক্ষণ সেনের পুত্র কেশব সেনের সময়েও বিক্রমপুরেই ছিল রাজধানী। অবশ্য সবগুলো রাজবংশের লেখমালায় বিক্রমপুরকে ‘জয়স্কন্ধাবার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে প্রতিটি রাজবংশ বিক্রমপুর অঞ্চলে তাদের জয়স্কন্ধাবার বা বিজয় ছাউনি স্থাপন করেছিল ।
দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলিজি'র গৌড়-বঙ্গ বিজয়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গে সূচিত হয় মুসলিম শাসন এবং সেইসাথে বঙ্গে প্রাচীনযুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। মধ্যযুগে অর্থাৎ সুলতান ও মোগল শাসনকালীন সময়ে বিক্রমপুর বঙ্গের রাজধানীর মর্যাদা হারালেও ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চল হিসেবে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আধুনিক অর্থাৎ ব্রিটিশ-পাকিস্তান সময়ে একটি বাণিজ্যিক ভূ-খ- হিসেবে এর খ্যাতি ছিল তুঙ্গে। এ ধারা আজও অব্যাহত ।
বিক্রমপুর নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকায় অবস্থিত । এর চারদিক জুড়েই প্রবহমান নদী। পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী ও ব্রহ্মপুত্রের মাঝে বিক্রমপুর একটি দ্বীপ। নদ-নদী বেষ্টিত দুর্গম ভূ-প্রকৃতির কারণেই ষষ্ঠ শতাব্দী থেকেই বিক্রমপুর ভূ-রাজনৈতিক এলাকা হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। প্রাচীনযুগে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিভিন্ন রাজবংশীয় রাজারা ধারাবাহিকভাবে বিক্রমপুরে স্থাপন করেছিলেন রাজধানী। মধ্যযুগে বিশেষত মোগল শাসনকালীন পর্বে বাংলার রাজধানী ঢাকাকে রক্ষার জন্য বিক্রমপুর ব্যবহৃত হয়েছিল 'ঢাল' হিসেবে। কেননা মূল দুর্গ লালবাগ কেল্লার অগ্রগামী প্রতিরক্ষা বুহ্য হিসেবে ধলেশ্বরী নদীর মোহনায় প্রাচীন ইদ্রাকপুর (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ সদর)-এ নির্মিত হয়েছিল ‘ইদ্রাকপুর কেল্লা’। অন্যদিকে ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে বিক্রমপুরে প্রবহমান এসব প্রধান প্রধান নদ-নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন বাণিজ্যবন্দর। পদ্মার তীরে ভাগ্যকুল, লৌহজং, দীঘিরপাড় ও বহর, ধলেশ্বরীর তীরে তালতলা, মিরকাদিম, ফিরিঙ্গিবাজার এবং পুরনো ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে মাকুহাটি বাণিজ্যবন্দর তার নিদর্শন বহন করছে। এমনকি অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থা সহজতর করাসহ বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সংযোগ সাধনের লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজন্য ও জমিদারবর্গ খনন করেছিলেন বড় বড় খাল। ঐতিহাসিক গৌরগঞ্জ-তালতলা খাল, লৌহজং-শ্রীনগর খাল ও মিরকাদিম খাল এর উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। গৌরগঞ্জ-তালতলা খাল যেমন পদ্মাকে সংযোগ করেছে ধলেশ্বরীর সাথে, তেমনি মিরকাদিম খাল ধলেশ্বরীকে সংযোগ করেছে মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে। আবার এই খালগুলোর তীরে গড়ে উঠেছে প্রসিদ্ধ হাট-বাজার।
