তারেকের সঙ্গে মতবিরোধ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের!
প্রকাশ : 2023-12-07 16:51:41১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা সরকার বিরোধী আন্দোলনের চলমান কর্মসূচি হরতাল-অবরোধে বিরতি দিয়ে সভা-সমাবেশ কিংবা এ জাতীয় কর্মসূচি পালন করতে চান। তবে দলের হাইকমান্ড এ প্রস্তাব আমলে না নিয়ে হরতাল-অবরোধেই অটল। এ নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির নেতাদের মতের মিল হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে ঢাকার নেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হলেও প্রকাশ্যে কথা বলতে চাইছেন না কেউ। বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনের মহাসমাবেশে সংঘাতের পর থেকে এ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। এসব কর্মসূচি প্রথম কয়েকদিন ঢিলে-ঢালাভাবে পালনের পাশাপাশি রাজপথে নেতাকর্মীদেরও সেভাবে উপস্থিতি ছিল না। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীসহ দলটির কেন্দ্রীয় সর্বোচ্চ পাঁচ-সাতজন নেতাকে শুধু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করতে দেখা যায়।
এছড়া দলের অঙ্গ, সহযোগী সংঠনের কয়েকজন এবং কয়েকটি জেলার নেতাদের রাজপথের মিছিলে দেখা গেছে। এর বাইরে নেতাকর্মীরা মাঠেই নামছেন না। হরতাল-অবরোধ চলাকালে একদিকে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের কঠোর অবস্থান অন্যদিকে রাজপথে অধিকাংশ নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতিতে অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ছে চলমান কর্মসূচি। দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকলেও আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা সচল। সাধারণ মানুষও জীবন-জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হতে বাধ্য হচ্ছেন। যে কারণে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নতুন কর্মসূচির কথা ভাবছে বিএনপি।
এক্ষেত্রে ঢাকার জ্যেষ্ঠ নেতাদের পক্ষ থেকে সভা-সমাবেশের কর্মসূচির প্রস্তাব করা হচ্ছে। কিন্তু দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আন্দোলনে মাঠে থাকা নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে কর্মসূচি চূড়ান্ত করছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, গত ১৫ বছর ধরে ঢাকার জ্যেষ্ঠ নেতারা সরকার বিরোধী আন্দোলন করছেন। পুলিশের অনুমতি থাকা সভা-সমাবেশে যেসব নেতা-কর্মীর ভিড়ে মঞ্চ ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, পুলিশের অনুমতিবিহীন কর্মসূচিতে সেসব নেতাদের কারও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চলমান আন্দোলনে গত ২৯ জুলাই প্রথমবারের মতো পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করে ঢাকার প্রবেশ দ্বারগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই কর্মসূচিতে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারাও সেই দাযিত্ব ঠিকমতো পালন করেননি। এতে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সকালে কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে রক্তাক্ত হয়ে নেতা-কর্মীদের কাছে ‘হিরো’ হলেও বিকেলে গোয়েন্দা পুলিশ প্রধানের অফিসে খাবার খেয়ে ‘ভিলেন’ বনে যান। মির্জা আব্বাস ঘর থেকে বের হতে পারেননি। নজরুল ইসলাম খান ও ড. আব্দুল মঈন খান তো তাদের নির্ধারিত স্পটেই যাননি।
তিনি বলেন, জ্যেষ্ঠ নেতাদের দু’জন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের জন্য নির্ধারিত জায়গা বাগিয়ে নিয়ে বহুতল আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। দলকে গতিশীল করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারলেও নির্বাচনে মাঠের নেতাদের ‘বলি’ দিয়ে এসব নেতারা নিজের এবং স্ত্রী-সন্তানদের জন্য আসন নিশ্চিত কেরতে মরিয়া থাকেন। একজন আছেন আন্দোলন শুরু হলেই তার ঠিকানা হয় হাসপাতালে। মাঠের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না। কেউ কেউ রয়েছেন সরকারঘনিষ্ঠ বা দুর্নীতিগ্রস্ত।
বিএনপির প্রথম সারির আরেক নেতা বলেন, সম্প্রতি একজন একটি নৈশভোজের আয়োজন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। কেউ বা পড়েছেন ‘হানি ট্রাপে’ সব মিলে নানা কারণে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা এখন কার্যত ব্রাকেটবন্দি। সঙ্গত কারলেই চলমান পরিস্থিতিতে এসব নেতাদের বাদ দেওয়া যাচ্ছে না, আবার তাদের মতামত দলের হাইকমান্ডের কাছে গুরুত্বও পাচ্ছে না।
