পাগল মহর আলী বাঙ্গালি ও তাঁর বাঙ্গালি ধর্ম
প্রকাশ : 2021-08-08 10:14:15১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
আমাদের এই বৃহত্তর বাংলায় বিগত কয়েক হাজার বছরে বেশ কয়েকটি ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। তার মধ্যে বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, বাউল, কর্তাভজা, নাথযোগী, ব্রাহ্ম, মতুয়া এবং সর্বশেষ মহর আলী বাঙালির মানবতার ধর্ম “বাঙালিধর্ম” অন্যতম। এই ধর্মটি ১৯৭১সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও একুশের ভাষার চেতনায় গড়ে ওঠে। বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতা এগিয়ে নিতে যুগের নায়ক পাগল মহর আলী বাঙালি তার বাঙালিতত্ত্ব “বাঙালি (১), ধর্ম মানবতা” ধর্ম- “বাঙালিধর্ম” প্রকাশ করেন।
(এখানে বাঙালি (১)- মানে জগতের সকল বাঙালি এক-ঐক্যবদ্ধ (১) অর্থে বোঝানো হয়েছে)
এই ধর্মটিকে “বাঙালিধর্ম” বা বাঙালির রেনেসাঁসের ধর্ম বলা হয়। এর অনুসারীরা একে বাঙালির জাতীয় ধর্ম বলেন।
এই ধর্মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন- বাঙালি জাতির পিতা, পাগল মহর আলী বাঙালি হলেন- বাঙালির ধর্মগুরু এবং বাঙালি জাতির চারজন পথপ্রদর্শক হলেন যথাক্রমে- লালন, হাছন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল।
ধর্মটির বাইরের কাঠামো চমকপ্রদ ও কিছুটা আধ্যাত্মিক মনে হলেও ভেতরের অংশটা সম্পূর্ণ লৌকিক, যৌক্তিক, মানবিক ও বৈজ্ঞানিক। ধর্মটি সদাই পরিবর্তনশীল এবং যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই ধর্মের প্রবর্তক পাগল মহর আলী বাঙালির সংক্ষিপ্ত জীবনী…
পরিচিতি :
নাম- পাগল মহর আলী বাঙালি (বাঙালির ধর্মগুরু। অপর নাম- বাঙালি)। পিতা – কলিম উদ্দিন সরকার। মাতা – শহর বানু। জন্ম – আনুমাণিক – ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ। জন্মস্থান – গ্রাম: কুলিয়ারচর, পোস্ট- ধলা, থানা- গফরগাঁও, জেলা- ময়মনসিংহ। ধর্মীয় দর্শন- বাঙালি (১), ধর্ম মানবতা- বাঙালিধর্ম প্রবর্তক। মৃত্যু – ০৯ ডিসেম্বর, ২০০১ খ্রিস্টাব্দ। জীবনকাল – ১১৮ বছর। সমাধি স্থান – ডেফলাই (পঁচাপুকুরগড়), ঝিনাইগাতী, জেলা- শেরপুর। বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
পাগল মহর আলী বাঙালি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও হতে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন। দেশে থাকাকালীন তিনি গফরগাঁওয়ের চিশতিয়া তরিকার গুরু ফজর আলী চাঁনের কাছে চিশতিয়া তরিকা নেন এবং বৈরাগ্যের পথ ধরেন। গুরুর আদেশে তিনি একই থানার লাউতলীর ধলার মেয়ে সাহেরা বেগমকে বিয়ে করেন।
তারপর তিনি আসাম গমন করেন। সেখানে তিনি গুরুর দেখানো পথ ছাড়াও বাঙালির সত্য সনাতন সিদ্ধজ্ঞান অর্জন করেন। তিনি বলেন- “স্মরণ করি বাঙালির পূর্বপুরুষ- চন্ডাল, মোঙ্গল, আর্য, দ্রাবিড়, হাবসী, তুর্কি, মোগল, আফগান, ইরানীদের। যাদের রক্তে ও সংস্কৃতিতে বাঙালি সমৃদ্ধ হয়েছে। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস অসাম্প্রদায়িক জাতির মানবতা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। তিনি “এই হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট।” তিনি বলেন…
ধর্ম মানবতা
সদা সত্য কথা
মানুষ ভক্তি লতা
আদর্শ মাতৃভাষা
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই
মানুষ পূজিলেই মহান স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করা যায়
(এখানে “স্রষ্টা” বলতে বাঙালির সংস্কৃতির পরম “সাঁই নিরাঞ্জন”কে বোঝানো হয়েছে)
মাতৃভাষাই আধ্যাত্মিক
এই মানবতাধর্মের মানবসংঘের নাম- “বাঙালি সংগঠন”।
আসাম থেকে ফেরার পর তিনি পাকিস্থান আমলে বাঙালির ধর্ম মানবতা- প্রচার করেন। তিনি ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ও তার সঙ্গীরা দৃশ্যমান হন এবং এলাকায় পরিচিত হন। ১৯৭৪ সালের দিকে তিনি তার বাঙালিধর্মমত প্রচার করেন- বাঙালি (১) ধর্ম মানবতা। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার নিকট এই ধর্মের মানবসংঘ ” বাঙালি সংগঠন” প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাঙালিধর্ম প্রচার শুরু করেন। ’৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর মহর আলী বাঙালি পাটের চট পড়ে হিন্দুদের লালশাহ শশ্মান, ইসলামপুরের অষ্টমীস্থান শশ্মান এবং মেথর পট্টিতে থাকতেন। রাতের বেলা ভক্তদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
মহর আলী বলেন, বাঙালির ধর্ম মানবতা একটি অসাম্প্রদায়িক গুরুবাদী ধর্ম। এই ধর্মের মূল কথা হলো মানবতা প্রতিষ্ঠা এবং নিজের আচরণ বা সংস্কৃতির সাথে বিশ্বসংস্কৃতির যোগের মাধ্যমে নিজের আচরণ, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়কে উন্নত করা, বিশ্বে নিজের স্থান তৈরী করা এবং জীবকে সেবা করার মাধ্যমে নিজের ভেতর মনুষত্য অর্জন করা।
বাংলাদেশের প্রথম ৭২এর মূল সংবিধান এবং জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ এই বাঙালির মানবতা ধর্মের মূলমন্ত্র।
পাগল মহর আলী বাঙালি বলেন, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যারা বাংলা ভাষাভাষি তারা বাঙালি। অন্যান্য ভাষাভাষি বা জাতির জন্য অসাম্প্রদায়িক চেতনায় –ধর্ম মানবতা। সকল আদিবাসীরাও নিজ নিজ সংস্কৃতি বজায় রেখে মনবতারধর্ম চর্চা করবেন। নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসে “মানবতা” স্থাপন করবেন। বাঙালিধর্ম কারো ধর্মীয় অধিকার ক্ষুন্ন করে না। প্রত্যেকের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার জন্য এ ধর্ম উৎসাহ প্রদান করে।
বাঙালীধর্মে সকাল-সন্ধ্যা দুইবেলা প্রার্থনা
একজন ভক্তের প্রার্থনা এরকম…
সকালে উঠে সূর্য উদয়-অস্তের আমি পূর্ণ পূর্ণ আন্তরিকভাবে মহাবিশ্ব, নিয়তি এবং বিশ্বপ্রকৃতির অতীত জ্ঞানে, বর্তমান মেনে, মাতা পিতা, মহামানব, মহামানবী স্মরণে, আকারে নিরাকারে, সেজদা করজোড়ে, মুক্তমনে, আনন্দময়চিত্তে, ভক্তিতে, বন্দনায়, গুরু প্রার্থনায়, সূর্য উদিত দিনের অংশে( রাতে হলে- সূর্য অস্তমিত রাতের অংশে), আমার বাংলা মায়ের মাটিতে, আমার/আমাদের স্মরণে মহাস্মরণে মাওলা আলী, মহাশক্তি মা কালী; আলী – কালী মা’র সমন্বয় সাধনে জাতীতে আমরা বাঙ্গালি। বাঙালির নামের সারমর্ম- মানবধর্ম এবং গুরু এলেন যুগের নায়ক পাগল মহর আলী বাঙালি। আপনিই দিলেন বাঙালি ধর্মের (সংসদীয় সংবিধানে) বাঙালি (১), ধর্ম- মানবতা। সদা সত্য কথা, মানুষ ভক্তি লতা, সবার উপরে মানুষ সত্য। মাতৃভাষা আদর্শ। মানুষ খুঁজিলেই মহান স্রষ্টার নৈকট্য লাভ হয়। মাতৃভাষাই আধ্যাত্মিক। হে আমার মহান গুরু, দয়াময় অনুগ্রহপূর্বক আমাকে/আমাদের সর্বকালের এবং সর্বাদিকের পক্ষ হইতে সারাদিনের কর্মকাণ্ড সুফলের দিকে পরিচালনা ও পরিপূর্ণতা দান করুন এবং কুফলের দিক হইতে আমাকে রক্ষা করুন এই কামনায় আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করুন। হে আমার গুরু দয়াময় আমাদেরকে শান্তি দিন এবং আপনার লৌকিক/অলৌকিক চরণে অর্ঘ্য জানাই। আমার মাতৃভাষার প্রার্থনা কবুল করুন।
জয়গুরু।।
এই ধর্মে সবচেয়ে বড় উৎসব হলো “সার্বজনীন পহেলা বৈশাখ” এবং “একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস”, ১৬ই ডিসেম্বর জাতির বিজয় দিবস এবং ০৯ই ডিসেম্বর মহর আলী বাঙালি স্মরণোৎসব। এছাড়া আরো কিছু দিবস আছে।
ভাষা দিবসে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার পর গুরুর মাজারে ভক্তি-শ্রদ্ধা অর্ঘ্য প্রদান করা হয়। বাঙালির মানবতাধর্মের (বাঙালিধর্মের) শিষ্যরা ভাষা শহীদ দিবসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মতই জীবন্ত শহীদ মিনার মনে করে গুরু বাবা পাগল মহরআলি বাঙালির মাজারকে। এতে তারা আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করে।
পাগল মহর আলী বাঙালি’র কনিষ্ট মেয়ে মমতাজ(মম) এবং ভক্ত খোকন বাঙালি বলেন…
