বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে
প্রকাশ : 2022-08-20 14:14:09১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গোটা জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে এ দিনটি পালন করে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শাহাদাতবরণ করেন মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শহীদ শেখ কামাল, শহীদ শেখ জামাল, বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শহীদ শেখ রাসেল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শহীদ শেখ নাসেরসহ পরিবারের প্রায় সবাই।
আল্লাহর অশেষ রহমতে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যান। এটি বাঙালি জাতির সৌভাগ্যও। আজ বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার বড় কন্যা শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছেন। তাদের ছোট কন্যা শেখ রেহানা প্রধানমন্ত্রীকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে সার্বক্ষণিকভাবে ছায়ার মতো পাশে আছেন। এটি আমার ব্যক্তিগত ধারণার কথা বলছি।
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুব সকালে পাশের বাসার একজন এসে আমার স্ত্রীকে ডেকে বলেন, ‘ভাবি মুজিববাদীকে ডাকেন তার নেতারে মেরে ফেলেছে।’ আমি পত্রিকা অফিসে যোগ দিই ১৯৭৩ সালে। অনেক রাতে বাসায় ফিরেছি। ঘুমে ছিলাম। আমাকে জাগিয়ে তোলার পর ওই লোকটি আমার সামনেই বলেন আপনার নেতা নেই। রেডিও খোলেন। রেডিও খোলার পর ঘটনা জানতে পারি। আমি তখন কাঁঠালবাগানের একটি ভাড়া বাসায় থাকি। আমার বাসা থেকে কয়েকটি বাসা পরই এডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান থাকতেন। তিনি ছাত্রজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের নেতা ছিলেন। আমি প্রথমেই তার বাসায় যাই। গিয়ে দেখি তিনিও হতভম্ব। তিনি তখন ওকালতি করেন। বললেন, একটু অপেক্ষা কর। দেখ কী হয়। আমি চলে এলাম। এর কিছুদিন পর রেজা ভাই রিকশায় যাচ্ছিলেন। আদালতে যাবেন। আমি হেঁটে সায়েন্স ল্যাবরেটরি যাচ্ছি। বাসে অফিসে যাব। আমাকে রিকশায় তুলে বললেন, কোথায় যাবে। বললাম অফিসে। আমাকে অফিসে নামিয়ে তিনি কোর্টে গেলেন। আমার এখনো মনে আছে রেজা ভাই বলেছিলেন, জাতি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একদিন প্রতিবাদ হবে। বিচার হবে। ভয় পেয়ো না। রেজা ভাইয়ের কথাই ঠিক।
তিনি বর্তমানে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান। এ প্রসঙ্গেই বলছি, খুনিদের কয়েক জনের বিচার হয়েছে। শাস্তিও হয়েছে। কিন্তু মূল পরিকল্পনাকারী এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার এখনো হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দাবি করে আসছেন একটি কমিশন গঠন করে ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হোক। দিন যত যাবে তত কঠিন হবে ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করা।
অনেকে বলেন, কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। আমার ধারণা, এ কথা বললে ষড়যন্ত্রকারীদের আড়াল করা হয়। দীর্ঘদিনের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ফলেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, খুনিদের বিচার করায় কলঙ্ক মোচন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কলঙ্ক কোনোদিনই মোচন হওয়ার নয়। বিচার হয়েছে। কিছুটা স্বস্তি পেতে পারি। এখানেই থেমে থাকলে চলবে না, এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী এবং ষড়যন্ত্রকারীদের অবশ্যই চিহ্নিত করে তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ওইদিন ঢাকা শহরে কিছু ট্যাঙ্ক ছিল। সেনা সদস্যরা টহল দিয়েছে। লোকজন ছিল না বললেই চলে। রাত থেকে কারফিউ শুরু হয়। বহু বছর সেই কারফিউ বলবত ছিল।