দলের একাধিক সূত্র জানায়, হরতাল-অবরোধের বাইরে নেতারা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচির চিন্তা করছেন। তবে এখনই আন্দোলনের কর্মসূচি থেকে হরতাল-অবরোধ বাদ দিচ্ছে না বিএনপি। ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন টার্গেট করে তারা শক্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। আপাতত হরতাল-অবরোধের ফাঁকে বিক্ষোভ-সমাবেশজাতীয় কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। এছাড়া ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি দেওয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চায় বিএনপি।
চলমান আন্দোলনের মাঠে থাকা বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, করোনার সময় সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছিল। রাষ্ট্রের সমস্ত অর্গ্যান দিয়েও এক সপ্তাহের বেশি সেভাবে মানুষকে আটকে রাখা যায়নি। মানুষ তার জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বেরিয়েছে। পুলিশও তাদের ঠেকাতে পারেনি। আমাদের চলমান হরতাল-অবরোধেও মানুষ আমাদের এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে। কিন্তু তারা এখন ঘর থেকে বের হচ্ছেন জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে। কার্যত হরতাল-অবরোধ মানুষ পালন করছে না। এসব কর্মসূচির সমর্থনে নেতা-কর্মীরাও মাঠে নামতে পারছে না। ফলে সুপার ফ্লপ কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই কর্মসূচির ধরন পরিবর্তন দরকার।
তিনি বলেন, কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করতে এই মুহূর্তে সাংবিধানিক যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোতে ঘেরাও কর্মসূচি দেওয়া যেতে পারে। ঘেরাও কর্মসূচির জন্য বিএনিপর কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে একশ’ সদস্য বিশিষ্ট একাধিক টিম গঠন করা যেতে পারে। এই টিমে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও থাকবেন। প্রতিদিন একেক টিম একেকটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করতে যাবে। এসব টিমের কেউ গ্রেফতার হলে পরবর্তীজন টিম লিডার হবেন। এভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া দরকার।
চলমান কর্মসূচিতে হতাশা প্রকাশ করে সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন, কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের নামতে হবে। চলমান কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীরা নেই। কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা নামবে, গ্রেফতার হলে হবে, মাঠে নামতে হবে। আমার মনে হয় আমাদের যাদের মামলা রয়েছে তাদের সবার উচিত আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করা।
কেন্দ্রীয় সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূইয়া জুয়েল বলেন, আমাদের জাতীয় স্থায়ী কমিটি ও সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। তাতে তৃণমূল থেকে সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীর সমর্থন রয়েছে।
তিনি বলেন, এই সরকারের আমলে আমাদের নেতা-কর্মীরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছে না। ঘরবাড়ি ছাড়া, তারপরও নেতাকর্মীরা কর্মসূচি পালনের জন্য রাজপথে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, দলের অধিকাংশ স্থায়ী কমিটির সদস্য ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত অবরোধ অব্যাহত রাখার পক্ষে ছিলেন। এরপর আমরা বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করবো। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারবিরোধী অবস্থান নেওয়া সব দলকে এক জায়গায় এনে কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া যায়- তা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে দলের অভ্যন্তরে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় দিবস। আমরা ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করেছি, বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। কিন্তু আজ আমাদের নেতা-কর্মীরা ঘরে থাকতে পারছে না। বন-জঙ্গলে ঘুরছে। জেলে মারা যাচ্ছে। দুটি দিবসে আমরা অবশ্যই কর্মসূচি পালন করবো তবে সে পর্যন্ত পরিস্থিতি কী হয়, সেটি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কাআ