গুরুবাবা মহর আলী পাগলা বলেন, সত্য দূর্বল, সেই জন্য একদিন সত্য বাতাসের মাধ্যমে, জীবাণুর মাধ্যমে মিথ্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠিত হবে। মসজিদ, মন্দির, গীর্জা সব বন্ধ হয়ে যাবে। সেই দিন মানুষ গুরুবাদের সত্য ও সুন্দর জগত উপলব্দি করবে। (ইদানিং করোনা (কেভিড-১৯) আক্রমনে তার নজির দেখেছে বিশ্ব) মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় সকাল-সন্ধ্যায় লালন, রবীন্দ্র নাথের গান বাজবে। গান বাঁজার ০৫ মিনিট আগে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য বাঁজবে। তারপর লালন, হাসনের সেই ভক্তিমূলক আধ্যাত্মিক গান বাঁজবে। জাতীয়সংগীত গেয়ে মসজিদের ঢুকবে। গুরুবাবা মহর আলী এগুলো বলছে – দেখে যাবে এ জাতি। সেই মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় সাধুরা থাকবে, সিদ্ধি সেবন করবে, তারা জগতের সত্য কথা প্রকাশ করবে- সেখান থেকে মানুষ জ্ঞান নিয়ে আসবে- জানেনা যা তা জানবে। -অসাম্প্রদায়িক চেতনা সঞ্চারিত হবে।
মহামারী সম্পর্কে গুরুবাবার ভবিষ্যত বাণী-
এ রকমই আসবে। এক সময় পারমাণবিকসহ সব অস্ত্র অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। সেখানে প্রযুক্তির কোন প্রয়োজন হবে না। সেখানে প্রকৃতিই মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। বাতাসের (ভাইরাসের) দ্বারা প্রলয় ঘটবে। নৈতিক স্খলনের বিরুদ্ধে প্রকৃতিই যুদ্ধ করবে।মিথ্যার জগত সব শেষ হবে। সুপ্ত থাকা সত্যই আবার প্রকাশিত হবে। ভাষার টান হলো স্রষ্টার আদি রহস্যের টান। যেদিন বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলগুলি পুনরায় একত্রিত হবে সে দিনই হবে বাঙলার স্বর্গ। কোন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা যদি শুক্রবারে মসজিদে জুম্মার নামাজে অংশগ্রহন করে –সেই দিন ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মা কষ্ট পাবে। এমন একটা সময় আসবে যখন আস্তে আস্তে মানুষে মানুষে দূরত্ব বেড়ে যাবে। কারণ মানুষ মিথ্যা বিশ্বাসের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবে।
বাঙালির ধর্মের “সত্যতত্ত্ব” সম্পর্কে
গুরুবাবা মহর আলী বাঙালি বলেন, বিশ্বের কোথাও যদি তুমি সত্য লোক দেখতে পাও তবে বাঙালি জাতিকে দেখতে পাবে। বাঙালি মানে সত্যের এপিঠ/ওপিঠ। বাঙালি মানেই সত্য, সত্য মানেই বাঙালি –মুদ্রার এপিঠ/ওপিঠ। বাঙালি সহজ সরল নিষ্পেষিত। যুগে যুগে সেই আর্য –বৈদিক যুগ হতে বাঙালি নিষ্পেষিত হয়েছে, মাইর খেয়েছে-শোষিত হয়ে আসছে। সত্যের বড় জ্বালা, প্রেম মানে ভাব- কোন হিংসা নাই যার। মুক্তির উপায় –তোমরা সবাই এক, যার যার পুরাতন, পরম্পরা, প্রাচীন, পুরাতন ধর্ম যারা বাতিল করে বাঙালিতে আসবে তারা কোন দিন প্রাচীন হবে না, বাঙালি সার্বজনীন, মানবতা হইলো তার সবচেয়ে বড় ধর্ম।
মুহাম্মদের জন্মের আগে, ঈসার জন্মের আগে, মুসার জন্মের আগে কি এই বাংলায় লোক ছিলো না ? –এখানে কি তারা ধর্ম করে নাই? কী খাইত? কী পড়ত? কী সভ্যতা? জাহেলি যুগে যখন কিছুই ছিলোনা- অন্ধকার, তখন আমরা বাঙালিরা ধন, ধান্যে, সমৃদ্ধিতে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত। তখন কি আমাদের বিদেশি ধার করা ধর্ম লাগবে? –আমরা প্রাচীন সভ্যতা। বাঙালি কী করে খাবে ? –বাঙালি সত্য থাকবে- তখনই বাঙালির মূল্যায়ন হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাঙালিদের দেখবে। সারা পৃথিবীর মানুষ বাঙালির সংস্কৃতি ও তার মানবতা দেখার জন্য আসবে। আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানবে যে এ দেশে কী যুদ্ধ হয়েছিলো।
এদেশে যুদ্ধ হয়েছে মূলত বাঙালি বনাম মুসলমানদের। সাম্প্রদায়িক বনাম অসাম্প্রদায়িকদের। মুসলমানরা ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ বলে গুলি করেছে আর বাঙালিরা গুলি করেছে ‘জয়বাংলা’ বলে। তাহলে স্রষ্টা যদি থেকেই থাকে তবে স্রষ্টা সত্যের পক্ষেই আসছে, স্রষ্টা বাঙলা ভাষার মধ্যেই উদয় হয়েছে- বাঙলা ভাষার জয় হয়েছে। বাঙালিরা ‘জয়বাংলা’ বলে গুলি করেছে আর তারা ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’ বলে গুলি করেছে। গুরুবাবা মহর আলী বলছেন, ওদের আল্লাহ ঠকে পাকিস্থান গেছে। এখানে কোন আল্লাহ নাই। ৭১ এ আল্লাহ ঠকছে। আমি তোমাদের নতুন বিধান দিলাম সত্য –সেই থেকে বাঙালির ধর্ম মানবতার উদ্ভব !!!
গুরুবাবা আরো বলেন, যুদ্ধে তো ওরা বলত ‘তুম কলেমা বাতাও ? একটা সহজ সরল কৃষক সে কালেমার কি করে জানবে ? -কিছুই জানেনা। ওরা বলছে এটা বাঙালি। তখন তারা গুলি করে হত্যা করে বাঙালিদের। তারপরপরই জয়বাংলা-ই হলো বাঙালির কলেমা। বাঙলা বাঙালির জয় হোক, বাংলার জয় হোক। জয় হইল প্রতিষ্ঠিত সত্য- মহাসত্য। কারন এইটা দিয়েই দেশ স্বাধীন হয়েছে। “জয়বাংলা” এখন রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা স্বীকৃত জাতীয় শ্লোগান।
বাঙালির মানবতাধর্মে (বাঙালিধর্মে) পাপ, পূণ্য, কর্মফল
এ প্রসঙ্গে গুরুবাবা মহর আলী পাগলা বলেন, যার যার কৃত কর্মের জন্য সেই সেই কর্মফল ভোগ করবে। তুমি মিথ্যা হয়ে চলে গেছ, তোমার মিথ্যার উপরই তোমার প্রজন্ম তোমার জন্মান্তরের মূল্যায়ন করবে- এটাই তোমার শাস্তি। যে যেই কর্ম করবে- তুমি খারাপ হয়ে জগতে চললে তোমার একদিন কৃতকর্মের বিচার তোমার মধ্যেই হবে। আর সত্য যারা তাদের আর কোন বিচার হবে না। তারা সত্য- চিরদিনই সত্য, অনন্ত অনন্ত। যারা সত্য থাকবে তারা স্বর্গের মধ্যেই আছে। যারা মিথ্যা, যারা সমাজের অসত্য, কুসংস্কার তারা হানাহানি, সংঘাত এসবের মধ্যেই থাকবে অর্থাৎ নরকেই আছে। এই নরক, এই স্বর্গ এই মর্তেরই; পরকালের নয়।
গুরুবাবা মহর আলী পাগলা আরো বলেন, যারা বস্তুবাদের (ভোগবাদের) মোহে আছে তাদের এটাই নরক। আর যারা এসবের উপরে চলে গেছে, উন্নত জ্ঞান অর্জন করে যারা আরো উন্নততর পর্যায়ে গেছে বস্তুবাদের মোহ থেকে মুক্তি পেয়েছে সে-ই স্বর্গ পাইল। এর পরে আর কোন হাশর-কেয়ামত কিছুই নাই। আমি যেটা চাই সেটা আমি পাব কীভাবে ? গুরুবাবা বলেন, সত্য হলে অবশ্যই পাবে।
বাঙালিধর্মে নারী হলো বাংলার ফুল
গুরুবাবা মহর আলী পাগলা বলেন, নারী হইলো বাঙলার ফুল! বাংলার এই ফুলের সমান সুন্দর আর এই পৃথিবীতে নাই। এই ফুল ছিড়বেনা, ধরবেনা, ভোলাবেনা। এই ফুলের উপভোগ তোমরা করবে, ঘ্রাণ নিবে কিন্তু ছিড়বেনা- এ বাগানের মধ্যে বেড়াবে। সারা বিশ্বের যেকোন মানুষ, হাজার, কোটি, লক্ষ লোক এই ফুল নারীদের সাথে সম্পর্ক করবে। এই ফুলের আছে পূর্ণাঙ্গ অধিকার। বোনের সম্পত্তি তার ভাইয়ের সমান করবে, পুরুষের সমান মজুরি দিবে নারীকে। নারীর ক্ষমতায়ন, নারী শিক্ষা, সঙ্গী নির্বাচন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দিবে নারীকে। নারী আর্থিক সাবলম্বীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। তবে তিনি এও বলেন যে, সত্য নারী প্রতিষ্ঠিত আর মিথ্যা নারী ধ্বংসকর। নারী নির্যাতন বিরোধী আইনের পাশাপাশি পুরুষ নির্যাতন আইনের প্রস্তাবও করেন গুরু বাবা- এখানে নারী-পুরুষ সবাই সমান।
গুরু বাবা মহর আলী’র “সত্যতত্ত্ব”
সত্য মানে- স্বচ্ছতা। সত্য মানে- সবার উপরে মানুষসত্য। সত্য মানে- প্রকৃতির ধর্ম। সত্য মানে- চলন বলনে বাঙালির সৎ জীবন যাপন। সত্য মানে- চরিত্র ও অদর্শগত ভাবে যে সৎ। সত্য মানে- বাঙলার নদী, নালা, খাল, বিল, বন, পাহাড়, আকাশ, বাতাস। সত্য মানে বাঙালির আদি শেকড়- বাঙালির সংস্কৃতি। সত্য মানে- দৈহিক শ্রম নির্ভর সেই মানুষ- যার উপার্জন সৎ। সত্য মানে- জগতের সকল কিছুর ব্যাখ্যায় বিজ্ঞান ও যুক্তি দ্বারা পরিশুদ্ধ- বিশুদ্ধ জ্ঞান। সত্য মানে- মাতৃভাষা। সত্য মানে- বাঙালি। সত্য মানে – বাঙালির চেতনা। জগতের সত্য সম্পর্কে পাগল মহর আলী আরো বলেন, সত্য –স্বচ্ছতা, বিজ্ঞান ও যুক্তি। সততা- সব কিছুতেই, তার চলন বলন, সকল কাজকর্মে, তার চেতনায় সকল কিছুতে স্বচ্ছতা। প্রকৃতি মানুষের ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ধনী, গরিব এসব চিনেনা। প্রকৃতি অসাম্প্রদায়িক- প্রকৃতির ধর্মই সত্য। মানুষকে প্রকৃতির মতই অসাম্প্রদায়িক কিন্তু মানবিক হতে হবে। মানুষসত্য- সবার উপরে মানুষ সত্য। আদি শেকড়- বাঙালির ঐতিহাসিক পূর্বপুরুষ, মাটি, প্রকৃতি, মানুষ। সৎ- জীবন, চরিত্র, আদর্শ। সত্য- মাতৃভাষা। বাঙালি সত্য- কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাতী, ধোঁপা, মজুর- যাদের কোন সঞ্চয় নাই, জমি নাই, যারা সর্বহারা- তারাই সত্য, যাদের আছে তারা সত্য হবে না। দেহ নির্ভর শ্রমিক- তারাই সত্য। ধন সম্পদ লোভীরা বাঙালি হবেনা, বাঙালি দাবী করতে পারবেনা। যে কারও কোন ক্ষতি ছাড়াই শ্রমের বা আদর্শের দ্বারা মানব কল্যাণ সাধন করে সে-ই সত্য। এই সবগুলো যে অর্জন করতে পারবে সে-ই অসাম্প্রদায়িক, সে-ই- মানবিক, সে-ই বাঙালি। যে অর্জন করতে পারবেনা- সে মানবিক হতে পারবেনা, বাঙালি হতে পারবেনা, অসাম্প্রদায়িক হতে পারবেনা। তার জন্য এই ধর্ম নয়।
