ড. রেজা কি সত্যই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘প্রভাবশালী’?
প্রকাশ : 2022-02-03 10:14:59১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়ার ছেলে ও গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া রাজনীতিতে প্রায়ই আলোচনা-সমালোচনায় আসেন। সরকারবিরোধি কৌতূহল জাগানিয়া বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝাতে চান প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে। সেসব দেশ কী ‘সিদ্ধান্ত’ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিষয়ে, আওয়ামী লীগের সরকারকে কোন দিকে ‘চাপে’ রাখছে বিদেশি রাষ্ট্র- এসব তিনি আগেভাগেই ‘জেনে’ যান!
আসলেই কি তিনি জানেন? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কি তিনি রাজনীতিক হিসেবে ‘পরিচিত ও প্রভাবশালী’? কোন কোন দেশগুলোর সঙ্গে তাঁর ‘ভালো রাজনৈতিক যোগাযোগ’ আছে? তিনি যেসব ‘আগাম তথ্য’ দেন, সেগুলো সত্যে পরিণত হতে দেখা যায় কি? চার বছরের মধ্যে তিনটি রাজনৈতিক দল বদলের ঘটনায় আলোচিত তরুণ অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া। পিতার হত্যাকাণ্ডের সহানুভূতির জের ধরে প্রথমে আওয়ামী লীগে, পরে ড. কামাল হোসেনের গণফোরামে। নিজের ‘রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও রাতারাতি দেশের বড়নেতা হওয়ার আশায় আওয়ামী লীগ ছাড়েন। ছোট দল হলেও কয়েক নেতার সঙ্গে কোন্দলে জড়িয়ে পড়ায় টিকতে পারেননি গণফোরামে।
সবশেষ নিজের ছেলের বয়েসী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নূরের সঙ্গে মিলে নতুন দল গঠন- ‘গণঅধিকার পরিষদ’। এক এগারোর কালে সমালোচিত ছিলেন ড. রেজা। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগ করতেন। দলটি থেকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নও চান। এক এগারোর অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন। তাতে যোগ দিতে যোগাযোগ শুরু করেন ড. রেজা। তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত ‘সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ’ পত্রিকায় এর প্রমাণ আছে।
অধ্যাপক ড. ইউনূসের দল গঠনের ঘোষণার সঙ্গে বদলে যায় পত্রিকাটিতে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত নীতিমালা। মৃদুভাষণের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় ড. ইউনূস দল গঠনের কার্যক্রম থেকে সরে গেলে। সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া গ্রেনেড হামলায় নিহত হন বিএনপি-জামায়াতের চারদলের জোট সরকারের আমলে। বিএনপির নেতৃত্বের ঐক্যফ্রন্টের সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে গণফোরামের নেতা ড. রেজা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন ২০১৮ সালে। তখন তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যে কোনো দেশের রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদের বিদেশে যোগাযোগ থাকা রাজনীতিতে স্বীকৃত বিষয়। আজকের যুগে একদেশ থেকে অন্যদেশের বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নেই। পশ্চিমাসহ প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ দশকের পর দশক ধরে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছড়ি ঘুরিয়ে আসছে। তবে বিদেশিদের পক্ষ নিয়ে দেশের স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়, যা ড. রেজার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে প্রমাণ পাওয়া পাচ্ছে।
র্যাবের কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত বছরের ১০ ডিসেম্বর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা বিভিন্ন সভা সমাবেশে ‘উৎফুল্ল’ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। তিনি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশ করেন বিদেশি একটি সংবাদমাধ্যমের কাছে। তাঁর এ বক্তব্য বিতর্কিত।
কারণ, র্যাবের কয়েক কর্মকর্তার মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সরকার ও ওই বাহিনীর গঠনমূলক সমালোচনা করা যায়। বিষয়টিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বার্থ, ভাবমূর্তি জড়িত। সরকারের বিরোধিতার নামে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া যায় না। র্যাবের কর্মকর্তাদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ‘কৃতজ্ঞতা’ জানিয়ে ড. রেজা আসলে দেশটির ‘সুনজরে’ আসতে চাচ্ছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের সঙ্গে ড. রেজার আসলে কার্যকর সম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই।
রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো সাধারণত জোর দেয় সেসব দলের নেতাদের সঙ্গে, যাদের দলের সাংগঠনিক ভিত্তি জোরালো থাকে। কোনো ব্যক্তি বিশেষের সঙ্গে দেশগুলোর ভালো সম্পর্কের বিষয়টি ভিন্ন। গণঅধিকার পরিষদের সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। ড. রেজার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতির মূলভিত্তি তিনি বেশ কয়েক বছর ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে’ (আইএমএফ) কর্মরত ছিলেন। পরে চাকরি ছেড়ে দেন।
গত ২৯ জানুয়ারি ড. রেজা দাবি করেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভবনা নেই, উল্টো আরো নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আসছে।’ কার কার উপর নিষেধাজ্ঞা আসছে, তাঁর এ তথ্যের উৎস কী, এ ব্যাপারে কিছু জানাননি তিনি। মত ও পথের অনুসন্ধান বলছে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের নাগরিকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে দেশটির পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের আগে তৃতীয় ব্যক্তিকে তা জানায় না। আইন মেনে গোপনীয়তা রক্ষা করে। নতুন করে দেশের কারো উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এলেও তা এ দেশের কারো পক্ষে আগেভাগে জানার সুযোগ মার্কিন আইনে নেই।
জানা যায়, গত ২২ জানুয়ারি বিএনপির শীর্ষনেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন দাবি করেন- ‘আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছেন আওয়ামী লীগের বড় বড় ব্যবসায়ীরা।’ গত ৭ জানুয়ারি বিএনপির আরেক নেতা হাফিজউদ্দিন দাবি করেন, ‘সর্বশেষ সিইসি কেএম নুরুল হুদার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এ রকম আরো অনেক আসবে।’ তাঁদের মতোই রেজা কিবরিয়ার বক্তব্যও ভিত্তিহীন, গুজব। বক্তব্যের উৎস জানতে চাইলে বুধবার বিকেলে ড. রেজা মত ও পথকে বলেন, ‘নতুন করে কিছু বলার নেই। যা বলার, আগেই বলেছি।’
২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর ড. রেজা দাবি করেন- ‘সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। কিছুদিনের মধ্যেই মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে।’ তাঁর সেই ‘মধ্যবর্তী নির্বাচন’ কতোদিনের মধ্যে, এ বিষয়ে খোলাসা করেননি। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার মেয়াদ পূর্ণ করবে, এটা সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিও মনে করে। সরকারবিরোধি কোনো দলই ‘মধ্যবর্তী নির্বাচনের’ সম্ভাবনা দেখছে না।