ডলার সংকটে নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে
প্রকাশ : 2024-05-23 17:43:34১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
দেশে ডলার সংকটের নেতিবাচক প্রভাব সমগ্র অর্থনীতিতে। এর ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ, উৎপাদন, মূল্যস্ফীতি, আমদানি-রপ্তানি, রাজস্ব আদায়, সুদের হার ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক দিক তৈরি হয়েছে। ডলারের এ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত কোনো নীতিমালাই কাজে আসেনি, উল্টো সর্বত্র হতাশা দেখা দিয়েছে।
পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ায় ডলারের দাম জোরপূর্বক আটকে রাখার অবস্থান থেকে পিছু হটে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে এক দিনেই ৭ টাকা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একলাফে বড় ধরনের টাকার অবমূল্যায়ন আমদানি পণ্য ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের খরচ উসকে দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি মাসে ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করে। এতে আমদানি করা নিত্যপণ্যসহ নানান পণ্যের দাম বেড়ে যায়। চলিত অর্থবছরের জুলাই মাসে ডলারের দাম ছিল ১০৭ টাকা ৬৫ পয়সা। ২০২২ সালের মে মাসে মার্কিন এ মুদ্রাটির দর ছিল ৮৯ টাকা। সে হিসাবে দুই বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ২৮ টাকা। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন ডলারের দাম আটকে রেখেছিল।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের বাজার আটকে রাখার যেমন ইতিবাচক দিক নেই, একইভাবে একবারে বেশি দাম বাড়ানোরও যুক্তি নেই। ধীরে ধীরে দাম বাড়ালে বাজারে অস্থিরতা হতো না বলে মত তাদের।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারের দাম আগে থেকেই বেড়ে ছিল। এতদিন ধরে রাখা ঠিক হয়নি। কারণ আমদানিকারক কখনোই নির্ধারিত দামে ডলার পায়নি। তাহলে তো ঊর্ধ্বমুখীই ছিল বাজার। এখন একবারে ৭ টাকা বাড়ানোর ফলে রেট আরও বাড়বে। কারণ বলাই আছে, এরসঙ্গে আরও এক টাকা বাড়া-কমার সুযোগ রয়েছে।
এদিকে চলতি মাসের ২১ মে পর্যন্ত মোট রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। যা গত বছরের ১ জুলাই (চলতি অর্থবছর) ছিল ২৯ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের ১০ মাস ২১ দিনে রিজার্ভ কমেছে ৬ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিযন ডলার। আর বর্তমানে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়নে নেমে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ডলারের ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে কড়াকড়ি করা হয়। নিয়ন্ত্রণমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থার মাধ্যমে বিলাসী পণ্য নিয়ন্ত্রণ করা ছিল প্রধান লক্ষ্য। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ফলে পণ্যের দর বৃদ্ধিসহ ডলার বাজার উসকে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মার্চে ৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে হয়েছিল ৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পণ্য আমদানি হয় ৪৪ দশমিক ১০ কোটি ডলারের। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ছিল যথাক্রমে ৭৫ দশমিক শূন্য ৬ কোটি ডলার ও ৮৯ দশমিক ১৬ কোটি ডলার।
২০২২ সালে ডলার সংকট সামলাতে আমদানি পণ্যের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। বিগত মার্চে আমদানি ব্যয় ছিল ৫ দশমিক ২৩ ডলার। আর গত অর্থবছরে প্রতি মাস গড়ে আমদানি ব্যয় ছিল ৬ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। এতেও ডলারের কোনো উন্নতি হয়নি। উল্টো পণ্যের ঋণপত্র (এলসি) খোলায় কড়াকড়ি শর্তের কারণে চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ সামগ্রিক আমদানি কমেছে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
তথ্য বলছে, আমদানি কমার ফলে একই সময়ে উৎপাদন কমেছে ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কারখানায় উৎপাদন কমায় চলতি বছরের ৯ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পোশাক রপ্তানি কমেছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। আমদানি-রপ্তানি কমার ফলে রাজস্ব আদায় কমেছে। যা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৬ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা কম। আমদানি-রপ্তানি কমার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানেও। গত ডিসেম্বরের তুলনায় পরবর্তী তিনমাসে বেকারত্ব বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানায়, গত এপ্রিল মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। যদিও সার্বিক মূল্যস্ফীতি আগের মাসের চেয়ে কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা তার আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
অন্যদিকে হঠাৎ করেই বাজারের ওপর সুদহার ছেড়ে দেওয়ায় আগামীতে বিনিয়োগ ও ব্যবসা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগ কমলে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে বলে জানান খাত সংশ্লিষ্টরা।
গত ৮ মে ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতি সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট (স্মার্ট) প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনার ফলে এখন থেকে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। এতে সুদের হার ১৩ শতাংশের বেশি হয়ে যায় কয়েকদিনের মধ্যে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানান উদ্যোক্তারা।
ব্যবায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম সুদহার বিষয়ে বলেন, ডলারের মতো সুদহার বাজারের ওপরে ছেড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন যে সুদের হার আছে তাতে ১৪ শতাংশের ওপরে উঠবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আশ্বাস দিয়েছেন। অর্থাৎ এর মধ্যেই আটকে দেবে সুদহার। তবে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে খরচ ৬ থেকে ৮ শতাংশ হলে সুদের হার ১২ শতাংশের ওপরে যাওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।