অতীত থেকে বর্তমান অবধি বিক্রমপুরের নদী তীরবর্তী এসব বাণিজ্যবন্দরগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশেষত বর্তমান সময়ে দেশের মোট উৎপাদিত আলুর ৮০ ভাগই উৎপন্ন হয় বিক্রমপুরে। এই আলু চাষকে কেন্দ্র করেই বিক্রমপুরের নদী তীরবর্তী বাণিজ্যবন্দরগুলোতে স্থাপিত হয়েছে দেশের অধিকাংশ ক্লোডস্টোরেজ আর বিক্রমপুরের খাল তীরবর্তী হাট-বাজারগুলোর অধিকাংশই হচ্ছে গরু, নৌকা ও কাপড় বিক্রির বিশেষায়িত হাট-বাজার ।
নদী-খাল ছাড়াও বিক্রমপুরে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বিল-ঝিল। এসব বিল-ঝিলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ বিল হলো আরিয়ল বিল। এ বিলকে ছোটখাটো হ্রদ বলা যেতে পারে। এ বিলটির দৈর্ঘ্য পূর্ব-পশ্চিমে ১২ মাইল এবং দক্ষিণে প্রন্থ প্রায় ৭/৮ মাইল। ঢাকা জেলার বিলগুলোর মধ্যে আরিয়ল বিলই সর্ববৃহৎ। অতি প্রাচীনকালে বিক্রমপুরের অধিকাংশ ভূ-খ-ই আরিয়ল বিলের গর্ভে ছিল । ভূ-তাত্ত্বিকদের ধারণা সম্ভবত রাজশাহীর চলন বিল এবং বিক্রমপুরের আরিয়ল বিলেই অতি প্রাচীনযুগে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গম হয়েছিল। শুষ্ক মওসুমে এর অবশ্য বিপরীত রূপ। তখন নানাপ্রকার মাছ বিশেষত কৈ মাছ আর কৃষিজ পণ্য বিশেষত মিষ্টি কুমড়া, বাঙ্গি, তরমুজ ও নানাবিধ রবিশস্যে ভরপুর থাকে আরিয়ল বিল।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাচীনযুগে অর্থাৎ ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত বিক্রমপুর শাসন করেছিলেন চন্দ্র, বর্ম ও সেন বংশের রাজারা। চন্দ্র রাজবংশের বেশ কিছু তা¤্রশাসন ও প্রতিমালিপি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শ্রীচন্দ্রের রামপাল, কেদারপুর, ইদিলপুর, ধুল্লা, মদনপুর ও পশ্চিমভাগ লিপি উল্লেখযোগ্য। বর্ম রাজবংশের উল্লেখযোগ্য তাম্রলিপির মধ্যে রয়েছে হরিবর্মার সামন্তসার/বেজিনিসার তাম্রশাসন, সামলবর্মার বজ্রযোগিনী তাম্রশাসন, ভোজবর্মার বেলাব তাম্রশাসন প্রভৃতি । সেন রাজবংশের শিলালেখ-তাম্রশাসনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিজয় সেনের দেবপাড়া শিলালেখ, ব্যারাকপুর তাম্রশাসন, বল্লাল সেনের নব আবিষ্কৃত তাম্রশাসন, লক্ষণ সেনের তপনদীঘির তাম্রশাসন, জয়নগর তাম্রশাসন, আনুলিয়াার তাম্রশাসন, শক্তিপুর তাম্রশাসন, গোবিন্দপুর তাম্রশাসন এবং কেশব সেনের ইদিলপুর তাম্রশাসন। এসব শিলালেখ ও তাম্রশাসনে প্রতিভাসিত হয়েছিল বিভিন্ন রাজন্যবর্গের শাসিত রাজ্যের অবস্থান ও শাসনব্যবস্থা।
এসব রাজবংশের রাজাদের কারও কারও রাজত্বকালীন সময়ে বিক্রমপুরে শিল্পের ব্যাপক উৎকর্ষ ঘটে। বিক্রমপুর অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার বিভিন্ন ভাস্কর্যই তার দৃষ্টান্ত। উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ ধর্মীয় ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে রয়েছে বুদ্ধ, অবলোকিতেশ্বর, তারা, হেরুক, জম্বল, প্রজ্ঞাপারমিতা, পর্ণশরবী, মঞ্জুশ্রী। আর হিন্দু ধর্মীয় ভাস্কর্যগুলো হলো- বিষ্ণু, সূর্য, নটরাজ, সদাশিব, নরসিংহ মূর্তি বাসুদেব,বটুক ভৈরব, গণেশ, চামু-া, মনসা, অর্ধনারীশ্বর, অষ্টভূজা-মহিষমদিনী, মাহমায়া প্রভূতি। প্রস্তর ও ধাতু নির্মিত ভাস্কর্য ছাড়াও বিক্রমপুর থেকে পাওয়া গেছে দারুভাস্কর্য সুরসুন্দরী।