বাঙালিধর্মটির বিশ্বজনীনতা
ধর্মটি বিশ্বের যেকোন দেশে তাদের লোকজ কিংবা নাগরিক সংস্কৃতির কোনরূপ ক্ষতি না করেই যেকোন লোক কিংবা সংঘ ধর্মটি চর্চা করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে ধর্মটি যে দেশে চালু করতে চাইবে প্রথমেই সে দেশের জন্মলগ্নের প্রথম অবিকৃত, অসম্প্রদায়িক সংবিধানের সাথে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ যুক্ত করে তাদের জাতির পিতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে দুইজন অসাম্প্রদায়িক- আধ্যাত্মিক সাধু এবং দুইজন আধুনিক সাহিত্যিক/বিজ্ঞানীকে পথপ্রদর্শক করে যিনি চালাতে চান তার নামে ধর্মটি চালাতে পারেন। তখন ধর্মটির নাম হবে ওই সংস্কৃতির নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। এক্ষেত্রে বাঙালিধর্মটি তার স্বকীয়তা বজায় রেখে আপেক্ষিক ভাবে বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হবে।
ধর্মটির মূল লক্ষ্য হবে স্থানীয় সংস্কৃতিকে রক্ষা ও মানবতার মন্ত্রে সবাইকে ঐক্যবন্ধ করা।
এই ধর্মটি শুধুমাত্র সংস্কৃতি, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথাই বলেনা, সেইসাথে স্বজাতির সংস্কৃতি নির্ভর গার্হস্থ্য অর্থনীতির কথাও বলে। নিজস্ব অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য, নিজ সংস্কৃতির লোকজনের তৈরি করা পণ্য ব্যবহার এ ধর্মের ধর্মীয় দায়িত্ব। এ ধর্মের অনুসারীরা “স্বদেশী পণ্য কিনে হও ধন্য” নীতিতে বিশ্বাসী হবেন। এতে তার সংস্কৃতিক ঐতিহ্যও টিকে থাকবে এবং স্থানীয় অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে।
রাষ্ট্রের সংবিধান যেমন জনগনের আশা আকাঙ্খার কথা বলে তেমনি এই মানবতাধর্মটিও জনগনের আশা আকাঙ্খার বলে। এ ক্ষেত্রে ধর্মটির প্রথম ভিত্তি রাষ্ট্রের সংবিধান। সংবিধানের পরিবর্তন হলে এই ধর্মটিও পরিবর্তন হয়। এ ধর্মটি পরিবর্তনশীল ধর্ম। এর সাথে যোগ হয় জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ।
বাঙালিধর্মের আধ্যাত্মিক পর্ব
সংস্কৃতি মানে মানুষের বা জনগোষ্ঠীর আচরণ বা রীতিনীতি। আধ্যাত্মবিদ্যায়- আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের মাধ্যমে সাধক সিদ্ধি অর্জন করেন। আদতে দেহের- মানুষের কিংবা প্রাণীদের আচরণই আত্মা, আচরণ বা সংস্কৃতি। এটা খুবই বৈজ্ঞানিক যে আচরণকে বা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে আত্মা হিসেবে কল্পনা করলে বা উপলব্দি করলে জগতের সকল জীবের কিংবা জড় বস্তুর স্বরূপ উপলব্দি করা যায়, এমনকি নিজের আত্মপরিচয় সম্পর্কেও।
এখানে আত্মার পরিবর্তে- “আচরণ বা সংস্কৃতি” এবং পরমাত্মার পরিবর্তে হবে “বিশ্বসংস্কৃতি”।
নিজের বাঙ্গালি সত্তার সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রের সংস্কৃতি যোগ হলেই সে সিদ্ধ অর্জন করতে পারবে বা বাঙালি হতে পারবে। এটাই এই বাঙালীধর্মের আধ্যাত্মিক কিংবা দার্শনিক ভিত্তি।
বাঙালিধর্মে “অমরত্ব”…
বাঙালির মানবতাধর্মের অনুসারীদের কাজে অমরত্ব আছে। কিন্তু সেটা পরকালের অমরত্ব নয়। ইহকালে জীবকূলের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে অমরত্ব। সেবার মাধ্যমে, মানুষের জীবন রক্ষার মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জীবকূলের প্রজ্ঞা/মনন/স্মৃতিতে অমরত্ব অর্জন করা।- উপকারভোগীর হৃদয়ে স্মরণ থাকার মাধ্যমে এই ধর্মটি অমরত্বের শিক্ষা দেয়।
বাঙালির মোক্ষ অর্জন…
এ ধর্মে আপনসত্তা বলতে নিজের আচরণ, নিজের সংস্কৃতি। পরমসত্তা বলতে বিশ্বের সকল মানুষের “কমন আচরণ” যাকে বৈশ্বিক সংস্কৃতি বলে। বৈশ্বিক সংস্কৃতির কমন আচরণকে তার প্রজ্ঞায়/মননে উপলব্দি করে নিজের সংস্কার বা নিজেকে পরিবর্তন করে নেওয়াই বাঙালিধর্মের পরম মোক্ষ বা বাঙালীধর্মের নির্বান লাভ। অর্থাৎ একজন বাঙালি শুধু তার নিজের সংস্কৃতিতেই ডুবে থাকবে না বরং বিশ্ব সংস্কৃতি উপলব্দির মাধ্যমে তার নিজেকে পরিবর্তন করে নেওয়ার, নিজেকে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ করার মাঝেই তার স্বার্থকতা। এটা এই ধর্মের লৌকিক আধ্যাত্মিক কর্মও বটে।
বিশ্বের প্রভাশালী ধর্মগুলোর আধ্যাত্মিক রূপটি প্রায়ই অভিন্ন। – এলমে তাসাউফ বা আত্মতত্ত্বের ভাব। নিজের আয়নায় নিজের, পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের, বিশ্বের আচরণ বা সংস্কৃতি অনুধ্যানের ভাব। এখানে বাঙালি গুরুর মহান ইচ্ছা-
“এই আমি প্রকৃতির অংশ, কারো উপরে নই- সবার অন্তর্গত”।
মানুষ প্রকৃতির নিকৃষ্ট জীব! হত্যাকারী প্রাণী হিসেবে সে বিখ্যাত। মানুষ তার মরণঘাতি আচরণ বাদ দিয়ে মানবপ্রেমি, মানবতাবাদী, জীবপ্রেমি হতে পারলেই সে জীবকূলের সেরা হতে পারবে। তাই, তাকে প্রথমেই অর্থ, ক্ষমতা ও ধর্মের নামে মানুষ হত্যা, প্রাণী হত্যা, বলিপ্রথা, কোরবানীপ্রথা বন্ধ করতে হবে। তবেই সে মানবিক হতে পারবে, বাঙালি হতে পারবে। এটা বাঙালীধর্মের মানবতার মূল কথা।
বাঙালিধর্মে মানবতার ইতিহাস…
পাগল মহর আলী বাঙালির দর্শন সম্বন্ধে বুঝতে গেলে কয়েক হাজার বছরে বাংলা অঞ্চলে মানবতা প্রতিষ্ঠায় জন্ম নেওয়া প্রাচীন বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, বাউল, ব্রাহ্ম, মতুয়া ধর্মগুলোর দিকে তাকাতে হবে। আমাদের লোক কবিগণ পৌরাণিক অথবা আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় বিষয় অবলম্বন না করে গ্রামের সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের কাহিনী রচনা করেছেন। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর সমন্বয়ী মনোভাব। যা আনুষ্ঠানিক ধর্মের সোপানে বিন্যস্ত সমাজের বিধি নিষেধকে অগ্রাহ্য করে মানবতার প্রতিফলন ঘটায়। অন্যদিকে যারা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন সেই রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ওদের মধ্যে মানবতাবাদ এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এর উন্মেষ লক্ষ্য করি। যেখানে বাঙালির হাজার বছরের বৈষম্য ঘুচাতে মানবতার লড়াই প্রতিভাত হয়। বাঙালির সহস্রাব্দের এই মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের বাস্তব রূপ দিতে পাগল মহর আলিও যোগোপযোগী বাঙালি মানবতার ধর্ম বাঙালিধর্মের প্রবর্তন করেন। যেখানে তিনি বঙ্গবন্ধু এবং লালন, হাছন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মানবতাবাদী ভাবধারায় বাঙালিধর্ম প্রচারে প্রয়াসী হন।
মহর আলীর বাঙালিধর্মে অলৌকিকতার কোন স্থান নাই। এ ধর্মের জ্ঞান অর্জন করার পদ্ধতি
প্রত্যক্ষ জ্ঞান…
বাঙালির লোকজ, লৌকিক দর্শন হাজার বছরের পুরনো। যা লালনের দিব্যজ্ঞান, লোকাচারের প্রত্যক্ষ বা প্রমাণ দর্শন হিসেবে অবিহিত করা যায়। বাঙালির এই লৌকিক দর্শনের জগতে জগতের আয়তন ইন্দ্রিয়গোচরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ বস্তুজ জ্ঞানই বাঙালির প্রকৃত সত্যতত্ত্ব বা ধর্মজ্ঞান।
অনুমান প্রমাণ…
