বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ মানুষের মধ্যে চেতনা ফিরিয়ে আনে
প্রকাশ : 2022-04-15 13:54:50১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
শুধু বাংলাদেশ নয় এখন বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক ভাষণ যা স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ হিসাবে পরিচিত । যে ভাষণ শুনলে বাংলাদেশ সহ সারাবিশ্বের মানুষের মধ্যে চেতনা ফিরে আসে। ৭ই মার্চের একটি মাত্র ভাষণের মধ্যে রয়েছে একটি জাতির, একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সকল মূলমন্ত্র ও দিক নির্দেশনা। এই ভাষণের মধ্যে বাঙালি জাতি খুঁজে পেয়েছিল তাদের জীবন বদলানোর ইতিহাস। ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু একটি বক্তব্য নয়। এটি হলো একটি ঘুমন্ত জাতিকে উজ্জীবিত করে তোলার ভাষণ। এই ৭ই মার্চের ভাষন একটি ইতিহাস। ইতিহাস যেমন বহন করে ব্যক্তি, জাতি ও রাষ্ট্রের অতীতের সকল কার্যাবলী ৭ই মার্চের ভাষণ ও তদ্রূপ একটি ইতিহাস। ৭ই মার্চের ভাষণটি একটি জাতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির একক ভাষণ হলেও আজ তা স্থান করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। যে ভাষণ শুনলে পরে কোন মানুষ স্থির থাকতে পারে না। আমাদের দেশের বিশেষ বিশেষ জাতীয় দিবসগুলোতে যখন এ ভাষণ মাইকে বাজানো হয় তখন সকল শ্রেনীপেশার মানুষের মধ্যে চলে আসে চেতনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে লাফিয়ে জেগে উঠে ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে। এটি একটি সাধারণ ভাষণ নয়। এ ভাষণ যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার এক মনমাতানো সূর। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সূর শুনে যেমন হাজার হাজার ছাত্র/ছাত্রী স্থির থাকতে পারেনি ৭ই মার্চের ভাষণ তার চেয়ে কোন অংশে ই কম নয়। বিশেষ দিবসগুলোতে যখন এ ভাষণ বাজানো হয় তখন সকল শ্রেনীপেশার মানুষের মনে একটা আবেগ সৃষ্টি হয়। মানুষ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনে এ ভাষণ। এ ভাষণ শুনে আবেগের কারনে অনেক মানুষের চোখে পানি চলে আসে। আর তারা বলে আমরা সারাবিশ্বের মধ্যে কেমন এক বর্বর জাতি হলাম। যে লোকের ভাষণের কারনে তৎসময়ের সারে সাতকোটি বাঙালি তাদের বুকে বপন করেছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। হায়রে অভাগা জাতি কি হবে আমাদের শেষ পরিণতি। যার ভাষণের জন্য সারাবিশ্ব পাগল আর আমরা হারালাম আমাদের সেই ভাষণের মূলকারিগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে। সাধারণ ও বর্তমান নতুন প্রজন্মের মানুষের মনে একটাই ধ্যান ধারনা ছিল বা আছে তাহলো, যে লোকটি একটি ভাষণের মাধ্যমে সারে সাতকোটি মানুষের হৃদয়ে স্বাধীনতার বীজ বুনে ছিলেন হয়তো তিনি বেচে থাকলে এই বাঙালি জাতি সারাবিশ্বের মধ্যে এক নাম্বারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু তা আমাদের কতিপয় সরকারী আমলার হীন লোভ লালসার কারনে তাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। হে বঙ্গবন্ধু তুমি আমাদের কে ক্ষমা কর। আমরা জাতি হিসাবে তোমাকে সেই পরিমান সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারিনি। তবুও আমরা বাঙালি জাতি হিসাবে তোমার নিকট চিরকৃতজ্ঞ। তুমি ওপারে থাক শান্তির পরশে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ লাখেরও বেশী জনসমুদ্রে পাকিস্তানি শাসকের হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে রেসকোর্স ময়দানে ২৩ বছরের বঞ্চিত, অবহেলিত ও শোষিত বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে ভাষণ শুরু করেন। শেষ করেন ৩টা ৩ মিনিটে। রাজনীতির কবি এর মধ্যেই লাখো বাঙালিকে শাণিত করে তোলেন। তাঁর মাত্র ১৮ মিনিটের অনলবর্ষী ভাষণে ১১০৫টি শব্দের সমন্বয়ে এই মহাকাব্য রচনা করেছিলেন তিনি। যে মহাকাব্যের মধ্যে নিহিত হয়েছে বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ভাষণের শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাসে তা হয়ে ওঠে গীতিময় ও শ্রবণের চতুর্দিকে অনুরণিত।
বাঙালির মুক্তির সোপানে আগুন ঝরা মাস মার্চ প্রতিবারই ঘুরেফিরে আমাদের নিকট আসে। আন্দোলিত করে, স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় চেতনার ঘরে। মার্চ আসে নানা মাত্রা নিয়ে। এর মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ।
৭ই মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর অমর রচনা, বাঙালি জাতির জন্য এক মহাকাব্য ও দিকনির্দেশনা। যে মহাকাব্যের রচয়িতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ মহাকাব্য বাঙালি জাতির হাজার বছরের সংগ্রামের ধারা ও স্বাধীনতার স্বপ্ন রয়েছে।
বিশ্ব মানচিত্রে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ভাষাভিত্তিক একমাত্র জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। হাজার বছরের সংগ্রাম শেষে যে রাষ্ট্রের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে।
