নির্বাচনী জোটে এনসিপির লাভ-ক্ষতি

প্রকাশ : 2025-12-28 15:49:25১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

নির্বাচনী জোটে এনসিপির লাভ-ক্ষতি

স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্ব রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাচন হয়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় বৈধ এজেন্সি তৈরির একমাত্র মাধ্যম। কিছু ব্যতিক্রম বাদে তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রকামী রাষ্ট্রগুলো প্রায়ই সাময়িক বা অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য অনির্বাচিত সরকার, সেনাশাসন কিংবা সিভিল কর্তৃত্ববাদী সরকারের হাতে চলে যায়। এর ফলে কেবল রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাই ব্যাহত হয় না, রাজনৈতিক নেতৃত্বে দেখা দেয় আত্মবিশ্বাসের সংকট। নির্বাচনের আগে আগে কেবল নির্বাচনী সুবিধা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দলীয় আদর্শ আপস করে ‘জোট’ বাঁধা এই আত্মবিশ্বাসহীনতার লক্ষণ। 

অবশ্য কোনো সরকারের মধ্যে যখন স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দেখা দেয় কিংবা সামরিক শাসন চলতে থাকে, তখন সরকারের বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর জোটবদ্ধ আন্দোলন আত্মবিশ্বাসহীনতা নয়; বরং কৌশলগত ঐক্যের জন্য প্রয়োজনীয়। একই সঙ্গে অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনের অনেক আগে থেকে জোটও দোষণীয় নয়। 

এ ক্ষেত্রে ১৯৫৩ সালে পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট খুব ভালো উদাহরণ। এই জোটের প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগকে পরাজিত করে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আদর্শিকভাবে এই জোটের সাফল্য ছিল সুদূরপ্রসারী ও স্থায়ী। ১৯৫২ সালের সফল ভাষা আন্দোলনের পরপরই এই জোট গঠন এবং এর কাঙ্ক্ষিত বিজয় নিঃসন্দেহে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের শক্ত গাঁথুনি হিসেবেই ইতিহাসে পাঠ হয়ে আসছে। যুক্তফ্রন্ট ছিল মূলত ক্ষমতার অপব্যবহার ও অভ্যন্তরীণ উপনিবেশায়নের বিরুদ্ধে অধিকারভিত্তিক গণমুক্তির জোট। যুক্তফ্রন্টের প্রতিবাদী চরিত্র একে কেবল ভোটের কৌশলে সীমাবদ্ধ রাখেনি; বরং তা নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসমর্থন সৃষ্টি করেছিল।

এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকের সামরিক শাসনবিরোধী তিন জোটের সমন্বিত আন্দোলনই ছিল অত্যাবশ্যক, যা দীর্ঘ ৯ বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঘোষিত জোট দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটায়।
এসব ঐতিহাসিক ঘটনা প্রমাণ করে, যখন ক্ষমতালিপ্সু সামরিক ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিগ্রহণ করে কিংবা কোনো সিভিল সরকার কর্তৃত্ববাদী রূপ ধারণ করে গণআকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে তখন সময়ের প্রয়োজনেই সংগঠিত জোটভিত্তিক আন্দোলন সেই স্বৈরাচারী শাসকের উৎখাতের উত্তম কার্যকর উপায় হয়ে ওঠে। অর্থাৎ গণঐক্য ও সংগঠিত প্রতিরোধ সময়ের প্রয়োজনে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, যা কার্যকর শক্তি হিসেবেই উদ্ভব হয়।

কিন্তু গণতান্ত্রিক ও দায়বদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ার বদলে কেবল ভোট সংকলনকে কেন্দ্র করে হিসাব-নিকাশের ক্ষতিকর দিকগুলো বারবার প্রমাণ করেছে। এই চর্চার মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে অপেক্ষাকৃত ছোট সম্ভাবনাময় দলগুলো নিজেদের সৃষ্ট ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় ছোট দলগুলো নিজস্ব নির্বাচনী দলীয় প্রতীক বিসর্জন দেয় কেবল নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে। তবে সাম্প্রতিক উচ্চ আদালতের একটি রায়ের আলোকে বলা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধ হলেও প্রতিটি দলকে নিজ নিজ রাজনৈতিক প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে, যা এ ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রশংসনীয় অগ্রগতি।

বাংলাদেশে জোটভিত্তিক আন্দোলনের সুফল থাকলেও নির্বাচনের আগে কেবল সুবিধাভিত্তিক জোটের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিই বেশি। জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াত বা আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি জোটগুলো মূলত নির্বাচনমুখী স্বার্থভিত্তিক গড়ে উঠেছিল, যার ফলে এই দুই দলের বাইরে এসে বৃহৎ কোনো দলের আবির্ভাব হয়নি। অধিকন্তু, এ দুটি দলকে অনেক সময় অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এদের শরিক দলগুলো। এ ক্ষেত্রে জোটগুলোর চরিত্র হয় অস্থায়ী, উদ্দেশ্যনির্ভর এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরিবর্তে পরিচালিত হয় ভোটকেন্দ্রিক হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে। এই ধরনের জোট-রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো একে অন্যকে দ্রুতই একই খাঁচার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে; শুরু হয় ‘ট্যাগিং’। এর ফলে রাজনীতিতে পারস্পরিক বিষোদ্গার ও প্রতিহিংসা বাড়ে, এমনকি জিঘাংসাও তীব্র হয়; পাশাপাশি ভোটের বাইরে থাকা নীতিনির্ধারণী সংলাপ, আন্দোলনের বৈচিত্র্য ও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের সম্ভাবনাও ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে।

