ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কাক-জ্যোৎস্নায় কাক-ভোর
প্রকাশ : 2021-08-20 10:10:35১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
শাশ্বত স্বপন
---------------------
(পর্ব-২)
পূর্ব প্রকাশিতের পর
অস্তায়মান গোধূলীর সূর্য্যটা দিগন্তে মিশে গেছে। তবে পশ্চিমাকাশে সূর্যের রক্তিম আভা তখনও শ্মশানের শেষ অগ্নির মত জ্বলছে। ঠাকুর বাড়ির ভিতরে ও বাহিরে ধীরে ধীরে প্রকৃতি তার নিরবতার গান শুনিয়ে যাচ্ছে । পুরনো ধ্বংশায়মান দালানের ছাদ ফুঁড়ে বিশাল বট আর পাকুর গাছ বিজয়ের গান গেয়ে চলেছে আর হারিয়ে যাওয়া করুণ স্মৃতি নিয়ে, ভগ্ন দালান আকাশ পানে চেয়ে আছে; মনে হয়, অতীতের গল্প আকাশকে শুনাচ্ছে; যেন, ইথারে ইথারে সে গল্প ছড়িয়ে যায়, সবখানে। নাম না জানা কোন পাখি হয়তো বট, পাকুরের পাকা ফল খেয়ে ছাদের কার্নিশে বসে আনমনে মলত্যাগ করেছিল। কার্নিশকে আশ্রয় করে সেই কবে এই বট আর পাকুর গাছ জন্মেছিল--কেউ তা বলতে পারে না। শুরুতে কার্নিশ বট-পাকুরকে আশ্রয় দিয়েছিল, তারপর পুরো দালানই তাদের বুকে আগলে রেখেছিল। বুকের মধ্যে পরম ভালোবাসায় আঁকড়ে থাকা মাকড়সার ডিমগুলো ফুটে সদ্যজাত বাচ্চারা যেমন মায়ের বুক খেতে শুরু করে, তারপর পুরো দেহ, ঠিক তেমনি সেই কবেকার ছোট ছোট চারা বট-পাকুর মাতৃস্বরূপ দালানকে ধরে চলতে শুরু করেছিল, বড় হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে পুরো দালানে হেঁটে বেড়িয়েছিল, সেই সাথে ছাদ আর দেয়ালগুলোর ফাটল ধরিয়ে দালানকে অকাল মুত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এখন বট-পাকুর গাছ দালানসহ দেয়ালগুলোকে আষ্টে-পিষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, যাতে ভেঙ্গে-চুঁড়ে পড়ে না যায়। মনে হচ্ছে, বট-পাকুর গাছ অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।
এই বাড়ির বয়স্ক এক ব্রাক্ষণ, যার মৃত্যু হয়েছিল একশত চার বছর বয়সে, তিনি বলেছিলেন, তাঁর ঠাকুর দাদা ছোটবেলায় গল্প করে বলেছিল, এই তিনতলা দালানের কোন পাশে দুই/তিনটা খেজুর গাছ ছিল, কোন একটা গাছ নাকি পুরুষ ছিল, সেই গাছের আগায় পরগাছা জন্মেছিল। সেই গাছে খেজুর হতো না, শীতকাল তার মোটা শিকড়ে কিছু পুরনো ইট রাখা ছিল। দালান বানানোর পর অতিরিক্ত সেই ইটের মধ্যে, নাকি খেজুর গাছের গোড়াতে, এই বট আর পাকুর জন্মেছিল--তা কেউ সঠিক জানে না। বট, পাকুর বড় হবার পর খেজুর গাছ মরে যায়। পরিত্যক্ত ইটের মধ্যে, দালান ঘেঁষা খেজুর গাছে , দালানের কার্ণিশে –কোথায় জন্মেছিল, কোনটা আগে জন্মেছিল--বট নাকি পাকুর, নাকি বট গাছ বড় হবার পর পাকুর বটের গোঁড়াতে জন্মেছিল—কেউ তা জানে না। পাকুরের আশ্রয়েও বট জন্মাতে পারে। দালান-পরিত্যক্ত ইট-খেজুর গাছ-বট-পাকুর-ঠাকুর বাড়ি নিয়ে ধর্মের মত নানান মিথ প্রচলিত আছে। অধিকাংশ গ্রামবাসী মনে করে দালান থেকেই বট-পাকুর হয়েছে।
