প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি তবু আলো দেখেনি পদোন্নতি!! ক্ষোভ বাড়ছে   

প্রকাশ : 2022-03-01 13:56:32১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি তবু আলো দেখেনি পদোন্নতি!! ক্ষোভ বাড়ছে   

পদবি বদল ও বেতন গ্রেড উন্নীতকরণের দাবিতে দুই যুগ ধরে চলছে মাঠ প্রশাসন কর্মচারীদের আন্দোলন। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গত বছরের ২৪ জানুয়ারি পদোন্নতি দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর এক বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে সেই পদোন্নতি প্রক্রিয়া। অর্থ মন্ত্রণালয়ে আটকে যায় মাঠ প্রশাসনের সংস্কার। পুরোনো আমলের পদবি আর নিম্ন গ্রেডের বেতনে কাজ করছেন বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের কর্মচারীরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজ মঙ্গলবার থেকে টানা কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন তারা।

সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া আগামী ২৪ মার্চ পর্যন্ত তারা আন্দোলনে থাকবেন। কর্মচারীরা সকাল ৯টায় হাজিরা খাতায় সই করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ না করে অফিস চত্বরে অবস্থান করবেন।

দেশজুড়ে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, ইউএনও এবং এসিল্যান্ড কার্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির (১৩-১৬ গ্রেড) কর্মচারী রয়েছেন প্রায় ১৩ হাজার। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আছেন প্রায় ১০ হাজার। বাংলাদেশ কালেক্টরেট চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সমিতিও আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছে। ফলে মাঠ প্রশাসনে অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন সংশ্নিষ্টরা। জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) বিষয়টি লিখিতভাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।

২০১৩ সালের ৩০ মে তহশিলদার (বর্তমান ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা) এবং সহকারী তহশিলদারদের (বর্তমান ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা) পদ বদল করে বেতন গ্রেড পাঁচ ধাপ ওপরে তোলা হয়। তাদের বেতন গ্রেড ১৬ ও ১৭তম থেকে ১১ ও ১২তম গ্রেড করে আদেশ জারি করে ভূমি মন্ত্রণালয়। ভূমি অফিসের কর্মচারীদের এভাবে পদোন্নতি দেওয়ায় কালেক্টরেট অফিসগুলোতে দেখা দিয়েছিল ক্ষোভ। এ জটিলতা নিরসনে সে সময় চার সচিবের সমন্বয়ে কমিটি করে সেই আদেশ বাতিল করা হয়। এরপর প্রায় ৯ বছর সমস্যা জিইয়ে রেখে ২০১৩ সালের সেই বাতিল আদেশ ফের বহাল করা হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি ভূমি অফিসের কর্মচারীদের পদোন্নতিবিষয়ক প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বেতন গ্রেড ২০১৩ সালের আদেশের দিন থেকে কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়। ফলে বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, ইউএনও ও এসিল্যান্ড কার্যালয়ে কর্মরত তৃতীয় শ্রেণির হাজার হাজার কর্মচারী ক্ষুব্ধ হয়। শুধু ভূমি অফিসে পদোন্নতি দেওয়ায় হতাশা তারা।

বাংলাদেশ কালেক্টরেট সহকারী সমিতির (বাকাসস) সভাপতি মো. আকবর আলী বলেন, 'আন্দোলন ঘোষণা করলেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ডেকে আশ্বাস দেন। তবে কোনো কাজ করেন না। এবার কঠোর পথে যেতেই হলো।' তিনি বলেন, 'ডিসি অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে এমন বিরূপ আচরণ করা সরকারের জন্যই কঠিন হবে। কারণ, এরাই রাত ১০টা পর্যন্ত অফিসে থেকে সরকারের সব ধরনের কাজে সহায়তা করে। এর পরও অন্য দপ্তরে সমান পদের প্রায় ৩০ ধরনের কর্মচারীর পদবি ও গ্রেডে উন্নীত হলেও মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্মচারীদের পদোন্নতি হয়নি। অর্থ সচিরের সঙ্গে একাধিকবার দেখা করার চেষ্টা করেও তার নাগাল পাইনি।'