উদাহরণ হিসেবে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার কারণে দলটির দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপিকেও বিরোধী শিবির থেকে নানা ‘তকমা’ আরোপ করা হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধার দল হয়েও বিএনপিকে জামায়াতকেন্দ্রিক নেতিবাচক বয়ানের অংশীদার হতে হয়েছে। অথচ পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় বর্তমানে এই দুই দল প্রায়ই সরাসরি সংঘর্ষে পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ছে আদর্শিক অবস্থানের নামে। 

আদর্শিক নৈকট্যের বদলে শুধু নির্বাচনী সুবিধার জন্য বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট অপেক্ষাকৃত ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আত্মঘাতীও হতে পারে। যেমন আওয়ামী লীগের পতনের পর জাতীয় পার্টির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে তুলতে কষ্ট হচ্ছে।

এসব উদাহরণ সামনে থাকা সত্ত্বেও জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতায় তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) সম্ভবত একই ভুল করতে যাচ্ছে। নানা সমালোচনার মধ্যেও দলটি যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, সাময়িক নির্বাচনী সুবিধার জন্য জোটের রাজনীতিতে যেতে গিয়ে সেই সম্ভাবনা সম্ভবত অংকুরেই বিনষ্ট হতে যাচ্ছে। 
ক্ষণস্থায়ী লাভ কিংবা অজানা ভয় থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় যে কোনো বৃহৎ দলের সঙ্গে জোট গঠন এনসিপির বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে সমস্যায় পরিণত করার আশঙ্কাই বেশি; তা হোক বিএনপি কিংবা জামায়াতের সঙ্গে। এতে হতাশ হবে তরুণদের একটি বড় অংশ। হতাশ হবে সেই সামাজিক শক্তি, যারা আওয়ামী লীগ-বিএনপির পরিবারতন্ত্রের বাইরে বিকল্প খুঁজছে। 

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এনসিপির জোটের গুঞ্জন সত্য হলে ঝুঁকি আরও গভীর। জামায়াত নিজেই অন্তত দুই ধরনের স্বচ্ছতাভিত্তিক পরিচয় সংকটের কারণে জনপরিসরে হিমশিম খায়; প্রথমত, ধর্মীয় আকিদাগত বিভাজনের কারণে অপরাপর ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে; দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধকালে ভূমিকার কারণে। ধর্মভিত্তিক বিতর্ক ও মুক্তিযুদ্ধের ট্যাগিং মিলিয়ে দলটির সঙ্গে জোট গঠনে এনসিপির বিকাশ যে বাধাগ্রস্ত হবে, সহজেই অনুমেয়। এনসিপির জন্য এই জোট বুমেরাং হয়ে জামায়াতের সঙ্গে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। বড় দলের সঙ্গে ছোট সম্ভাবনাময় দলের নির্বাচনী জোট নেতৃত্ব ও আদর্শ বিকাশের অন্তরায়। এনসিপি তার নিজস্ব ইশতেহার, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভোটারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ হারাতে পারে। বাস্তবে বড় দলই রাজনীতির ফ্রেম নির্ধারণ করে। ফলে দলীয় সমর্থক ও ভোটারের মতামত উপেক্ষিত হয়, এলিট সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং তৃণমূলে শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠে না। দীর্ঘ মেয়াদে রাজনীতি দ্বিদলীয় কাঠামোয় আবদ্ধ থাকে, নতুন রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের সম্ভাবনা সংকুচিত হয়, যা গণতন্ত্রের মৌলিক স্পৃহাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এসব কারণে গণতান্ত্রিক রূপান্তর বারবার ব্যাহত হয় এবং অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে জোটভিত্তিক আন্দোলনও শক্তি হারায়। 

প্রশ্ন উঠতে পারে, বিকল্প পথ কী? বিকল্প পথ হলো, নির্বাচনকেন্দ্রিকভাবে কাছাকাছি আদর্শের ছোট দলগুলোর মধ্যে জোট গড়ে তোলা, যার লক্ষ্যই হবে দ্বিদলীয় বাইনারির বাইরে একটি গ্রহণযোগ্য তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির উত্থান। একই সঙ্গে বড় দলগুলোর নেতিবাচক চর্চা সম্পর্কে জনপরিসরে সচেতনতা তৈরি করা। এভাবেই সম্ভাবনাময় এনসিপিসহ ছোট দলগুলো দায়বদ্ধ, স্বচ্ছ ও নীতিভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিকশিত হয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দলে রূপ নেওয়ার সুযোগ পেতে পারে।

অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: চেয়ারম্যান, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে - সমকাল