প্রথম পাশ্চাত্যরীতিতে শব ব্যবচ্ছেদকারী মধুসূদন গুপ্ত
প্রকাশ : 2022-11-15 13:07:57১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত (১৮০০ – ১৫ নভেম্বর ১৮৫৬) বাঙালি হিন্দু বৈদ্য পরিবারের একজন অনুবাদক এবং আয়ুর্বেদিক। তিনি ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে সুশ্রুতের পর ভারতীয় হিসেবে প্রথম পাশ্চাত্যরীতিতে শব ব্যবচ্ছেদ করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ১৮২৬ সালে সংস্কৃত কলেজের বৈদ্যক বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন মধুসূদন গুপ্ত। শিক্ষাগ্রহণকালে তিনি আয়ুর্বেদে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। পাশাপাশি তিনি সংস্কৃত, ন্যায়শাস্ত্র, অলংকার প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন ও যথেষ্ট বৈদগ্ধ্যের পরিচয় দেন। সংস্কৃত কলেজে ভর্তির আগে তিনি রাম কবিরাজ নামে এক বৈদ্যের কাছে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ দেওয়ার প্রাথমিক শিক্ষা নেন। বিভিন্ন বৈদ্যের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে রোগী দেখতে গিয়ে তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে ব্যুৎপত্তি অর্জনে পরবর্তীতে সাহায্য করেছিল।
সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদশাস্ত্র সম্পর্কে পাঠরত অবস্থায় তিনি শারীরতত্ত্ব সম্বন্ধে আকৃষ্ট হন। কাঠ বা মোম নির্মিত অস্থি দেখে ও বিভিন্ন জীবজন্তুর দেহ ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে ব্যবচ্ছেদ কার্যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
ডাক্তারি জীবনের সূত্রপাত ঘটে কলিকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে সংস্কৃত কলেজ থেকে বৈদ্যক বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হলে। যার ফলে ছাত্রদের মেডিকেল কলেজের ক্লাসে যেতে হয়। ছাত্র মধুসূদন ১৮৩৫ সালের ১৭ই মার্চ থেকে মেডিকেল কলেজের ডিমনস্ট্রেটরের কাজে নিযুক্ত হয়ে সহকারী অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু সহপাঠীর কাছে শিক্ষা গ্রহণে ছাত্ররা আপত্তি করলে ছাত্রদের অসন্তোষ প্রশমনের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ মধুসূদনকে ডাক্তারী ডিগ্রির চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে বলেন। ছাত্র মধুসূদন ডাক্তারী পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হলে কবিরাজ থেকে ডাক্তারে পরিণত হন। অধ্যয়নের পর, গুপ্ত একজন সংস্কৃত পণ্ডিত এবং একজন আয়ুর্বেদি চিকিৎসক হয়ে ওঠেন। তারপর, তিনি সংস্কৃত কলেজে শিক্ষক হন। তার সময়কালে, স্থানীয় ভারতীয়দের জন্য সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদ ও ইউনানি কোর্স পড়ানো হতো। হঠাৎ করেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশীয় চিকিৎসা শেখার পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। পরিবর্তে, তারা ১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে পাশ্চাত্য চিকিৎসার দ্বার উন্মোচন করে। ভারতে পশ্চিমা চিকিৎসা পদ্ধতির পদ্ধতিগত শিক্ষার জন্য এটিই ছিল প্রথম প্রতিষ্ঠান এবং অধিকন্তু এশিয়ায় ভারতীয়দের নিরাময়ের শিল্পে প্রশিক্ষণের জন্যও প্রথম প্রতিষ্ঠান। কলকাতা মেডিকেল কলেজ গুপ্তকে স্থানীয় শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং তাকে পশ্চিমা চিকিৎসা নিয়েও পড়াশোনা করতে বলেছিল, যার ফলে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রথম শিক্ষার্থী।
মৌলিকভাবে, অ্যানাটমি বা শারীরস্থান ছিল পশ্চিমা চিকিৎসা শিক্ষার অন্যতম ভিত্তি এবং একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। যদিও দেশীয় কুসংস্কার কারণে সেসময় ভারতে মৃতদেহে স্পর্শ করা এবং ব্যবচ্ছেদ করা নিষিদ্ধ ছিল। তবে, গুপ্ত পাশ্চাত্য চিকিৎসায় অত্যন্ত আগ্রহ দেখিয়েছিলেন এবং সেই সাথে প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছিলেন। তৎকালীন বর্ণহিন্দুদের গোঁড়া কুসংস্কারের জন্য শবব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ থাকলেও ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি অথবা ২৮শে অক্টোবর কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথা ভেঙে মহর্ষি সুশ্রুতের ৩,০০০ বছর পরে প্রথম বাঙালি হিসেবে ডাঃ হেনরি গুডইভের নির্দেশনায় মধুসূদন গুপ্ত কলকাতা মেডিকেল কলেজে শবব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে শারীরতত্ত্ব সম্পর্কে নতুন অধ্যায় শুরু করেন এবং আধুনিক চিকিৎসা শিক্ষার অগ্রগতির দিকে প্রথম অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এটি এশিয়ার প্রথম মানব ব্যবচ্ছেদ হিসেবেও স্বীকৃত ছিল। গুপ্তকে "ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ভারতীয় ব্যবচ্ছেদকারী" হিসাবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত করা হয়েছিল। এটি পশ্চিমা সভ্যতার একটি বড় বিজয় হিসাবে স্বীকৃত করা হয়েছিল। তাঁর সহকারী হিসেবে ছিলেন উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীন চন্দ্র মিত্র।
মেডিকেল কলেজের হিন্দুস্থানী বিভাগকে ১৮৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে নতুনভাবে গড়ে তোলা হলে মধুসূদন গুপ্তকে সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিভাগ খোলা হলে তার দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়। আমৃত্যু দীর্ঘ ২২ বছর তিনি মেডিকেল কলেজের বাংলা বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট পদে বহাল ছিলেন। তিনি বয়ঃসন্ধি সম্পর্কিত গবেষণা করেন।
তিনি ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগে আক্রান্ত হলে তাকে শবব্যবচ্ছেদ করতে নিষেধ করা হয়। তবে শবব্যবচ্ছেদ সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা করায় সেপ্টিসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন।