দেশের বরেন্য সাংবাদিক সাহিত্যিক ফয়েজ আহমদ মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী

প্রকাশ : 2023-03-05 16:51:41১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

দেশের বরেন্য সাংবাদিক সাহিত্যিক ফয়েজ আহমদ মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী

উপমহাদেশের বরেণ্য সাংবাদিক,সাহিত্যিক,বুদ্ধিজীবী ও সংগঠক ফয়েজ আহমদ-এর দ্বাদশতম মৃত্যু বার্ষিকী ২০ ফেব্রুয়ারি ,২০২২।তিনি ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন।পরের দিন ২১ শে ফেব্রুয়ারি হওয়ায় মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মকান্ডে তাঁর মৃত্যুদিবসটি ম্রিয়মান হয়ে পড়ে।তাঁকে যথাযথভাবে স্মরণ করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।সারা জীবন তিনি সাংবাদিকতার জগতে কাটিয়েছেন।কিন্তু তাঁর প্রয়ান দিবস উপলক্ষে দৈনিকগুলোতে কোন স্মরণ- প্রতিবেদন আমরা দেখতে পাই না।সবার অগোচরে নিরবে নিভৃত চলে যায় এ বরেণ্য ব্যক্তির মৃত্যুদিবস।

মধ্যরাতের অশ্বারোহীখ্যাত এই সাংবাদিক- সাহিত্যিকের জন্ম ১৯২৮ সালের ২ মে বিক্রমপুরের শ্রীনগর- বাসাইলভোগ গ্রামে প্রখ্যাত চৌধুরী পরিবারে।আমার বাবা চাচারা তাঁর সহপাঠি ছিলেন।আমি স্কুলে পড়াকালীন তাঁর কথা জানতে পারি।তিনি ও আমি একই ইউনিয়নের পাশাপাশি গ্রামের সন্তান।একই স্কুলের ছাত্রও আমরা।বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলের শেষ দিকে তিনি ষোলঘর একেএসকে উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েছেন।আমি পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে একই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম।তাঁর ছাত্রত্বকালে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি ও শ্রীনগর শ্রীনাথ হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক ছিলেন ডা.মন্মথ নাথ নন্দী।ডা. নন্দীর সংস্পর্শে এসে ফয়েজ আহমদ স্কুলজীবনেই প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন।আমৃত্যুতিনি সেই মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেই চলেছেন,বিচ্যুত হননি।

কিশোর বয়সে তিনি ছিলেন খুব ডানপিটে। ভাল হাডুডু খেলতেন, পিতাকে ফাঁকি দিয়ে হায়ারে হাডুডু খেলতে যেতেন।জীবনের প্রথম রুজি ৫ টাকা হাডুডু খেলেই পেয়ে ছিলেন ।ষোলঘর একেএসকে উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তাঁর লেখা ছড়া’নামের বিভ্রাট’ প্রকাশিত হয় কলকাতার সাহিত্য পত্রিকা সওগাত-এর শিশু বিভাগে।ছাপার অক্ষরে নিজের ছড়া দেখে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা গিয়ে সওগাত অফিসে দেখা করেন সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের সাথে।কিশোর ফয়েজ আহমদ সাহিত্য সম্পাদককে বলেন,” নামের বিভ্রাট ছড়ার লেখক আমি।আহসান হাবীব বলেন,”এই বিভাগে বড়রা লিখে ছোটদের জন্য।এই ছড়ার লেখক তুমি এটা আগে জানতে পারলেতো ছাপতাম না।” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে তিনি মুন্শীগন্জে বড় বোনের বাড়ি বেড়াতে যান।বেড়ানো শেষে নিজ গ্রামে ফেরার সময় বোন আদরের ছোট ভাই ফয়েজকে অনেকগুলো টাকা দেন।তিনি বাড়ি না এসে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে সোজা চলে আসেন কুর্মিটোলা এয়ার ফোর্স ব্যাসে।ইন্টারভিউ দিয়ে টিকে যান বিমান সেনা পদে। ট্রেনিং শেষে ফাইনাল পোস্টিংয়ের ঠিক পূর্ব মূহুর্তে বিশ্বযুদ্ধ থেমে যায়।তাদেরও বিদায় দেওয়া হয়। এদিকে বাড়িতে তো খোঁজার জন্য চারিদিকে লোকজন হয়রান।এমন একদিনে হাজির হন বাড়িতে ।আমার পিতৃসম ফয়েজ আহমদকে তাঁর জীবনের শেষ দিকে ধানমন্ডির বাসায় আমি মাঝে মধ্যে দেখতে যেতাম।তখন দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি ফেলে আসা স্মৃতি রোমন্থন করতেন।

তাঁর পিতা মোস্তফা চৌধুরী ছাত্র জীবনে ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের গভর্নর( গৃহ শিক্ষক)।খাজা নাজিম উদ্দীন ও খাজা শাহাবউদ্দীনকে তিনি পড়াতেন।খাজা নাজিমুদ্দিন বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার সময় মোস্তফা চৌধুরী ছাত্রের সাথে বোম্বে গিয়ে স্টিমারে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন।বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়ে খাজা নাজিমুদ্দিন সব সময় তাঁর শিক্ষককে স্মরণ করতেন।চিঠি লিখতেন,নানা ধরনের উপহার পাঠাতেন।

ফয়েজ আহমদ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় পড়তে এসে সাংবাদিকতায় যুক্ত হন।দীর্ঘ চারদশকের সাংবাদিকতা পেশায় তিনি ইত্তেফাক,সংবাদ,আজাদ ও পূর্বদেশ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার ,হুল্লোড় ,স্বরাজ ও বঙ্গবার্তা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

২৫শে মার্চ,১৯৭১ রাতে তিনি ঢাকা প্রেসক্লাবে আটকা পড়েন।গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলায় তিনি মারাত্বক আহত হন।অতি সতর্কতা ও কষ্ট সহ্য করে তিনি গ্রামের বাড়িতে চলে যান।পরে আগরতলা হয়ে কলকাতা গিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সশস্র প্রশিক্ষন নিতে চেস্টা করে ব্যর্থ হন।যোগদান করেন স্বাধীন বাংলা বেতারে।যুদ্ধক্ষেত্রে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে একাধিকবার মৃত্যু ঝুঁকির সম্মুখীন হন।স্বাধীন বাংলা বেতারে বিশ্লেষণমূলক কথিকা ‘পর্যবেক্ষকের দৃস্টিতে’র লেখক ছিলেন ফয়েজ আহমদ।যাতে মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরতেন।

১৯৭২ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদ সংস্থা ( বাসস)প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন। দেশের বাহিরেও সাংবাদিকতায় তাঁর অবদান রয়েছে।গণচীনের বেতারে বাংলা অনুষ্ঠানের (১৯৬৬-৬৭) প্রবর্তক তিনি।সাংবাদিকতার সাথে শিশু কিশোরদের জন্য সংগঠন গড়েছেন।শিশুদের জন্য লিখেছেন ছড়া ,কবিতা,গল্প।ঢাকা বেতারের শিশুদের অনুষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন কয়েক বছর। তিনি বড়দের জন্যও লিখেছেন প্রচুর।তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক।তাঁর সাড়া জাগানো বই মধ্যরাতের অশ্বারোহী ও সত্যবাবু মারা গেছেন দীর্ঘ দিন ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়।যা সাংবাদিকতার অন্তদৃস্টির এক অভিনব ধারার সংযোজন হিসেবে সর্বমহলের স্বীকৃতি লাভ করেছিল।

ফয়েজ আহমদের সাংগঠনিক কর্মকান্ডের সূচনা হয় ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে।এর সভাপতি ছিলেন ড.কাজী মোতাহার হোসেন।ফয়েজ আহমদ ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সাধারন সম্পাদক হিসেবে দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তা বিকাশে ভূমিকা পালন করেন।১৯৫৪ সালে ভিয়েনায় অনুস্ঠিত আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলণে তিনি পাকিস্তান সরকারকে ফাঁকি দিয়ে বিনা পাসপোর্টে আন্তর্জাতিক মিত্রদের সহায়তায় যোগ দিয়ে চান্চল্য সৃস্টি করেছিলেন।১৯৫৭ সালে দিল্লিতে অনুস্ঠিত এশীয় লেখক সম্মেলনে যোগদান করেন।১৯৮৬ সালে চীন ও উত্তর কোরিয়ার আমন্ত্রণে বাংলাদেশের শীর্ষপর্যায়ের লেখকদের প্রতিনিধি গ্রুপের নেতা হিসেবে দেশ দুটিতে মাসব্যাপী সফর করেন।১৯৯৫ সালে মার্কিন ব্লকেড বিরোধী হাভানায় অনুস্ঠিত সম্মেলনে এবং একই বিষয়ে হ্যানয়ে অনুস্ঠিত সম্মেলনে যোগ দেন।১৯৯৮ সালে আমেরিকা প্রবাসী বাঙ্গালিদের সংগঠন ‘ফোবনা’র নিউইয়র্কে অনুস্ঠিত সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৭৫ সালের শুরুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ অনুরোধে ফয়েজ আহমদ চীন কতৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়ে গোপনে কূটনৈতিক তৎপরতায় অংশ নেন।
তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক।শহীদ মতিউর স্মৃতিসংসদ,ঢাকা লিটল থিয়েটার,সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট,জাতীয় কবিতা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।এরশাদ বিরোধী আন্দলনে তিনি উদ্যেগ নিয়ে দুইনেত্রীকে একত্রে বসিয়ে স্বৈরাচারের পরাজয় ও বিদায়ঘন্টা বাজিয়ে দেন।তিনি ঢাকা ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়র সিন্ডিকেট সদস্য এবং বাংলা একাডেমির পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন।১৯৯১ সালে শহীদ জননী জাহানারা ঈমামের নেতৃত্বে গঠিত গণ আদালতের এগার বিচারকের একজন ছিলেন ফয়েজ আহমদ।পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে জনগনের পক্ষে থাকার কারনে তিনি বেশ ক’বার গ্রেফতার হয়ে চার বছর কারাভোগ করেন।

তিনি ঢাকার প্রাচীন আর্ট গ্যালারি’শিল্পাঙ্গন’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন।অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার,বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার ,সাব্বির শিশু সাহিত্য পুরস্কার,নুরূল কাদের শিশু সাহিত্য পুরস্কার ,মোদাব্বের হোসেন আরা শিশু সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৯১ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন।জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ,ঋষিজ ও জাতীয় কবিতা পরিষদ তাঁকে সম্মাণনা প্রদান করে। ডা. এমএন নন্দীর স্মরণ সভায়, বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে প্রধান অতিথি করে তাঁকে আমি শ্রীনগর নিয়ে গিয়ে ছিলাম।জীবনের শেষ দিকে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি অন্যের সহায়তায় লেখালেখি করতেন।২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বরেণ্য সাংবাদিক- সাহিত্যিক ফয়েজ আহমদের জীবনাবসান হয়।মৃত্যুর আগে তিনি চোখের কর্নিয়া সন্ধানীকে ও দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের গবেষনার জন্য দান করে গেছেন। দ্বাদশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।