এই গ্রামে এটাই সবচেয়ে পুরনো বাড়ি। এই বাড়ির ইতিহাসও রূপকথার মত রহস্যময়, ভীতিকর।
এই বাড়ির ছোট ছেলেটি এতদিনে জেনে গেছে, বটের পাতা ডিম্বাকৃতি, মসৃণ ও উজ্জ্বল সবুজ, কচি পাতা তামাটে, ফল টুকটুকে লাল হয়। পাকুরের পাতা অশথের মত, তবে অশথের মত বড় লেজ নয়, ছোট লেজ থাকে। পাকুর গাছের ফল পাকলে কমলা রং মত দেখতে।
একজন কবি কাঁধে ব্যাগ নিয়ে প্রায়ই এখানে এসে কবিতা লিখে। ছেলেটি বলেছিল বট-পাকুর নিয়ে একটা কবিতা লিখতে, সেই কবিতা সে আবৃত্তি করে বট পাকুরকে শুনাবে। বট-পাকুর নিয়ে কবির কোন ভাল কবিতা লেখা হয়নি। তাই কবি তাকে বন্দে আলী মিয়ার “ময়নামতীর চর” কবিতাটি লিখে দিয়ে যায়--‘চরে ওই হালটার কোনে বিঘে দুই ক্ষেত ভরি/বট ও পাকুড়ে দোঁহে ঘিরে ঘিরে করি আছে জড়াজড়ি। গায়ের লোকেরা নতুন কাপড় তেল ও সিঁদুর দিয়া/ঢাক ঢোল পিটি গাছ দুইটির দিয়ে গেছে নাকি বিয়া…।’ ছেলেটি কবিকে বলে, আমাদের গ্রাম তো চর না। কবি বলে, একদিন চর ছিল বাবা, এই দেশটাই কোন কালে চর ছিল, এই প্রকৃতির গাছ-গাছালী- ফসল-পাখি আর আমরা মিলে চরের চেহেরা পরিবর্তন করে ফেলেছি। আবার কোন কালে হয়তো চর হয়ে যাবে।
বট কিংবা পাকুরের অথবা বট-পাকুরের মোটা দুই শিকড়ের মাঝে জং ধরা পুরাতন টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া ছোট মন্দিরে কয়েকটা দেব-দেবীর মূর্তি স্মিত হাসিতে চেয়ে আছে দক্ষিণ দিকে। যেন, কোন পূজারী কিবা তাদের প্রেমে ভক্ত প্রিয়জন চরণ ধূলি নিতে আসবে। ঠিক তাই-ই। এই দক্ষিণের স্যাঁতস্যাঁতে মাটির উপর পা ফেলে ফুটফুটে জ্যোৎন্সার মত নিষ্পাপ একটি তের বৎসরের পিতৃহারা বালক প্রতি সন্ধ্যায় ধূপ-শিখা আর সামান্য অর্ঘাদি নিয়ে পুজা করে। অর্ঘাদি নিবেদন করে, কি যেন বলতে থাকে বিড়বিড় করে। পূজার শেষে দেবীর চরণে লুটিয়ে পড়ে। বালকটির উপনয়ন হবার পর, ওর বিধবা মা ওকে পূজার ব্যাপারে সাহায্য করে।
এই পুরাতন বনঝোপে ঘেরা ঠাকুর বাড়িতে ওরা দুটি প্রাণী--মা ও ছেলে টিনের একটি ঘরে বৃষ্টির সময় বৃষ্টিতে ভিজে, জ্যোৎন্সা রাতে চাঁদের আলো উপভোগ করে জীবন যাপন করে আসছে অনেক বছর ধরে। মন্দিরের পুরানা দালানের ইট-আস্তর প্রায়ই খসে পড়ে। তাছাড়া ওখানে অনেক বিষধর সাপ বাস করে। উত্তরে কালীদের মজা পুকুর পর্যন্ত বিশাল বনঝোপ, সেখানে রাত তো দূরের কথা দিনের বেলায়ও মানুষ যেতে সাহস করে না। সাপ হয়তো এই ঝোপ থেকেই পুরনো দালানে গিয়াছে। তাই কল্যাণরা এই ভাঙ্গা দালানে থাকে না, দক্ষিণে একটু দূরে টিনের ছাউনি আর মুলিবাঁশের তৈরী ভাঙ্গা ঘরে বাস করে ।
হিন্দুরা বটগাছটাকে ধর্মীয় কারণে গুরুত্ব বেশি দেয়, তাই হিন্দু গ্রামে বা পাড়ায় এক বা একাধিক বটগাছ দেখা যায়, বটগাছের জন্মই হয় পুরনো দালানে বা ভাঙ্গা মন্দিরকে আশ্রয় করে। শুধু ছায়া দেয়, ফল খাওয়ার যোগ্য নয় বলে, এই কারণে কেউ বটগাছ রাখতে চায় না, তারপর ভূতের বিষয়তো আছেই। বটফল খেয়ে হাজার হাজার ছোট বড় প্রাণি বেঁচে থাকে। তারপর আশ্রয়ের জন্য, বিশ্রামের জন্য অগণন পোকামাকড় নির্ভরশীল--তা কয়জন জানে? একটা প্রাচীন ফলবান বট গাছে প্রায় এক হাজার হরিয়াল জাতীয় পাখি বাঁচতে পারে; এছাড়া কোকিল, বসন্ত বৌরিসহ নানান ফলখেকো পাখিরা তো আছেই, আছে নানা ক্ষুদে স্তন্যপায়ী প্রাণিরা। আরো আছে হাজার জাতের পোকামাকড়, যাদের জীবন পুরোপুরি এই গাছের উপরেই নির্ভরশীল। একটা বটগাছকে কেন্দ্র করে বিশাল এক ইকো সিস্টেম গড়ে ওঠে। সেই পাখি তথা প্রাণিরাই আবার বটের বীজ ফলের মাধ্যমে দূর-দূরান্তে নিয়ে গাছের বংশবিস্তারে সাহায্য করে। একটা গ্রামে বট, পাকুড়, পলাশ, শিমুল, মান্দার, কদম, ঢাকি জাম, তাল, পেয়ারা, ডুমুর, বহেরা, লটকন, আমলকী, হরিতকী, হিজল, করচ, কামরাঙা, ছাতিম, কাঠবাদাম, সজনে গাছগুলো থাকলে সেই গ্রামে পাখিরা সবচেয়ে বেশ থাকে। এই গ্রামে এই ঠাকুর বাড়ি ছাড়া আর কোথাও বটগাছ নেই। যে গাছগুলো ভালো কাঠ দেয়, ফল দেয় , সে সব গাছ ছাড়া কেউ এখন আর অন্য গাছ রোপণ করে না, কেটে ফেলে। হিন্দুরা যখন এই গ্রামে অনেক বেশি ছিল তখন হিজল আর বইন্যা গাছ বেশি ছিল। চড়ক পূজার শেষ দিনে মহাদেবের পূজায় বইন্যা গাছের ডাল পালার আর বাস্তুপূজায় হিজল গাছের পাতাসহ ডাল প্রয়োজন হতো।
কেশব কবিরাজের তিন পুরুষ এই এলাকায় অনেক জায়গায় ওষুধী গাছে রোপণ করেছে। এই গ্রামে ওষুধী গাছের বিস্তর জঙ্গল ছিল। তার বড় মেয়েটা কোন এক মুসলমান ছেলের সাথে পালিয়ে যাওয়াতে এবং গ্রামে হিন্দু জাতি-গোষ্ঠীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়াতে তিনি তার জমি-জমা-ঘর-বাড়ি ধীরে ধীরে বিক্রি করে কোলকাতাতে বসতি গড়েন। দুই/তিন বছর পর পর তিনি গ্রামে এসে তার ওষুধী গাছের খোঁজ নিতেন। গ্রামে দূর সম্পর্কের এক আত্নীয়ের বাড়িতে মাসখানিক বাস করে, মেয়ের জন্য কান্নাকাটি করে ওষুধী লতা-পাতা নিয়ে কোলকাতা ফিরতেন। গ্রামে আসলে কল্যাণদের বাড়িতে তিনি প্রায়ই যেতেন। তাঁর কাছ থেকে ঠাকুর বাড়ির গল্প কল্যাণ আর তার মা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। দাদু জঙ্গলে গেলে কল্যাণকে, মাঝে মাঝে কালীকেও সাথে নিতেন।