১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি বিত্ত-বৈভবের বিভাজন নির্বিশেষে এক মহাঐক্যে জাগ্রত করেছিলেন মহাভাষণের মাধ্যমে।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা কমিটি দুই বছর ধরে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করার পর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার-২০১৭’-এ অন্তর্ভুক্ত করে। দেরিতে হলেও ইউনেস্কোর এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এখন আর শুধু বাঙালির কাছে নয়। এই ভাষণ পুরো পৃথিবীর কাছেই একটি মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এখন থেকে তাদের ডিজিটাল তথ্য ভাণ্ডারে অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত থাকবে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৬৮ দীর্ঘ দুই দশকে তিনি যে অসংখ্যবার বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য জেলে গিয়েছেন, তা বাঙালি-মননে অগ্নিশিখার মতো কাজ করেছিল। ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল তার দীর্ঘ সংগ্রামের একটি পরিণত ফুল ও ফল। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্রের প্রত্যাশা ছিল, সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন বঙ্গবন্ধু। জনসভায় রওনা দেবার আগে ছাত্রলীগের একাংশের নেতাকর্মীরা দীর্ঘক্ষণ তার পথ আগলে রেখে তাকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার জন্য কাকুতি-মিনতি জানিয়েছিল। কিন্তু তিনিতো জাতির পিতা, স্বাধীনতার মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি ভালো করেই জানতেন কসাই ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খান ওঁত পেতে ছিল ওই একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপের জন্য। বঙ্গবন্ধু তাদেরকে সে সুযোগ দেননি। উলটো ২৫ মার্চ অ্যাসেম্বলিতে যোগ দেয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে চারটি দাবি উত্থাপন করলেন- (১) সামরিক আইন প্রত্যাহার (২) সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া (৩) সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং (৪) জনপ্রতিনিধিদের কাছে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর। যে দাবিগুলো মানার সাধ্য ছিল না পাক সামরিক জান্তার।
বর্তমান যুগের ইতিহাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক জন্ম একটি বিরাট ঘটনা। সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব, শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রমাণ সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি জাতি গোষ্ঠীর পথপ্রদর্শক ও নেতা। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সভ্যতা, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি। তার সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে, এ আশা আমাদের আছে ও থাকবে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে শেখ মুজিবের বিশাল মহিমার একটি প্রকাশ যেমন আমরা দেখতে পাই, তাঁর মহামানবতার আর একটা পরিচয় আমরা পাই তার চিন্তাধারার অসাধারণতায়। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন লিখেছেন- ৭ মার্চ অপরাহ্ণে তিনি যখন জনসভার মঞ্চে উঠেছেন তখন তো জনসমুদ্র প্রবঞ্চক পাকিস্তানিদের প্রত্যাখ্যান করে নায়কের নির্দেশের অপেক্ষায় মাত্র- তারা তো জানে যুদ্ধ অনিবার্য, আসন্ন। নেতা লড়াইয়ের অগ্নিমন্ত্রে শ্মাণীয়ে দিলেন জনতার অন্তর। যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পথে এভাবেই রওয়ানা করিয়ে দিলেন জাতিকে ৭ মার্চ অপরাহ্ণে।” তিনি আরও লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর বাগ্মিতার জাদুতে- বক্তব্যে সমালোচনা, অভিযোগ, ক্ষোভের প্রকাশ তো ছিলই, কিন্তু তাতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও চূড়ান্ত ঘোষণার গুরুত্ব চাপা পড়েনি, মূল অভীষ্ট সাধনে ভুল হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে এ ভাষণটি দিলেও শব্দ হাতড়ানো, লাগসই শব্দের অভাবে যতি কিংবা যথার্থ বয়ানের ব্যর্থতায় বক্তব্য অস্পষ্ট বা জটিল হওয়ার মতো কোনো অঘটন ছাড়াই টানা বলে গেছেন তিনি। ঠিক যেন চয়িত শব্দফুলের মালা গাঁথলেন এক মহাকবি। মাঝে মাঝে বাঙাল শব্দের ব্যবহার- যেমন দাবায়ে রাখতে পারবা না- বক্তৃতাটিকে দিয়েছে দেশজ সৌরভ এবং মুজিব ব্যক্তিত্বের সপ্রাণ ওজস্বিতা। ভাষণটি কেবল বুদ্ধির নির্মাণ নয়, ভালোবাসার আবেগ জীবন্ত। এটির আবেদন যুগপৎ বৃদ্ধি ও হৃদয়বৃত্তির কাছে।
তাই অনুপ্রাণিত এক বক্তা সেদিন তার মুখাপেক্ষী জনতাকেই সবচেয়ে বড় ব্রত সাধনের আবাহন করেছিলেন। তার ডাক মানুষের অন্তরে পৌঁছেছিল। এমন মর্মভেদী, অন্তরস্পর্শী, দূরদর্শী বক্তৃতার দৃষ্টান্ত মেলে না ইতিহাসে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা। যে ঘোষণার সূত্র ধরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে নিজস্ব অবস্থানের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পায় ‘বাংলাদেশ’ নামে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র। যা আজ সারাবিশ্বে মাথা উঁচু দাঁড়ানো একটি উন্নয়নশীল দেশ।
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট
email - ganipress@yahoo.com