উল্লেখ্য, বিক্রমপুরে প্রাপ্ত এসব মূল্যবান প্রত্নসম্পদ দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বরেন্দ্র জাদুঘর এবং ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম অব কলকাতা।
একসময় জ্যোতিষ চর্চা এবং আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল বিক্রমপুর। এখানে ছিল যন্ত্রপাতিতে সুসজ্জিত একটি মানমন্দির। এই অঞ্চলে প্রথম পজ্ঞিকা বিক্রমপুরেই প্রথম প্রস্তুত হতো। উজ্জয়িনী ও নবদ্বীপে তৈরি পঞ্জিকা বিক্রমপুরের প-িতদের দ্বারা অনুমোদন করিয়ে নিতে হতো। এসব পঞ্জিকায় বিক্রমপুরের সময় ধরা হতো।
প্রাচীনযুগের স্থাপনাগুলোর মধ্যে বল্লাল বাড়ি, অগ্নিকু-ু, মিঠাপুকুর মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকলেও এখনও অবশেষ আছে বল্লাল সেন নির্মিত ইটের পুল, রায়পুরা শিবমন্দির, রামপাল দীঘি ও রাজা হরিশচন্দ্রের দীঘি। মধ্যযুগের স্থাপনাগুলোর মধ্যে টিকে আছে সুলতানি আমলের বাবা আদমের মসজিদ এবং মুঘল আমলের মীরকাদিম পুল ও ইদ্রাকপুর দুর্গ । এছাড়া টিকে আছে ঔপনিবেশিক সময়ের বেশকিছু স্থাপনা যেমন- সোনারং-এর জোড়া দেউল, রাধা-গোবিন্দ মন্দির, কালীর আটপাড়া মন্দির, চৌধুরীবাজার মঠ, আউটশাহী মঠ, টঙ্গীবাড়ী মঠ ও দেউল এবং শ্যামসিদ্ধির মঠ, হাসাড়ার আলমগাজীর দরগা ও দিঘী।
বিক্রমপুরকে আলোকিত করেছেন বিশ্বনন্দিত মহাপ-িত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, নালন্দা মহাবিহারের আচার্য শীলভদ্র, বিখ্যাত মুসলিম সাধক বাবা আদম, কবি-সাহিত্যিক ব্রাহ্মণসর্বস্বের রচয়িতা হলায়ূধ মিশ্র, শাস্ত্র আলোচক কমল সার্বভৌম, তারিণীচরণ ন্যায় বাচস্পতি, কালীনাথ তর্কভূষণ, স্মার্ত প-িত কালীকান্ত শিরোমণি, দীনবন্ধু ন্যায়পঞ্চানন, বৈয়াকরণ নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার, কৃষ্ণনদ সার্বভৌম, প-িত ত্রিলোচন তর্কালঙ্কার, প্রখ্যাত চিকিৎসক গুডিভ সূর্য কুমার চক্রবর্তী, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, সত্যেন সেন, কবি কায়কোবাদ, প্রফেসর অব ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বহুমাত্রিক লেখক অধ্যাপক হুমায়ন আজান, চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বার খান, ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস, মোশারফ হোসেনসহ আরও অনেক জ্ঞানী-গুণীজন। এঁদের কারও কারও বাস্তÍভিটা বিশেষত মহাপ-িত অতীশ দীপঙ্করের বাস্তÍভিটা, খ্যাতিমান বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বাড়ি অবশ্যই ইতিহাসের অমূল্য উপকরণ।