এক সময় পুরো ঠাকুরবাড়ী লোকারন্য ছিল। ঘরে ছেলে-মেয়েদের চিৎকার, রান্না ঘরে বাবুর্চি-রাধুনীর চিৎকার, উঠানে বউ-শ্বাশুরীর খোশগল্প, বাইরে মনিব ও চাকরের সশব্দ কথোপকথন। আজ আর সেই দিন নেই--নেই সেই কোলাহল। সব থেমে গেছে ধীরে ধীরে। বিরাট আয়োজনে এখন আর কোন পূজা হয় না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মাথায় সাম্প্রদায়িক ভূত চেপেছে, ক্রমাগত সবাই কোলকাতা চলে যাচ্ছে অথচ কোলকাতার মুসলমানদের মাথায় সাম্প্রদায়িক ভূত চাপা সত্ত্বেও কোন মুসলমান এই সব গ্রামে এসেছে বলে শুনা যায়নি। বাঙ্গালী হিন্দুদের ধারণা, এদেশে মুসলমানদের সাথে থাকা যাবে না। মুসলমানরা তাদের পূজা করতে দিবে না, মূর্তি ভেঙ্গে দিবে। তাদের, বিশেষ করে মেয়েদের ধর্মান্তর করতে চাইবে। তারা এটাও মনে করে, কয়দিন পর পর ভারত ভিত্তিক কোন উসিলায় কিছু মুসলমান বাড়িতে এসে বলবে, হয় বেটি দে, নয়তো ভিটা দে ...।
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির দাম কোলকাতাতে অপেক্ষাকৃত কম। বাংলাদেশের হিন্দুরা মনে করে, মৌলিক চাহিদা সহ পূজা-পার্বন নিয়ে কোলকাতাতে সুখ-শান্তি ভরপুর। কিন্তু কেউ বুঝতে চায় না, সেখানে কত বেকার, কত বর্ণ-বৈষম্য, টাকা-পয়সা রোজগারের কঠিন অবস্থা! কি জানি, হয়তো হিন্দুদের স্বর্গপুরী ভারতেই অবস্থিত। কেননা দেব-দেবীর যত আজব গল্প আর অবিশ্বাস্য পূজা-অর্চনার কারখানাতো সেখানেই, যেখান থেকে রামরাখীর মত স্বার্থতত্ত্ব তৈরী হয়, হচ্ছে। ভাবতে ইচ্ছে করে, রাম অবতার কি মৌলবাদীদের স্বর্গের লোভ দেখিয়েছে? নয়তো ৫০০ বছরের পুরনো মসজিদ কি করে ভাঙ্গে? কাশী, গয়া, বৃন্দাবন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে , দিল্লী, বোম্বের মত পাতিস্বর্গ--যেখানে নগ্ন, অর্ধনগ্ন হুর-পরীদের ছড়াছড়ি। আর এই পাতিস্বর্গের শিকড় বাড়তে বাড়তে এদেশের আনাচে-কানাচে এসে গেছে। ভারতের হাজার হাজার দ্রব্যতে বাংলার বাজার জমজমাট। হিন্দি গান ছাড়া আমাদের পেটের ভাত হজম হতে চায় না, সকাল হতে চায় না, কোন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতে চায় না। জীবন চলার পথে হিন্দী ফিল্ম আর হিন্দি গান। ভারতে চিকিৎসা ছাড়া আমাদের মন শান্ত হয় অথচ তারপরও বকেই চলেছি ভারতকে। ভারতের রেশ ধরে মাঝে মাঝেই এখানে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এখানেও হিন্দু, বৌদ্ধদের মন্দির ভাঙ্গা হয়। দুই দেশে কারা মসজিদ, মন্দির ভাঙ্গে? ধার্মিকরা? আসলেই ধার্মিকরা? হালকা দৃষ্টিতে দেখলে তাই মনে হয়। আসলে, সব রাজনীতির খেলা।
