বর্ষার ভেজা পথে বাংলার কবিকূল
প্রকাশ : 2024-07-03 15:26:21১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
ঘন কালো বর্ষার মেঘ জল বৃষ্টির হৃদয়ছোঁয়া আহ্বান এড়িয়ে যেতে পারে এমন সাধ্য বাঙালির কারো নেই। হোকনা সে অরণ্য তীরবর্তী গেঁয়ো কুঠীরের অথবা ঝলমলে ঝাড়বাতির আলোকবর্তী কোন মানব। মায়া কাড়া বৃষ্টি ঝরানো মেঘ আর বৃষ্টি ভেজা সবুজ সম্ভার দেখে মুগ্ধ হবেন না এমন বাঙালি বুঝি নেই। এই অপরুপ বর্ষনের মাদকতা বাঙালি কবিকূলের চিরন্তন হৃদয় সম্ভার। তাইতো বুনো প্রকৃতির বর্ষাভেজা রুপ বন্দনায় গ্রামীন কবিতায় যখন ধ্বণিত হয় --" বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান"-- , তারই সুরে সুর মিলিয়ে নাগরিক কবিতায় নন্দিত সুরে বেজে ওঠে --
"যদি মন কাঁদে -
তুমি চলে এসো,
এক বরষায়"।
বর্ষা বিমুগ্ধ গভীরতায় রবীন্দ্রনাথ যখন গেয়ে উঠেন -" নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে,
তিল ঠাঁই আর নাহিরে ", , অন্যদিকে বিদ্রোহী খ্যাত নজরুলের গানে ও কবিতায় বেজে ওঠে মেঘ চুয়ানো বৃষ্টির রিমঝিম -
-" শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে,
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ধারা"
বাংলাদেশ ও বর্ষা একে অপরের অভিন্ন রুপকার। বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ মায়াময় ছায়াময় রুপে দেখতে পাওয়া যায় শুধুমাত্র বর্ষা ঋতু তেই আর বর্ষার এমন কল্যাণময়ী শ্যামল কোমল মুখচ্ছবি কেবল বাংলাদেশেই ফোটে। বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিক ধারাবাহিকতার সিংহভাগই রয়েছে বর্ষা ঋতুর দখলে।
মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় হতে শুরু করে অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সবার লেখনিতেই ছিল অন্জলী ভরা অথৈ বর্ষার জল। কাব্য আর মেঘের ঘনঘটা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে তাদের বিন্যাসী বাক্য বুননে। তাজা রোমান্সের মেঘময় গন্ধ ভেসে আসে মঙ্গলাচরণের কবিতা হতে-:-
"কালো মেঘে বাষ্পের খেলাতে
বৃষ্টির কি নরম গন্ধ---"
অথবা
"কতদূরে নিয়ে যাবে বৃষ্টির ঝমঝম
বৃষ্টি টাপুরটুপুর -"
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বৃষ্টিবন্দনা লেখনিতে আমরা পাই:-
"বৃষ্টির স্রোত
করে বিশ্বলোপ।"
দেশপ্রেম আর বর্ষাপ্রেম মিলেমিশে একাকার হয়েছে কবি আলী আহসানের কবিতায়-
"আমার পূর্ব বাংলা
অনেক রাতে গাছের পাতায়
বৃষ্টির শব্দের মত।"
আর নজরুলের সে গানে ঘোর বর্ষার মেঘময় গাম্ভীর্যের মত ধ্যানমগ্নতা এনে দেবে যে কোন মনে:--
"এমনই বরষা ছিল সেদিন
শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন
তব হাতে ছিল অলস বীন
মনে কি পড়ে প্রিয়।"
শুধু কবিতা নয় গল্প,কবিতা,উপন্যাসেও বর্ষার সরব উপস্হিতি যে কোন মৌসুমেই আমাদের মনকে বৃষ্টিভেজা করে। শুরু হতেই কাব্যপ্রেমী বাংলা কথাশিল্পীরা তাদের কাব্য প্রহরের জন্য যেন সারাটা বছর ধরে বর্ষাকালের অপেক্ষায় অধীর থাকে। রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ কি সাবলিল ভাবে বর্ষাকে ধরে রেখেছেন তার কবিতায়:--
"তোমার চুলে যে রোদ-- মেঘের মতন চুলে
তোমার চোখে যে রোদ-
সেও যে যে মেঘের মত চোখ"
কেমন বৃষ্টি ঝরে
মধুর বৃষ্টি ঝরে--"
মাইকেল মধুসূদনও তার কবিতায় খুঁজে পেয়েছিলেন নান্দনিক বর্ষার স্বরুপ:--
"গভীর গর্জন সদা করে জলধর,উথলিল নদ নদী
ধরনী উপর, রমনী রমন লয়ে
সুখে কেলি করে,দানবাদি দেব"
কাজী নজরুল ইসলামের বৃষ্টি বিধুর কবিতায় বর্ষার আরেক বিরহ কাতর রুপ:--
"ওগো বাদলের পরী,
যাবে কোন দূরে
ঘাটে বাধা তব কেতকী পাতার তরী
ওগো ও ক্ষণিকা--"
কখনো বহু প্রতিক্ষীত ভালবাসার কথা বলে বর্ষার কবিতা:--
"এই শহরে প্রতি বরষায়
আমি প্রেমে পরি
প্রেমে পরি
এক জোড়া কাজল চোখের"।
কবিতার এলো মেলো পায়ে হাটা পথ বর্ষা ঋতু।
কবিগুরু নিরন্তর অক্লান্ত হেঁটেছেন কবিতার কারুকাজ আঁকা এই বর্ষাভেজা পথে-
" আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,
আসে বৃষ্টির সুবাস
বাতাস বেয়ে"।
আবেগ বিহ্বল অনুভবে শামসুর রাহমানও গেয়ে ওঠেন-
" আকাশে চঞ্চল
মেঘের কারুকাজ"।
কখনো পুলকিত উচ্চারণে বর্ষার নবধারাকে আহ্বান করেছেন রবীন্দ্রনাথ :-
"এসো নীপ বনে
ছায়াবীথি তলে
এসো কর স্নান নবধারা জলে।"
কবি মাসুদ খান তার কবিতায় বর্ষাকে অন্য আঙ্গিকে আবিষ্কার করেছেন:--
'আমি যে কেবল তোমার দিকেই যাই
বাতাস আমাকে নেয় না অন্যদিকে
এরই মাঝে চলে আষাঢ়ের কারসাজি
হয়ে যাও তুমি ক্রমেই ঝাপসা,ফিকে।'
শ্রাবণ রাতের বিরামহীন বৃষ্টিধারায় ভাবনার গভীরতায় অনুভূতির ঘনত্ব বাড়ায়, ভাব গম্ভীর চৈতন্যে আনে কাব্যের ঘনঘটা। কাব্যপিয়াসী বাঙালি কবিকূল মোহিত না হয়ে পারেন না।সৃষ্টি সুখের উল্লাসে নতজানু হয়ে শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন তারা। কাব্য মহাকাব্যের জোয়ারে চিরস্নাত বর্ষা ঋতু বারবার হৃদয় গহীনের শৈল্পিক সৃষ্টিশীল শব্দমালা হয়ে মানুষের দোরগোড়ায় আসে।
পৃথিবীর শেষ ফুলটি ফুটে ওঠা পর্যম্ত, শেষ সূর্য ওঠা পর্যন্ত এভাবেই বর্ষা আসুক কাব্যপ্রেমী বাঙালি কবিকূলের হৃদয় নীড়ে।কাব্যের জোয়ারে ভাসুক সব হৃদয়ের বৃষ্টিস্নাত প্রাঙ্গন।
ডাঃ প্রফেসর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব)নাজমা বেগম নাজু
সান