প্রাচীনকাল থেকেই বিক্রমপুর ছিল শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র। দেশ-বিদেশের সওদাগর ব্যবসায়ীরা জাহাজে ভরে বিভিন্ন দেশের পণ্য নিয়ে আসতেন এখানে আবার এখানকার পণ্য নিয়ে যেতেন বাইরে। হাতি-ঘোড়াসহ বিভিন্ন প্রাণী, মণিমাণিক্য, রত্ন-কাঞ্চন অলংকার, মর্মর পাথরে প্রস্তর মূর্তি, নীলবস্ত্র (মসলিন), চন্দন ও নানারকম সুগন্ধী বিদেশে যেত। কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুরে তৈরি হতো বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজ। এসব জাহাজ বিদেশে রফতানি হতো। এখানে তৈরি বুদ্ধদেবের প্রস্তরমূর্তি সংগ্রহ করতো বহু দেশ।
চারদিকে নদীবেষ্টিত বিক্রমপুরে প্রকৃতির উদার উর্বরতায় অতি প্রাচীনকাল থেকেই কৃষক ছাড়াও ভিন্ন মাত্রার পেশাজীবীদের উম্মেষ ঘটেছিল। বিশেষ করে পদ্মার অবারিত ইলিশ মাছসহ অন্যান্য মাছের বহরকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকাল থেকেই গড়ে উঠেছিল জেলে সম্প্রদায়। তাছাড়া মৃৎশিল্পীসহ উল্লেখযোগ্য পেশাজীবীদের মধ্যে আছে আরিয়ল গ্রামের কাগজি সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকারগণ । আরিয়ল গ্রামে একসময় বংশ পরম্পরায় এই সম্প্রদায়ের কারিগরদের হাতে তৈরি হতো কাগজ। সিরাজদিঘার ঘোষ সম্প্রদায়ের তৈরি খাঁটি দুধের 'পাতক্ষীর' এখনও সরবরাহ হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। আর বর্ষা মওসুমে বিয়ের বরযাত্রী বহনে কোলপাড়া গ্রামের 'পানসি নৌকা' আজও কিংবদন্তীর স্বাক্ষর বহন করছে।
নদ-নদী, অসংখ্য খাল-বিল আর বর্ষা-বসন্তের বিরল প্রকৃতিতে আচ্ছাদিত বিক্রমপুরে লোকসাহিত্য ও লোকসঙ্গীতের একটি নিজস্ব ধারার প্রচলন রয়েছে। বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকায় আজও সন্ধ্যার পর মারফতি-মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব ও লোকগীতির সাথে অনুরিত হয় ভজন ও কীর্তন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণ আর সামাজিক আচার- অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো স্থানে আজও বসে গ্রামীণ মেলা। অসাম্প্রদায়িক ভাবমানসের এরকম দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল।
সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিক্রমপুরকে পৃথক করেছে। এ কারণেই ১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধে তৎকালীন সরকার সেসময়ের মুন্সীগঞ্জ মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করে নাম দিয়েছিল ‘বিক্রমপুর জেলা’। ‘৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেটি আবার হয়ে যায় মুন্সীগঞ্জ মহকুমা। ‘৮০-র দশকে জিয়াউর রহমান নারায়ণগঞ্জ মহকুমাকে পৃথক জেলা ঘোষণা করলে ‘বিক্রমপুর জেলা’র দাবিতে ফেটে পড়ে বিক্রমপুরের মানুষ। আন্দোলন- সংগ্রামের চাপে নারায়ণগঞ্জ জেলার বাস্তবায়ন বাতিল হয়ে যায়। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসক এরশাদ মহকুমাগুলোকে জেলায় পরিণত করলে নবগঠিত মুন্সীগঞ্জ জেলার নাম ‘বিক্রমপুর জেলা’ করার দাবি ওঠে। ঐতিহাসিক এসব প্রেক্ষাপটে ‘বিক্রমপুর দিবস’ উদযাপন অত্যন্ত তাৎপর্যসময় এবং তা ‘বিক্রমপুর জেলা’ পুনঃদাবির ইঙ্গিতময় অর্থ বহন করে।