অনুমানলব্ধ জ্ঞানের হেতু বা সাধনের সঙ্গে অনুমান বা সাধ্যের সম্পর্ক বা ব্যাপ্তিকে বাঙালির লোকজ দার্শনিকেরা ভ্রান্ত হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে অভ্রান্ত ব্যাপ্তিজ্ঞানের উৎপত্তি প্রত্যক্ষের সাহায্যে সম্ভব নয়। এই পরিবর্তনশীল জগতে দেশ, কাল ও পরিবেশের বিভিন্নতা অনুযায়ী বস্তুজগত ও তার ধর্ম প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়, তাই অনুমান দ্বারা ব্যাপ্তিজ্ঞানকে মহর আলী চিরকালীন হিসেবে ধরেননি। বাঙালি দর্শন মতে অনুমান সম্ভাবনার আভাষ মাত্র। মহর আলীর ভাষায়, অনুমাণ করে কখনও কিছুর উপরে আস্থা রেখোনা।- অনুমাণ করে কিছু বলতে যেওনা।
আপ্তবাক্য প্রমাণ…
আপ্তবাক্য (চিরন্তন সত্য বলে যা বিশ্বাস করা হয়) অনুমানের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এর দ্বারা কোন কিছু প্রমাণ করা বাঙলিরদর্শনে ভ্রান্ত বলে বিবেচিত। আপ্তবাক্যের সত্যতার ভিত্তি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির উক্তি যা ব্যক্তির ব্যাপ্তিজ্ঞানে বিশ্বাসের ওপর অধিকাংশ সময়ে নির্ভরশীল হওয়ায় তা বাঙালি মতে গ্রাহ্য নয়।
বাঙালিধর্মে গান ও গণসংগীত
বাঙালিধর্মের গান- লোকসংগীত। লালন, হাসন –ভাব। রবীন্দ্র, নজরুল- আধুনিক। লোক মানে “বিরাট”। আর এই বিরাট সংগীতই বাঙালির লোকসংগীত। সেটা যে সময়ের, যে স্থানেরই হোক না কেন। বাঙালিধর্মের অনুসারীরা দেশপ্রেমের সাথে সাথে সামাজিক ন্যয়বিচার, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার তথা মানবতার বাণী সম্বলিত গানই পরিবেশন করেন। মহর আলী বাঙালির বাঙালীধর্মে লালন, হাসন, রবীন্দ্র, নজরুল প্রমুখদের গল্প কবিতা এবং গান এর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। মহর আলী সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন বাঙালিসত্তাকে। তিনি এই সত্তাকে বিকশিত করতে সবাইকে বাঙলা গান গাইতে বলেন। এই গানের ভেতর দিয়ে বাঙালি সত্তার জগতে পৌঁছানো সম্ভব। আর এই সত্তার বিশ্বযোগের মাধ্যমে বাঙালির বিশ্বসংস্কৃতিতে উপস্থিতি সম্ভব। মানবতার এই বিশ্বধর্ম যে দেশে যাবে সে দেশের লোকসংগীতই হবে এই বাঙালিধর্মের সংগীত।
মহর আলী বাঙালি সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাবাদকে স্থান দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাঙালিসত্তার কোন ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ, কূল নেই। মানুষের দৃশ্যমান শরীর এবং অদৃশ্য মনের বাঙালিসত্তা পরস্পর বিচ্ছিন্ন, কিন্তু শরীরেই, আচরণে সংস্কৃতি বাস করে। মহর আলী বাঙালির এই দর্শনকে কোন ধর্মীয় আদর্শের অন্তর্গত করা যায় না। ধর্মটির বিশ্বজনীনতার জন্য একে কোন জাতীয়তাবাদীধর্মও বলা যায় না। ধর্মটি পুরোই সংস্কৃতিক। মহর আলী নিজ সত্তাকে বিবেচনা করেছেন চিরায়ত বাঙলার অসাম্প্রদায়িক লোকজ, লৌকিক, অজানা এক ব্রাত্য, অস্পৃশ্য এক ও একক সত্তারূপে। সেই অর্থে মহর আলীর বাঙালিধর্মকে বাঙালির লৌকিক, লোকদর্শন বা লোকধর্ম বলা যেতে পারে।
মহর আলী’র সময়কালে বৃটিশ, পাকিস্থানের শাসন, শোষণ, অপরাজনীতি যাবতীয় নিপীড়ন, মানুষের প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমাজের নানান কুসংস্কারকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করে ছিলেন। আর সে কারণেই মহর আলীর প্রতি তখনকার জামালপুর, ময়মনসিংহ ও শেরপুরের বহু ভূস্বামী, বুদ্ধিজীবী, সমাজপতি, কবি, লেখক এমনকি গ্রামের নিরক্ষর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তার সহজ-সরল শব্দময় বক্তব্যে বাঙালি জীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছিল। পাগল মহর আলীর কথায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে অতীব সংবেদনশীল ছিলেন। ব্রিটিশ, পাকিস্থান আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেদ-সংঘাত ও দাঙ্গা হয়েছিলো তখন মহর আলী ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। তিনি মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না। তার মানবতাবাদী দর্শনের মূল কথা হচ্ছে “মানুষ”।
মহর আলী বাঙালির মানবতাধর্মের মূল সংবিধান
বাঙালি’র এই মানবতা ধর্মের ধর্মগ্রন্থ হল “৭২ এর মূল সংবিধান” ও জাতিসংঘের “সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ”। এই দুটি মিলেই বাঙালি (১) ধর্ম মানবতা তথা- বাঙালিধর্ম।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় বিজয় যেমন বাঙালীর পাঁচ হাজার বছরের লিখিত-অলিখিত ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন- একইভাবে ১৯৭২-এর ৪ নবেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গণপরিষদে গৃহীত সংবিধানে যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ ঘোষিত হয়েছে গণতান্ত্রিক বিশ্বে তা বিরল। পাগল মহর আলী বাঙালি তাই বাঙালি জতিসত্তার চেতনায় ১৯৭২ এর এই মূল সংবিধানকে পবিত্রগ্রন্থ বলে ঘোষণা করেছিলেন।
বাংলাদেশের আদি ৭২এর সংবিধানে ধর্মকে শুধু রাষ্ট্র থেকে নয়, রাজনীতি থেকেও পৃথক করা হয়েছিল। এর কারণ হিসেবে বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ নবেম্বর গণপরিষদের অবিস্মরণীয় ভাষণে বলেছিলেন-
‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি বলে গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নেই, আমি বলব সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটিকয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে।’
ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে ’৭২-এর সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল-
‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে;
‘তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না।
এবার আসি বাঙালির মানবতাধর্ম বাঙালিধর্মের মূলমন্ত্র তথা “জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সদনের আলোচনায়…
বাঙালির মানবতা ধর্মে “বাঙালিধর্মে” জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার
মুখবন্ধ: যেহেতু মানব পরিবারের সকল সদস্যের সমান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহ এবং সহজাত মর্যাদার স্বীকৃতিই হচ্ছে বিশ্বে শান্তি, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি;
যেহেতু মানব অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা এবং ঘৃণার ফলে মানুষের বিবেক লাঞ্ছিত বোধ করে এমন সব বর্বরোচিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং যেহেতু এমন একটি পৃথিবীর উদ্ভবকে সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ কাংখা রূপে ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে সকল মানুষ ধর্ম এবং বাক স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং অভাব ও শংকামুক্ত জীবন যাপন করবে;
যেহেতু মানুষ যাতে অত্যাচার ও উত্পীড়নের মুখে সর্বশেষ উপায় হিসেবে বিদ্রোহ করতে বাধ্য না হয় সেজন্য আইনের শাসন দ্বারা মানবাধিকার সংরক্ষণ করা অতি প্রয়োজনীয়;
যেহেতু জাতিসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক;
যেহেতু সদস্য জাতিসমূহ জাতিসংঘের সনদে মৌলিক মানবাধিকার, মানব দেহের মর্যাদা ও মূল্য এবং নারী পুরুষের সমান অধিকারের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং বৃহত্তর স্বাধীনতার পরিমণ্ডলে সামাজিক উন্নতি এবং জীবনযাত্রার উন্নততর মান অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন;
যেহেতু সদস্য রাষ্ট্রসমূহ জাতিসংঘের সহযোগিতায় মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সমূহের প্রতি সার্বজনীন সম্মান বৃদ্ধি এবং এদের যথাযথ পালন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্য অর্জনে অঙ্গীকারবদ্ধ;