বেশ কিছুদিন আগে কালী, মিলন, কল্যাণ, দীপা, নাসরিন, শিখা--এরা সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পুতুলের বিয়ে দেবে। এই উপলক্ষে আজ তারা সকাল আর দুপুরের মাঝামাঝি সময়ে একত্র হয়েছে নাসরিনদের বাড়ী। সবাই, যে যাকে দেখেছে তাকেই বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে। তবে অতিথিরা সকলেই ওদের মতই ছোট। সবাই, সবার বাড়ী থেকে গ্লাস, জগ, বাটি, চট, পিঁড়ি ইত্যাদি এনেছে। অনুষ্ঠানের আকর্ষণীয় খাবার হল স্পেশাল খিঁচুড়ি। খিচুরীতে দেওয়ার জন্য কেউ কেউ ঝুমকা ফুল, ডাটাপাতা, পিঁয়াজ, রসুনের ফেলে দেওয়া খোসা, আরো কত কি এনেছে। তাদের অনুষ্ঠানের এই অখাদ্য অথচ মূল্যবান খাবার এর কারণ হল প্রত্যেকের অভিভাবক প্রত্যেককে কান মলে দিয়েছে যেন, চাউল, ডাউল না নেওয়া হয়, আগুন নিয়ে যেন, কোন খেলা না হয়। তবে এই মুহূর্তে এরা নিজেদের শিশু বা বালক-বালিকা হিসাবে মনে করছেন না। যেন প্রত্যেকেই অভিভাবক। তবে একবারে যারা শিশু তাদের ব্যাপার ভিন্ন। অনুষ্ঠানের রান্না শেষ। মিলন সবাইকে ডেকে বলতে লাগল, ঐ তোরা বেকতে খাইত বয়, আগে খাওন, তাপ্পরে বিয়া--। কথা শেষ না হতেই কল্যাণ বলল, ঐ তোরা চিক্কর পারবি না, চুপ কইরা বয় --
ওদের মোট সংখ্যা ১৮ জন। সবাই কলা পাতায় খিচুড়ী নিয়ে মুখের কাছে এনে অয় অয় শুরু করেছে অর্থাৎ ওরা খাচ্ছে। কিন্তু কালীর ছোট বোন সত্যি সত্যি খেতে শুরু করেছে। কালী তাড়াতাড়ি বোনের মুখ থেকে অখাদ্য বের করে মুখ পানি দিয়ে ধুয়ে দিল।
এবার বিয়ের পর্ব। নাসরিন ঘর থেকে একটা পুতুল নিয়ে এলো, পুতুলটি খুব সুন্দর। কিন্তু ঐ স্ত্রী পুতুলকে বিয়ে করার মত বড় বর পুতুল কারো কাছেই ছিল না। কি আর করা যায়, এই নিয়ে সবাই চিন্তায় মশগুল। হঠাৎ শিশুদের মাঝে চিৎকার শুনা গেল। বেশি দুষ্টু বলে পরিচিত সাত্তারকে কেউ দাওয়াত দেয়নি বলে, সে বাঘের মুখোস পড়ে সব খাবার চুরি করে নিয়ে গেছে।
মিলন বলল, থাউক, আমগো খাওন তো অইছে। পরে সত্তইরারে ধরমুনে। তোরা এক কাম কর জয়রে জামাই বানাই।
শিখা বলল, কস কি১ তাইলে জয় যে পুত্তুলের থিকা ম্যালা বড় অইয়া গেল।
কালী বলল, তাইলে কি অইছে, কুদ্দুস কাকার বউকে দেহস নাই? অচিনা মাইনষে বউরে দেকলে কুদ্দুস কাকার মাইয়া নাইলে পোলার বউ মুনে করবে।
হঠাৎ করে নাসরিনের তিন বছরের বোন চুমকী বলে উঠল, “আঁপাঁ, আঁমিঁ বিঁয়াঁ কঁরুঁমঁ। ”
সবাই হাসতে লাগল ওর কথা শুনে। শিখা আদর করে বলল, “চুমকী তুমিতো বিয়া কইরবা না--বিয়া বইবা।