ভূমি অফিসের কর্মচারীদের পদোন্নতির পর বাকাসাসের নেতারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম ও ভূমি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় জনপ্রশাসন সচিব ফের আশ্বাস দেন। ভূমি সচিব জানান, তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে ভূমি অফিসের কর্মচারীদের পদোন্নতি দিয়েছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, 'মাঠ প্রশাসনের কর্মচারীদের দাবি যৌক্তিক। কারণ সময়ের ব্যবধানে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। তাদের বিষয়টিও ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাদের পদোন্নতির সারসংক্ষেপ অনুমোদন করেছেন।' প্রতিমন্ত্রী এক বছর আগেও একই ধরনের আশ্বাস দিয়েছিলেন।

জানা যায়, চাকরিজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই পদে কাজ করছেন মাঠ প্রশাসনের এসব কর্মচারী। পদোন্নতি বঞ্চনার কষ্ট নিয়েই তাদের যেতে হচ্ছে অবসরে। গত বছরের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী তাদের পদোন্নতির অনুমোদন দেন। ২০১৮ সালে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি ও ডিসি সম্মেলনেও পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ২০২১ সালের শুরুতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ মাঠ প্রশাসনের ১১-১৬ গ্রেডভুক্ত কর্মীদের পদোন্নতির জন্য এক চিঠিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায়। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্মচারীদের পদবি ও বেতন গ্রেডে উন্নতির জন্য অর্থ বিভাগে প্রস্তাব পাঠায়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের উপস্থিতিতে পদবি বদল ও বেতন গ্রেড উন্নতির প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এরপর এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে মাঠ পর্যায়ে অন্য কার্যালয় ও সচিবালয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য ও ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করে তাতে অসম্মতি জানিয়ে জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দেয় অর্থ বিভাগ।

অসম্মতির চিঠির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে এবং ফের পদোন্নতির সুপারিশ করে গত ৩০ জুন অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে নথি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সুপারিশের পর জনপ্রশাসনের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা এবং বাকাসসের কর্মচারীরা অনেকবার অর্থ বিভাগে যোগাযোগ করলেও সম্মতি মেলেনি। গত ২৬ ফেব্রুয়ারির এক যৌথ সভায় বিভাগীয় কমিশনার কর্মচারী সমিতি ও বাকাসস নেতারা প্রধানমন্ত্রীর আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বড় না অর্থসচিব বড়? মার্চের মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন না হলে আরও কঠোর আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) নবীরুল ইসলাম বলেন, 'এখনও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। তবে অর্থ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।' অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (ব্যয় ব্যবস্থাপনা) সুলেখা রানী বসু বলেন, 'বিষয়টি অর্থ সচিব দেখভাল করছেন। আমি কিছুই বলতে পারব না।'

চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, 'বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দেখা হচ্ছে। তারাই এটি সমাধান করবেন।'

কর্মচারীদের আন্দোলনের বিষয়ে কথা হয় অন্তত ১০ ডিসির সঙ্গে। তারা সবাই বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মচারীদের সামাজিক মর্যাদা দেওয়া উচিত।

আশ্বাসেই সময় পার :গত ৭ ফেব্রুয়ারি কর্মচারীরা অন্দোলনের ঘোষণা দেন। এরপর ফেব্রুয়ারির মধ্যে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে কর্মসূচি পেছানোর অনুরোধ করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নবীরুল ইসলাম। তখন কর্মসূচি পিছিয়ে ১ মার্চ করা হয়।

এর আগে ২০২১ সালের শুরুতে টানা আন্দোলনের ঘোষণা দেন বাকাসস নেতারা। তখন তৎকালীন জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন তাদের সঙ্গে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে বৈঠক করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ১৫ দিনের মধ্যে তাদের কাজ নিষ্পন্ন করার আশ্বাস দেন। এরপর তাদের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। তারও আগে ২০২০ সালে ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বর তারা কর্মবিরতি পালন করেন। তখনও প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানানোর জন্য জনপ্রশাসন সচিবকে চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়। একইভাবে ২০০৮, ২০১১ ও ২০১৩ সালে তাদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হলেও ফল আসেনি আজও।