যেহেতু এ স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহের একটি সাধারণ উপলব্ধি এ অঙ্গীকারের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এজন্য এখন সাধারণ পরিষদ এই মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র জারী করছে এ ঘোষণা সকল জাতি এবং রাষ্ট্রের সাফল্যের সাধারণ মানদণ্ড হিসেবে সেই লক্ষ্যে নিবেদিত হবে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি এবং সমাজের প্রতিটি অঙ্গ এ ঘোষণাকে সবসময় মনে রেখে পাঠদান ও শিক্ষার মাধ্যমে এই স্বাধীনতা ও অধিকার সমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে সচেষ্ট হবে এবং সকল সদস্য রাষ্ট্র ও তাদের অধীনস্থ ভূখণ্ডের জাতিসমূহ উত্তরোত্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়াসের মাধ্যমে এই অধিকার এবং স্বাধীনতাসমূহের সার্বজনীন ও কার্যকর স্বীকৃতি আদায় এবং যথাযথ পালন নিশ্চিত করবে।
ধারা ১ :
সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাঁদের বিবেক এবং বুদ্ধি আছে; সুতরাং সকলেরই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আচরণ করা উচিৎ।
ধারা ২ :
এ ঘোষণায় উল্লেখিত স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহে গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, ভাষা, রাজনৈতিক বা অন্যবিধ মতামত, জাতীয় বা সামাজিক উত্পভত্তি, জন্ম, সম্পত্তি বা অন্য কোন মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই সমান অধিকার থাকবে।
কোন দেশ বা ভূখণ্ডের রাজনৈতিক, সীমানাগত বা আন্তর্জাতিক মর্যাদার ভিত্তিতে তার কোন অধিবাসীর প্রতি কোনরূপ বৈষম্য করা হবেনা; সে দেশ বা ভূখণ্ড স্বাধীনই হোক, হোক অছিভূক্ত, অস্বায়ত্বশাসিত কিংবা সার্বভৌমত্বের অন্য কোন সীমাবদ্ধতায় বিরাজমান।
ধারা ৩ :
জীবন, স্বাধীনতা এবং দৈহিক নিরাপত্তায় প্রত্যেকের অধিকার আছে।
ধারা ৪ :
কাউকে অধীনতা বা দাসত্বে আবদ্ধ করা যাবে না। সকল প্রকার ক্রীতদাস প্রথা এবং দাসব্যবসা নিষিদ্ধ করা হবে।
ধারা ৫ :
কাউকে নির্যাতন করা যাবে না; কিংবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না অথবা কাউকে এহেন শাস্তি দেওয়া যাবে না।
ধারা ৬ :
আইনের সামনে প্রত্যেকেরই ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার আছে।
ধারা ৭ :
আইনের চোখে সবাই সমান এবং ব্যক্তিনির্বিশেষে সকলেই আইনের আশ্রয় সমানভাবে ভোগ করবে। এই ঘোষণা লঙ্ঘন করে এমন কোন বৈষম্য বা বৈষম্য সৃষ্টির প্ররোচনার মুখে সমান ভাবে আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
ধারা ৮ :
শাসনতন্ত্রে বা আইনে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত জাতীয় বিচার আদালতের কাছ থেকে কার্যকর প্রতিকার লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
ধারা ৯ :
কাউকেই খেয়ালখুশীমত গ্রেপ্তার বা অন্তরীণ করা কিংবা নির্বাসন দেওয়া যাবে না।
ধারা ১০ :
নিজের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ এবং নিজের বিরুদ্ধে আনীত ফৌজদারী অভিযোগ নিরূপণের জন্য প্রত্যেকেরই পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার-আদালতে প্রকাশ্য শুনানি লাভের অধিকার রয়েছে।
ধারা ১১ :
১. দণ্ডযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের নিশ্চিত অধিকারসম্বলিত একটি প্রকাশ্য আদালতে আইনানুসারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ গণ্য হওয়ার অধিকার থাকবে।
২. কাউকেই এমন কোন কাজ বা ত্রুটির জন্য দণ্ডযোগ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না, যে কাজ বা ত্রুটি সংঘটনের সময় জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ ছিলনা। দণ্ডযোগ্য অপরাধ সংঘটনের সময় যে শাস্তি প্রযোজ্য ছিল, তার চেয়ে গুরুতর শাস্তিও দেওয়া চলবে না।
ধারা ১২ :
কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তাঁর গৃহ, পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়ালখুশীমত হস্তক্ষেপ কিংবা তাঁর সুনাম ও সম্মানের উপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
ধারা ১৩ :
১. নিজ রাষ্ট্রের চৌহদ্দির মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং বসবাস করার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. প্রত্যেকেরই নিজ দেশ সহ যে কোন দেশ পরিত্যাগ এবং স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের অধিকার রয়েছে।
ধারা ১৪ :
১. নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভিন্নদেশে আশ্রয় প্রার্থনা করবার এবং সে দেশের আশ্রয়ে থাকবার অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. অরাজনৈতিক অপরাধ এবং জাতিসংঘের উদ্দেশ্য এবং মূলনীতির পরিপন্থী কাজ থেকে সত্যিকারভাবে উদ্ভূত অভিযোগের ক্ষেত্রে এ অধিকার প্রার্থনা নাও করা যেতে পারে।
ধারা ১৫
১. প্রত্যেকেরই একটি জাতীয়তার অধিকার রয়েছে।
২. কাউকেই যথেচ্ছভাবে তাঁর জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না, কিংবা কারো জাতীয়তা পরিবর্তনের অধিকার অগ্রাহ্য করা যাবে না।
ধারা ১৬ :
১. ধর্ম, গোত্র ও জাতি নির্বিশেষে সকল পূর্ণ বয়স্ক নরনারীর বিয়ে করা এবং পরিবার প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে। বিয়ে, দাম্পত্যজীবন এবং বিবাহবিচ্ছেদে তাঁদের সমান অধিকার থাকবে।
২. বিয়েতে ইচ্ছুক নরনারীর স্বাধীন এবং পূর্ণ সম্মতিতেই কেবল বিয়ে সম্পন্ন হবে।
৩. পরিবার হচ্ছে সমাজের স্বাভাবিক এবং মৌলিক গোষ্ঠী-একক, সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভের অধিকার পরিবারের রয়েছে।
ধারা ১৭ :
১. প্রত্যেকেরই একা অথবা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার আছে।
২. কাউকেই যথেচ্ছভাবে তাঁর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
ধারা ১৮:
প্রত্যেকেরই ধর্ম, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। এ অধিকারের সঙ্গে ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তনের অধিকার এবং এই সঙ্গে, প্রকাশ্যে বা একান্তে, একা বা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে, শিক্ষাদান, অনুশীলন, উপাসনা বা আচারব্রত পালনের মাধ্যমে ধর্ম বা বিশ্বাস ব্যক্ত করার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
ধারা ১৯ :
প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। অবাধে মতামত পোষণ এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে যে কোন মাধ্যমের মারফত ভাব এবং তথ্য জ্ঞাপন, গ্রহণ ও সন্ধানের স্বাধীনতাও এ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
ধারা ২০ :
১. প্রত্যেকেরই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণ ও সমিতি গঠনের স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে।
২. কাউকে কোন সংঘভূক্ত হতে বাধ্য করা যাবে না।
ধারা ২১ :
১. প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. নিজ দেশের সরকারী চাকুরীতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
৩. জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের শাসন ক্ষমতার ভিত্তি; এই ইচ্ছা নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্ত হবে; গোপন ব্যালট কিংবা সমপর্যায়ের কোন অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ধারা ২২ :
সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকেরই সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার আছে। জাতীয় প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংগঠন ও সম্পদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রত্যেকেরই আপন মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্বের অবাধ বিকাশের জন্য অপরিহার্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহ আদায়ের অধিকার রয়েছে।
ধারা ২৩ :
১. প্রত্যেকেরই কাজ করার, স্বাধীনভাবে চাকুরী বেছে নেবার, কাজের ন্যায্য এবং অনুকূল পরিবেশ লাভ করার এবং বেকারত্ব থেকে রক্ষিত হবার অধিকার রয়েছে।
২. কোনরূপ বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের জন্য সমান বেতন পাবার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