আমার সৌভাগ্য, বয়সের কারণে বঙ্গবন্ধু আমাকে চিনতেন। মওলানা বলে ডাকতেন। ১৯৭০ সালে উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাসে বহু লোক নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। আওয়ামী লীগের ত্রাণ তহবিল গঠন করেন। নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম শামসুজ্জোহা ত্রাণ তহবিলে অর্থ দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরে আসেন। আমাকেও নিয়ে এসেছিলেন। জোহা ভাই আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। জোহা ভাই আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। জেল খেটেছেন স্কুল জীবনেই। ওইদিন আমাকে জোহা ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। বঙ্গবন্ধু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
এরপর আরো অনেকবার দেখা হয়েছে। বাকশালে যোগদানের সময় গণভবনে তালিকা ধরে নাম পড়ার সময় দাদাভাইয়ের (রোকনুজ্জামান খান) নাম বলার পরই বঙ্গবন্ধু বললেন, তোদের দাদাভাই কি? আমারও দাদাভাই। বললেন, দাদাভাই ওখানে কেন? পরে দাদাভাইকে মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। আমার নাম পড়ার সময় বললেন, মওলানারে চিনি।
ইদানীং কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছে প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে খুনি মোশতাকের প্রেতাত্মারা আছেন। বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের একটি অংশ হচ্ছে এ ধরনের প্রচারণা। এটিও আমার ব্যক্তিগত ধারণা ও বিশ্বাসের কথাই বলছি। ভুলও হতে পারে। কারণ এদেশের সবচাইতে প্রাচীন ও সুসংগঠিত সফল রাজনৈতিক দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস ও কোন্দলের বাতাস ছড়াতে পারলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী গোষ্ঠীরই লাভ। এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ এবং কোনো কোনো গণমাধ্যম বিশ্ব পরিস্থিতি জেনেও সুকৌশলে না জানার ভান করে শুধু দেশের অবস্থা তুলে ধরছেন। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এটা করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সাউথ এশিয়া সেন্টার যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহযোগিতায় ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি ‘বঙ্গবন্ধু এন্ড ভিশনস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনায় নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষণের অংশ তুলে ধরছি। তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর স্বচ্ছ দূরদর্শিতা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমাদের জীবনকে পরিচালিত করার পথে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারে এই দূরদর্শিতা। আদর্শগত বিভ্রান্তির শিকার হয়ে ভারতসহ উপমহাদেশ এখন এক কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দিশা এবং প্রেরণার জন্য বঙ্গবন্ধুর সাহায্যপ্রার্থী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আমাদের আছে। সুনির্দিষ্ট অনেক দিক থেকেই শেখ মুজিবের চিন্তা এবং বিচার বিশ্লেষণ আজ খুবই প্রাসঙ্গিক।’
অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করার এই শক্তিশালী মানদণ্ড আজকের দিনেও খুব প্রাসঙ্গিক। আর শুধু বাংলা নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই যেহেতু এটা গুরুত্বপূর্ণ, বঙ্গবন্ধুকে তাই বিশ্ববন্ধু হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। কেননা, তঁঁঁাঁর ধারণা অনুসরণ করে এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধু বাংলা নয়। সারা বিশ্বের মানুষেরই অনেক কিছু অর্জন করার আছে।’ তিনি বলেছেন, ‘ঘটনাচক্রে ঢাকা-ফরিদপুর অঞ্চলের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্ম। আর আমিও যেহেতু ঢাকা থেকে এসেছি। মানিকগঞ্জ আর ঢাকা নগর- আমিও তাই উল্লাস করতে পারি।’ তিনি বলেছেন, ‘আমি সাহস করে বলি, আমি ভাগ্যবান যে, এমন একজন ব্যতিক্রমী প্রতিবেশী আমি পেয়েছি। যাঁর মহান ধারণা ও নেতৃত্ব বিশ্বকে বদলে দিয়েছে।’
আবুল কালাম আজাদ : বিএফইউজের সাবেক সভাপতি।