কালী আর মিলন বরপক্ষ এবং নাসরিন আর কল্যাণ কন্যাপক্ষ। মিলন আর কালী জয়কে নিয়ে নাসরিনদের আলুর গুদাম ঘরে গেল। কল্যাণ আর নাসরিন পুতুল নিয়ে নাসরিনদের বারান্দায়ই রয়ে গেল। এর মাঝে কে কন্যাপক্ষে যাবে, কে বরপক্ষে যাবে--তা নিয়ে তুমুল হৈচৈ হয়ে গেল । নাসরিনদের বাড়ীতে মা-বাবা, বড় ভাই-বোন কেউ ছিল না বলেই এত আনন্দ বয়ে গেল। মা, বাবা অথবা বড় ভাই-বোন থাকলে এত আনন্দ করা যেত না।
বিকাল বেলা। কলেজের ছাত্র শংকর কালী ও জয়কে পড়াচ্ছে। প্রায় এক বছর ধরে শংকর ওদের বাড়ীতে টিউশনি করছে। আজ পড়াতে এসে শংকর প্রচন্ড রেগে গেল। সংকরের কাছে আজ কালীর অংক পরীক্ষা ছিল। কালী বলছে সারাদিন সে অংক করতে পারেনি। শংকর ওর কান ধরে দুইগালে চড় দিল। গলার স্বর সপ্তমে উঠায়ে বলল, কি কাম করছিলা হারাদিন ? কও, কি কাম করছিলা? কও--
কালী কোন কথা বলছে না। জয় ভয়ে ভয়ে গলার কম্পন বাড়িয়ে পড়তে লাগল। সেও আজ ভাল করে পড়া শিখেনি।
-- জয়, কবিতা শিখছ?
--জ্বী, স্যার।
--বল, না থাক, লিখ।
--স্যার?
-- কি?
-- কিছু না, থাক।
কালীর বয়স এগার/বার বছর। যতই সে বড় হচ্ছে, ততই সে মোটা হচ্ছে। দেখতে হচ্ছে অনাকর্ষণীয়। নারীত্বের বিশেষ অঙ্গ বেশ সজাগ হয়ে উঠেছে। শংকর আদর করলেও তার কেমন যেন লাগে? আবার থাপ্পর দিলেও কেমন যেন শরীর শিহরিয়ে উঠে। শংকর ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও অংক পরীক্ষা নিয়েছে। একশতে চৌত্রিশ নাম্বার পেয়েছে। অতএব, তাকে দশ মিনিট কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। জয় কাজী নজরুল ইসলাম এর কবিতার দশ লাইন লিখেছে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম লিখতে গিয়ে কাজী নজরুল হসলাম লিখেছে। শংকর ওকে একটা ধমক দিলেও খাতায় গুড লিখেছে। জয় খুশীতে আটখানা হয়ে কালীর নিষেধ করা কথা বলে ফেলল।
-- স্যার, দিদি, পুতুলের বিয়া বিয়া খেলছে। দিদি শ্বাশুরী হইছিল।
--তুমি শ্বাশুরী হইছিলা! এই জন্য এই অবস্থা!
কালী রাগত চাহনীতে জয়ের দিকে তাকায়। ঠিক সেই মূহুর্তে শেফালী ঘরে ঢুকে শংকরকে বলল,
-- ওরে সন্ধ্যা পোযন্ত কান ধইরা খাঁড়া কইরা রাইখবা। হারাঠা দিন নাসরিনগো বাড়িত পুতুলের বিয়া বিয়া খেলছে। কামের সুময় হাজার বার ডাইক্কাও পাই না। হারাদিন পড়তেও বহেনি।
-- এই যে দেহেন অংক পরীক্ষায় একশতে চৌত্রিশ পাইছে। কেমন লাগে মেজাজটা--
শেফালী রাগে ক্ষোভে রান্না ঘরে গিয়ে তুলসীকে বলছে, কালীরে আর এই বাড়িত বেশি দিন রাখন যাইব না। ওর বাপের লগে কতা কইয়া ওর বিয়ার ব্যবস্থা তাত্তারি করতে অইব। হউর বাড়ি গিয়া বুজব ঘরে কামের কি ঠেলা!
(চলবে)
প্রথম পর্বের লিংক-https://cutt.ly/3Q2d5Nf