৩. কাজ করেন এমন প্রত্যেকেরই নিজের এবং পরিবারের মানবিক মর্যাদার সমতুল্য অস্তিত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে এমন ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক লাভের অধিকার রয়েছে; প্রয়োজনবোধে একে অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাদি দ্বারা পরিবর্ধিত করা যেতে পারে।
৪. নিজ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রত্যেকেরই ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং তাতে যোগদানের অধিকার রয়েছে।
ধারা ২৪ :
প্রত্যেকেরই বিশ্রাম ও অবসরের অধিকার রয়েছে; নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে বেতনসহ ছুটি এবং পেশাগত কাজের যুক্তিসঙ্গত সীমাও এ অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।
ধারা ২৫ :
১. খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সার ও প্রয়োজনীয় সমাজ কল্যাণমূলক কার্যাদির সুযোগ এবং এ সঙ্গে পীড়া, অক্ষমতা, বৈধব্য, বার্ধক্য অথবা জীবনযাপনে অনিবার্যকারণে সংঘটিত অন্যান্য অপারগতার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং বেকার হলে নিরাপত্তার অধিকার সহ নিজের এবং নিজ পরিবারের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবনমানের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
২. মাতৃত্ব এবং শৈশবাবস্থায় প্রতিটি নারী এবং শিশুর বিশেষ যত্ন এবং সাহায্য লাভের অধিকার আছে। বিবাহবন্ধন-বহির্ভূত কিংবা বিবাহবন্ধনজাত সকল শিশু অভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করবে।
ধারা ২৬ :
১. প্রত্যেকেরই শিক্ষালাভের অধিকার রয়েছে। অন্ততঃপক্ষে প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে লভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সকলের জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে।
২. ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ এবং মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা-সমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে শিক্ষা পরিচালিত হবে। শিক্ষা সকল জাতি, গোত্র এবং ধর্মের মধ্যে সমঝোতা, সহিষ্ণুতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস পাবে এবং শান্তিরক্ষার স্বার্থে জাতিসংঘের কার্যাবলীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
৩. কোন ধরনের শিক্ষা সন্তানকে দেওয়া হবে, তা বেছে নেবার পূর্বাধিকার পিতামাতার থাকবে।
ধারা ২৭ :
১. প্রত্যেকেরই সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণ করা, শিল্পকলা উপভোগ করা এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও তার সুফল সমূহে অংশীদার হওয়ার অধিকার রয়েছে।
২. বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলা ভিত্তিক কোন কর্মের রচয়িতা হিসেবে নৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থ সংরক্ষণের অধিকার প্রত্যেকেরই থাকবে।
ধারা ২৮ :
এ ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহের বাস্তবায়ন সম্ভব এমন একটি সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অংশীদারীত্বের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে।
ধারা ২৯ :
১. প্রত্যেকেরই সে সমাজের প্রতি পালনীয় কর্তব্য রয়েছে, যে সমাজেই কেবল তাঁর আপন ব্যক্তিত্বের স্বাধীন এবং পূর্ণ বিকাশ সম্ভব।
২. আপন স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহ ভোগ করার সময় প্রত্যেকেই কেবলমাত্র ঐ ধরনের সীমাবদ্ধতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন যা অন্যদের অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ নিশ্চিত করা এবং একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নৈতিকতা, গণশৃংখলা ও সাধারণ কল্যাণের ন্যায়ানুগ প্রয়োজন মেটাবার জন্য আইন দ্বারা নির্ণীত হবে।
৩. জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ও মূলনীতির পরিপন্থী কোন উপায়ে এ অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ ভোগ করা যাবে না।
ধারা ৩০ :
কোন রাষ্ট্র, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি এ ঘোষণাপত্রের কোন কিছুকেই এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, যার বলে তারা এই ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ নস্যাত্ করতে পারে এমন কোন কাজে লিপ্ত হতে পারেন কিংবা সে ধরনের কোন কাজ সম্পাদন করতে পারেন।
পাগল মহর আলী বাঙালির মানবতাধর্মে সৃষ্টিতত্ত্ব:
বাঙালি (এক), ধর্ম মানবতায়- আত্মা, জগত ও জীবের সৃষ্টি সম্পর্কে…
আত্মা :
বাঙালি মানবতা ধর্মে আত্মা বলতে আচরণ বা সংস্কৃতি। লোকায়ত চিন্তা জগদ্বিষয়ক যৌক্তিক মানুষদের সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক অনুভূতি। এর পেছনে অন্য কোন শক্তি বা সত্তার হাত নেই। পরলোক, পরপার, স্বর্গ, নরক, আত্মা এসব নিছক কল্পনা মাত্র। দেহ ও আত্মার মাঝে অহেতুক এক ভেদরেখা টানা হয়েছে। আত্মা মানুষের সচেতন কর্মকান্ডের সমন্বিত ফলাফল। অজড়, অনিত্য, শাশ্বত আত্মা বলতে আমরা যাকে চিন্তা করি তা সবৈব কল্পনা নির্ভর অনুমান মাত্র। ফকির লালন সাঁইয়ে অন্যতম শিষ্য দুদ্দু শা ‘র মুখে এই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়-
‘ বস্তুকেই আত্মা বলা যায়
আত্মা কোন আলৌকিক বস্তু নয়।
বিভিন্ন বস্তুর সমন্বয়ে/ আত্মার বিকাশ হয়ে।
জীবন রূপেতে সে জীবেতে রয়।
অসীম শক্তি তার
যে তাহার করে সমাচার/
সাধিয়া ভবের কারবার বস্তুতে যার লয়।’
প্রথম বাঙালি কপিল এর সৃষ্টিতত্ত্ব…
বাঙালির সৃষ্টির ব্যাখ্যায় সাংখ্যদর্শন বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন ভাবদর্শন। সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা কপিল- এর জন্ম এই বাংলায়। বিশ্বের প্রথম মানবতাবদী দার্শনিকটির নাম কপিল। বিশ্বজগতের উদ্ভব কী ভাবে হল কপিল তার নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কপিল বলেন, কোনও কার্য উদ্ভবের আগেই তার কারণে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। পরে ব্যক্ত হয় মাত্র, নতুন আরম্ভ হয় না। এই দৃশ্যমান বিশ্বজগৎ স্থূল। এর কারণ সূক্ষ্ম হতে পারে না। এই যুক্তিতে কপিল কেবল ঈশ্বর নয়- জগতের মূলে পরমাণুর অস্তিত্বও অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে জগতের মূল হল প্রকৃতি। এবং প্রকৃতির মূল হল শূন্য। কপিল এই জন্য প্রকৃতিকে ‘অমূল -মূল’ বলেছেন। তার মানে প্রকৃতির মূল শূন্য। অন্যদিকে কপিল দর্শনের মূলকথা হলো:” যার জন্মও হয় না, মৃত্যুও হয় না, যে অগ্নিতে দ্বগ্ধ হয় না, অস্ত্রেতে আহত হয় না, সেই অবিনাশী আত্মাকে জানলে আর দুঃখ থাকে না।”
কপিল সংসারে মানুষকে দুঃখ ভোগ করতে দেখেছেন। একই সঙ্গে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় ভেবেছেন। কপিল লক্ষ্য করেছেন যে- মানুষ সংসারে ত্রিবিধ দুঃখ ভোগ করে। (এক) আধ্যাত্মিক (দুই) আধিভৌতিক এবং (তিন) আধিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ হল: কাম, ক্রোধ , লোভ -এসব রিপুতে তাড়িত হলে যে দুঃখ সেটি। মানব, পশু, পাখি, সরীসৃপ এবং জড়বস্তু থেকে যে দুঃখ পায় কপিল তাকে আধিভৌতিক দুঃখ বলেছেন। এবং আধিদৈবিক দুঃখ হল ভূকম্পন, বন্যা বা অপ্রাকৃত শক্তি ইত্যাদি। কপিল চিন্তাশীল বলেই প্রশ্ন করেছেন: কিন্তু, কে দুঃখ ভোগ করে? কেন মানুষ দুঃখ ভোগ করে। কেননা, সুখ কিংবা দুঃখের অনুভূতি হয় মানবদেহে। এই উত্তরের সঙ্গে কপিল একমত নন। কেননা, কপিল মনে করেন যে, ‘যে দুঃখ ভোগ করে, সে স্বতন্ত্র। সেই তুমি। তোমার দেহ তুমি নহে। যে সুখদুঃখ ভোগ করে সেই আত্মা। সে হল পুরুষ। পুরুষ ছাড়া জগতে আর যা যা আছে সে হল প্রকৃতি। দেহ প্রকৃতি বলে প্রকৃতি দুঃখভোগ করে না। দুঃখভোগ করে পুরুষ।’ কেন? কেন পুরুষ দুঃখভোগ করে ? কপিল বলছেন যে, ‘প্রকৃতির সহিত সংযোগই পুরুষের দুঃখের কারণ।’ এর মানে কী? এর মানে হল প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংযোগ হলে বিশ্বের উদ্ভব হয়- সেই সঙ্গে দুঃখেরও উদ্ভব হয়।
বাঙালিধর্মে আধুনিক বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্ব
জগত সৃষ্টি ও প্রাণের উদ্ভব:
১৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাংয়ের সংঘটন। এর মাধ্যমে বস্তু ও শক্তি অস্তিত্ব লাভ করে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির একদম শুরু।
৯ বিলিয়ন বছর আগে: জন্ম লাভ করে আমাদের সৌরজগৎ। কয়েক আলোকবর্ষ ব্যাপী বিস্তৃত মহাজাগতিক মেঘ (Interstellar Cloud) মহাকর্ষের টানে পরস্পর একত্রিত হয়ে সৌরজগৎ গঠন করে। যে অংশটিতে সবচেয়ে বেশি পদার্থ জমা হয়েছিল সেটি বর্তমানে সূর্য। সূর্যে পদার্থ জমতে জমতে এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে সেখানে অকল্পনীয় চাপ তৈরি হয়েছিল। এই চাপে উত্তপ্ত হয়ে হাইড্রোজন পরমাণুগুলো ফিউশন বিক্রিয়া শুরু করে, এক হাইড্রোজেন ঢুকে যায় আরেক হাইড্রোজেনের ভেতর। এই ঘটনায় প্রবল তাপ ও আলোক শক্তি বিকিরিত হয়। ফলে জ্বলে উঠে সূর্য, আলো দিতে থাকে চারদিকে।
৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে: পৃথিবীর জন্ম। সূর্য যখন জন্ম হচ্ছিল তখন তার পাশাপাশি গ্রহ-উপগ্রহও বিকশিত হচ্ছিল। সূর্য থেকে দূরে আলাদা আলাদা করে প্রত্যেকের মধ্যে পদার্থ জমতে থাকে এবং প্রত্যেকের আলাদা আলাদা প্রভাব বলয় তৈরি হয়। এই প্রভাবে পার্শ্ববর্তী উপগ্রহগুলো গ্রহদেরকে কেন্দ্র আবর্তন করতে থাকে, সূর্যকে কেন্দ্র করে নয়।
৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে: প্রথম প্রাণের উৎপত্তি এবং জীববিজ্ঞানের জন্ম। শুরুতে পৃথিবী অনেক উত্তপ্ত ছিল। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে উপরিভাগটা শীতল হয়ে আসে (পৃথিবীর ভেতরভাগটা এখনো আগুনের মতো গরম)। পানি ও বরফবাহী প্রচুর ধূমকেতু এসে আছড়ে পড়ে এবং সাগর ও মহাসাগরের জন্ম হয়। পানির উপস্থিতিতে প্রাণের উৎপত্তির জন্য বেশ অনুকূল একটা পরিবেশ তৈরি হয়। পানি, জৈব রাসায়নিক উপাদান, বিদ্যুৎ (বিজলি) যদি উপযুক্ত তাপ ও উপযুক্ত চাপে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে তাহলে সেখানে প্রাথমিক স্তরের আদি প্রাণ তৈরি হতে পারে। এ নিয়ে স্ট্যানলি মিলারের বিখ্যাত একটি পরীক্ষা আছে।
৩.৫ বিলিয়ন বছর আগে: পৃথিবীতে অক্সিজেনের যোগান। একধরনের সায়ানোব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ছাড়া শুরু করেছিল। প্রাণের জন্ম হয়েছিল সমুদ্রে, বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ছিল না। ঢেউয়ের মাধ্যমে কিছু ব্যাকটেরিয়া ডাঙ্গায় উঠে এবং সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ সম্পন্ন করে।
২.৫ মিলিয়ন বছর আগে: হোমো গণের উৎপত্তি। মানুষ এবং মানুষের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের প্রাণীগুলো এই গণের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের মতো দেখতে হোমো ইরেক্টাস এবং হোমো নিয়ান্ডার্থাল এই গোত্রেরই সদস্য। এই সময়েই প্রথম পাথর দিয়ে হাতিয়ার ব্যবহার শুরু হয়।
২ মিলিয়ন বছর আগে: মানুষের আদিম আত্মীয়রা আফ্রিকা থেকে ছড়িয়ে ইউরোপ ও এশিয়ায় বসবাস করতে শুরু করে। আলাদা আলাদা এলাকা, এক গোত্র থেকে আরেক গোত্র বিচ্ছিন্ন। কোনো প্রাণীর গঠন, বৈশিষ্ট্য, আচার, আচরণ কেমন হবে তা নির্ভর করে পরিবেশের উপর। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ থাকার কারণে তাদের গঠন বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন হতে থাকে।
৫ লক্ষ বছর আগে: ইউরোপ ও মধ্য প্রাচ্যে নিয়ান্ডার্থালরা বিস্তৃত হতে থাকে।
৩ লক্ষ বছর আগে: দৈনন্দিন কাজে আগুনের ব্যবহার শুরু হয়।
২ লক্ষ বছর আগে: আধুনিক মানুষেরা পূর্ব আফ্রিকায় বিস্তৃতি লাভ করে।
৭০ হাজার বছর আগে: জ্ঞানের বিপ্লব। ভাষার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। তখন থেকে ইতিহাসের জন্ম। এই সময়কালের মধ্যে আধুনিক মানুষেরা আফ্রিকা ছাড়িয়ে বাইরের দিকে বিস্তৃত হতে থাকে।
৪৫ হাজার বছর আগে: মানুষেরা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে পৌঁছায়। মানুষের প্রভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় সেখানকার অনেক প্রাণী।
৩০ হাজার বছর আগে: বিলুপ্তি ঘটে নিয়ান্ডার্থালদের। মানুষেরাই ধরে ধরে তাদেরকে মেরে মেরে শেষ করে ফেলে।
১৬ হাজার বছর আগে: আমেরিকায় পৌঁছায় মানুষ। বিলুপ্ত হয়ে যায় সেখানকার অনেক প্রাণী প্রজাতি।
১৩ হাজার বছর আগে: মানুষ (Homo sapiens) বাদে হোমো গণের সকল প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১২ হাজার বছর আগে: কৃষির বিপ্লব ঘটে। এর আগে মানুষ যাযাবর ছিল। খাবারের সন্ধানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। যেখানে খাবার পেতো সেখানে যেতো। একসময় খেয়াল করলো খাবারের গাছ ও খাবারের প্রাণীগুলোকে চাষ-বাস কিংবা লালন-পালন করা সম্ভব। এতে অনিশ্চিত বিপদসঙ্কুল পথে ভ্রমণ করতে হয় না, জীবনের নিরাপত্তা থাকে। সেখান থেকে জন্ম নেয় কোথায় স্থায়ী হয়ে থাকার রীতি।
৫ হাজার বছর আগে: হস্তলিপি ব্যবহারের মাধ্যমে লেখালেখির শুরু। এই সময়কালে বহুশ্বরবাদ বিকাশ লাভ করতে থাকে।
৪ হাজার ২৫০ বছর আগে: আক্কাদীয় সাম্রাজ্যের উত্থান।
২ হাজার ৫০০ বছর আগে: মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন।
২ হাজার বছর আগে: চীনে হান সাম্রাজ্যের বিস্তার। একই সময়ে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার। এই সময়কালে খ্রিস্টবাদের প্রচলন শুরু হয়।
১৪০০ বছর আগে: ইসলামের উত্থান।
৫০০ বছর আগে: বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনা। ইউরোপীয়রা আমেরিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ গড়তে শুরু করে। সমুদ্রপথে চলাচলের রাজত্ব চলে আসে তাদের হাতে।
২০০ বছর আগে: শিল্প বিপ্লবের সূচনা। বিজ্ঞানের বিপ্লবের কারণে একে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি হতে থাকে। যে কাজ আগে মানুষ করতো সে কাজ করানো হতে থাকে যন্ত্রের সাহায্যে। যে কাজ মানুষের দ্বারা সম্ভব হতো না সে কাজও করতে থাকে যন্ত্র। শিল্প বিপ্লবের ফলে নগর ও বাজারের প্রসার হতে থাকে। সমান্তরালে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্ত হতে থাকে।
বর্তমান: সমগ্র পৃথিবী জয় করে ফেলেছে মানুষ। পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রান্ত, সমুদ্রের গভীর তলায়, মহাকাশের সু-উচ্চ শিখরে মানুষের পদাচারণা। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাঁচানোর মতো প্রতিষেধক লক্ষ লক্ষ মানুষ মারার মতো অস্ত্র মানুষের হাতের নাগালে।
১৯১৪ সাল: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো এতে অংশগ্রহণ করে। দুই যুদ্ধে বিশেষ করে দুই যুদ্ধে এমন ক্ষয়ক্ষতি হয় যে পৃথিবীর সব দেশে তার প্রভাব পড়ে। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেটি এই যুদ্ধের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
১৯৪৭ সাল: ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়ে যায় এবং ভারতবর্ষকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ভাগে ভাগ করে যায়। পাকিস্তান অংশে দুটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড পড়ে। একটি পূর্ব অংশ আরেকটি পশ্চিম অংশ।
১৯৭১ সাল: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিরোধের জের ধরে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের নিয়ন্ত্রণ থেকে পূর্ব অংশ স্বাধীন হয়ে যায়। এর জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছে। ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এই সময়কালে।
১৯৭৫ সাল: রাজনৈতিক বিরোধ ও আভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। এর তিন মাস পরেই আরেকটি অভ্যুত্থানের সংঘটন এবং তার তিন দিন পর আরো একটি অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। এই তিন মাসের রাজনৈতিক ঘটনাবলী প্রভাব রাখে বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতিতে।
বাঙালির মানবতারধর্মে জন্ম-মৃত্য-বিয়ে বিধিবিধান…
বিয়ের রীতিনীতি
বাঙালির মানবতাধর্মে বিয়ের রীতিনীতি প্রাচীনবাংলার সংস্কৃতির অনুরূপ। এই ধর্মে প্রাপ্তবয়স্ক যে কোন ধর্মের ছেলে মেয়ে, বাঙালি ধর্ম মানবতায় অনুসারী হলেই তার পূর্বের সাম্প্রদায়িক ধর্মসমুহ বিলুপ্ত হবে, সে বাঙালি হবে। বাঙালির মানবতার ধর্ম অনুযায়ী তাদের বিয়ে হবে। বাঙালিধর্মে তারা যে ঋতুতে বিয়ে করবে সেই ঋতুর সুন্দর ও সুগন্ধী ফুলের মালা একে অপরের গলায় পরিয়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করবে। তারপর গুরুর আশির্বাদ নিয়ে বিয়ে করবে। ওরা মুক্ত স্বাধীন জীবন যাপন করবে। এই বিয়েতে কোন প্রকারের যৌতুক কিংবা পণপ্রথা থাকবেনা। এই বিয়েতে কোন মোহরানাও থাকবেনা। তালাক হলে সন্তানের ভরন পোষণের জন্য উভয়ে সমান দায়িত্বও ব্যয় বহন করবে। এখানে বিয়ের জন্য বাঙালির প্রাচীন ঐতিজ্য মানা হবে।
তবে বাঙালিধর্মের অনুসারীদের জন্য বিয়ের জন্য আলাদা আইন থাকা উচিত। তবে পাগল মহর আলী বাঙালির মানবতাধর্ম – অসাম্প্রদায়িক, আন্তধর্ম, সম্প্রীতির বিয়েকে (‘বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২’) কে সমর্থন করে। এ ধরনের বিয়েতে স্বামী স্ত্রীর আলাদা ধর্মের হলেও একসাথে সংসার করে। এটা বাঙালিধর্মের আদর্শের সাথে মিলে।
জন্ম : নতুন শিশু জন্ম নিলে জন্মতীর্থে সবাই বলবে-
বাঙালির জয় হোক,
এই শিশুর জয় হোক
তার জীবন অসাম্প্রায়িক চেতনায় গড়ে উঠুক
জয় হোক মানুষের
ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের’।
সাথে আরও বলবে…
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ
নতুন শিশুর নাম বাঙলা অভিধান হতে খাঁটি বাঙলা শব্দ নির্বাচন করে রাখবে। নামের শব্দের অর্থ অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। নামের প্রথমে বা শেষে বাঙালি শব্দ থাকবে।
মৃত্যু : কারো মৃত্যু হলে সবাই একসাথে বলবে…
জয় মুক্তির জয়
জয় বাঙালির জয়,
জয় সত্যের জয়
জয় মানবতার জয়
জয় বাঙলা মায়ের ভাষার জয়
জয় (মৃত ব্যক্তির নাম) জয়
জয় মহর আলি বাঙালির জয়
মৃতব্যক্তির শবযাত্রায় সবাই একসাথে নিয়ে যাবে, হাটবে, আর গাইবে
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে॥
দেহ মনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে,
গানের সুরে আমার মুক্তি উর্ধ্বে ভাসে॥
আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
দুঃখ বিপদ তুচ্ছ করা কঠিন কাজে।
বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা, আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা
জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি আশে॥
শবযাত্রা কবরের কাছে এসে থামলে বাঙালি ধর্মের গুরু সবাইকে নিয়ে পুনরায় বলবে…
জয় মুক্তির জয়
জয় বাঙালির জয়,
জয় সত্যের জয়
জয় মানবতার জয়
জয় বাঙলা মায়ের ভাষার জয়
জয় (মৃত ব্যক্তির নাম) জয়
জয় মহর আলি বাঙালির জয়
তারপর ভাষা শহীদসহ ৩০লক্ষ শহীদের জন্য ০১মি. নিরবতা পালন করবে। তারপর জাতীয় সংগীত গাইবে। তারপর মহর আলি বাঙালি বলেন, মৃতব্যক্তিকে দক্ষিণদিকে মাথা ও উত্তরদিকে পা রেখে কবরে শোয়াবে। অন্য আরেকটি রীতিতে মাটি দেওয়ার কথা বলেছিলোন মহর আলি- যেমন- শিশু যেভাবে মায়ের পেটে থাকে সেভাবে বসিয়ে মাটি দিবে। তারপর মাটি দেওয়ার সময় গাইবে
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ॥
তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে,
তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,
তোমার ওই শ্যামলবরন কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা ॥
ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে।।
তোমার ‘পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে সকল-সহা সকল-বহা মাতার মাতা ॥
ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা–
তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!
আমার জনম গেল বৃথা কাজে,
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে–
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা ॥
বাঙালিধর্মে দেহদান
বাঙালিধর্মের আরেকটি মহান ব্রত হলো মানবতার কল্যাণে নিজ দেহের রক্তদান, চক্ষুদান, অঙ্গদান ও দেহদান। এর ফলে যদি একটি মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়, কিডনি দান করলে যদি একটি মানুষের জীবন রক্ষা পায়, কিংবা দেহ দান করলে যদি চিকিৎসকরা চিকিৎসা বিদ্যার জ্ঞান পান তাহলে সেটাই মানবতার মহান উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই অঙ্গদান, দেহদান- এই মহান মানবধর্মের পরম লক্ষ্য। যেখানে মৃত্যুর পরও নিজে চোখ অন্যের চোখ দিয়ে দেখবে, নিজের দেহ অন্যের দেহে বেঁচে থাকবে। নিজে অমরত্ব লাভ করবে অন্যের মাঝে।
এ ধর্মে মৃতব্যক্তি নিয়ে কোন সাম্প্রদায়িক যাগযজ্ঞ, দোয়া-মিলাদ- অনুষ্ঠান হয় না। প্রতিবছর তার মৃতের কৃতকর্মের উপর আলোচনা, লোকজ মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মৃত্যু দিবস পালন হয়।
এই ধর্মের কয়েকটি উৎসব
পহেলা বৈশাখ(১৪ এপ্রিল)। ২১শে ফেব্রুয়ারীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস । শোক দিবস হিসেবে তারা – বঙ্গভঙ্গের দিন(১৯০৫ সালের এবং ১৯৪৭সালে বাংলা ভাগ) এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৫ই আগস্ট পালন করে। এছাড়া ১৯ আগস্ট বিশ্ব মানবতা দিবস। ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস। ১৭ মার্চ- বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস। ০৯ ডিসেম্বর (রাত ০৮টা ০১ মিনিটে) পাগল মহর আলী বাঙালীর স্মরণোৎসব। ১৭ অক্টোবর- লালন স্মরণোৎসব। ০৭ মে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। ২৫ মে কাজীনজরুল ইসলামের জন্মদিন। ২১ ডিসেম্বর হাসন রাজার জন্মদিন। ২১ ফেব্রুয়ারী- ভাষা দিবস। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। ১৪ ডিসেম্বর বাঙালী বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। ১৬ অক্টোবর প্রথম বঙ্গভঙ্গ(শোক দিবস)। ১৪ আগস্ট বঙ্গভঙ্গ- পাকিস্থানের জন্মদিন(শোক দিবস)। ০৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। ০৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস। ১৩ জুন ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবসসহ আরো কিছু দিবস।
বাঙলা বর্ষপঞ্জিকা
বাঙালিধর্মের অনুসারীরা লোকনাথের বাংলা পঞ্জিকা ব্যবহারের পক্ষপাতী। তারা পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলার জন্য অভিন্ন একটি বাংলা পঞ্জিকা দাবি করেন। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে, স্কুল-কলেজে, আদালতে সন, তারিখ বাংলায় চালু করার দাবি জানান এবং সকল স্তরে মাতৃভাষা চালুর দাবি করেন।
বাঙালিধর্মের পবিত্র দিন
বাঙালি (১) ধর্ম মানবতা তথা বাঙালিধর্মের পবিত্র দিন হল- শনিবার। শনিবার হলো- গুরুবার। এদিন তারা ছুটিতে থাকবেন এবং গুরুর নির্দেশিত নিজের মোক্ষ অর্জন করবেন। এই দিন লোক ক্রীড়া, বাঙালির গার্হস্থ উপকরণ, গার্হস্থ্যশিল্প, হস্তশিল্প মেলা, বাঙালি খাবার ও হাজার বছরের বাঙালির পোষাক প্রদর্শন করবে।
বর্তমানে, বাঙালি (১), ধর্ম মানবতাতত্ত্বে বিশ্বাসী বাঙালীধর্ম অনুসারীদে সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এদের বেশির ভাগই জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য এর প্রচার, প্রসার ও সাফল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
লেখক : জাকির হোসেন। সব ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করেছে বাঙালিধর্মের সংগঠন “বাঙালি সংগঠন” জামালপুর। কৃতজ্ঞতা- পাগল মহর আলী বাঙালির কনিষ্ট কন্যা মমতাজ(মম) এবং ভক্ত খোকন বাঙালি।