টিকা কার্যক্রমে এনআইডির ব্যবহার, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়াই ভোটার করার হিড়িক

প্রকাশ : 2021-08-04 10:28:59১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

টিকা কার্যক্রমে এনআইডির ব্যবহার, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়াই ভোটার করার হিড়িক

করোনাভাইরাস প্রতিষেধক টিকা প্রদান কর্মসূচিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করায় সারা দেশে নতুন ভোটার হওয়ার হিড়িক পড়েছে। প্রতিদিন কমবেশি দুই হাজার নাগরিক ভোটার হতে অনলাইনে আবেদন করছেন। ভোটার হওয়ার লক্ষ্যে ছবি তুলতে ও আঙ্গুলের ছাপ দিতে নির্বাচন অফিসগুলোতে ভিড়ও বেড়েছে। আবার কেউ কেউ জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা তথ্য সংশোধনের জন্যও নির্বাচন অফিসে যাচ্ছেন।

কিন্তু নির্বাচন অফিসগুলোতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নতুন কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করেনি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। স্বাস্থ্য সুরক্ষা খাতেও দেওয়া হয়নি বরাদ্দ। এমন পরিস্থিতিতে ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি ভোটার হতে আসা ব্যক্তিরা সংক্রমণ ঝুঁকিতে পড়ছেন। ইতোমধ্যে নির্বাচন ও এনআইডি সেবা দিতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৭২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। মারা গেছেন আটজন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ সূত্র জানিয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী গত ২ মার্চ সারা দেশে হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে ইসি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও বিভিন্ন সময়ে চলা লকডাউনের মধ্যেই ৩ মার্চ থেকে নতুন ভোটার তালিকাভুক্তির কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ৩ মার্চ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে তিন লাখ ২১ হাজার মানুষ নতুন ভোটার হওয়ার জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। ওই সময়ে ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন এক লাখ ৪১ হাজার ৪ জন। অর্থাৎ আবেদনকারীর অর্ধেকের কম সংখ্যক মানুষ ভোটার হতে পেরেছেন।

ভোটার হওয়ার শর্ত হিসাবে তারা সবাই ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার প্যাডে দশ আঙ্গুলের ছাপ দিয়েছেন ও আইরিশ স্ক্যানারে তাদের চোখ রেখেছেন। এক্ষেত্রে নির্বাচন কর্মকর্তা, অফিস সহকারী ও ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের সঙ্গে নতুন ভোটারদের তিন ফুট দূরত্ব রাখার মতো কোনো অবকাঠামো বা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ুন কবীর বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময়ে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যারা নতুন ভোটার হতে আসছেন তারা কোভিড-১৯ পজিটিভ কিনা তা আমরা নিশ্চিত নই। এই নাগরিকদের আঙ্গুল ছাপ ও আইরিশের প্রতিচ্ছবি নিতে গিয়ে কর্মকর্তারা তাদের খুব কাছাকাছি চলে যাচ্ছেন। তখন স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুরক্ষা সামগ্রী কেনার জন্য মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোতে গত সপ্তাহে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যারা এখনো বরাদ্দপত্র পায়নি তাদেরকে আপাতত কাজ চালিয়ে নিতে বলেছি।

ইসি সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় ইসির কর্মকর্তাদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা স্বাস্থ্য সুরক্ষার খাতে বরাদ্দ না দেওয়ার বিষয়টিও তোলেন। পরে আনুষঙ্গিক খাত থেকে সুরক্ষা সামগ্রী কেনার জন্য বলা হয়েছে। অনেক জেলায় এখনো ওই বরাদ্দ পৌঁছেনি। এর বাইরে মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা খাতে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে ইসির বিভিন্ন পর্যায়ের দশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলেন, এবার লকডাউনে জরুরি সেবার মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে যতবার লকডাউনে সরকারি অফিসগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশনা ছিল, এটি জরুরি সেবার মধ্যে রাখা হয়নি। তখনো নির্বাচন অফিসগুলো সীমিত আকারে খোলা রেখে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবা দিয়ে আসছি। এ কাজ করতে গিয়ে ইসির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও ইসি সচিবালয় থেকে দিকনির্দেশনা দেওয়া ছাড়া তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

তারা বলেন, নাগরিকদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে কর্মকর্তা ও ডাটা এন্ট্রি অপারেটেরদের টেবিলের সামনে স্বচ্ছ কাচ বা অন্য কিছু দিয়ে স্বচ্ছ প্রাচীর তৈরি করা যেত। নতুন ভোটারদের ছবি তোলা, আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দূর থেকে নেওয়ার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এসবের কোনো পদক্ষেপই নেয়নি ইসি সচিবালয়। উলটো সিলেট-৩ আসনে নির্বাচন আয়োজন করায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ইসরাইল হোসেন মারা গেলেন। ওই অঞ্চলের কয়েকজন কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হলেন।

এদিকে গত ২৭ জুলাইয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইসির ১৭২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের ৮৪ জন বাসায় ও ২৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ৮৫ জন সুস্থ হয়েছেন। মারা গেছেন আটজন।

নতুন ভোটার : করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা ও সরকারি বিভিন্ন সহায়তা পেতে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। গত ৩ মার্চ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত তিন লাখ ২১ হাজার মানুষ ভোটার হতে আবেদন করেছেন। এ সময়ে ছবি তোলা, আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া ও ফিঙ্গার ম্যাচিং কার্যক্রম শেষ করে ভোটার হিসাবে নিবন্ধিত হয়েছেন এক লাখ ৪১ হাজার ৪ জন।

ইসির দশটি আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতায় উপজেলা ও থানা নির্বাচন অফিসগুলোতে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সবচেয়ে বেশি ভোটার হয়েছে কুমিল্লা অঞ্চলে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চল। শুধু ঢাকা জেলার ২০টি থানা ও উপজেলা নির্বাচন অফিসে প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪৫০ জন নাগরিকের ছবি তোলা ও আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া হয়।

আরও জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি ২৯ হাজার ৬৪১ জন ভোটার (১ এপ্রিল থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত) হয়েছে কুমিল্লা অঞ্চলভুক্ত ৬টি জেলায়। এর মধ্যে কুমিল্লা জেলায় ১১ হাজার ৪১৪ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬ হাজার ৭৫৯ জন, নোয়াখালীতে ৪ হাজার ৭৩২ জন, ফেনীতে ৩ হাজার ৪৮২ জন, চাঁদপুরে ২ হাজার ২১৭ জন ও লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ৩৭ জন নতুন ভোটার হয়েছেন।

একই সময়ে এসব জেলায় ৫১ হাজার ৪৪০ জন জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংশোধনের আবেদন করেছেন। তার মধ্যে ৪২ হাজার ৩১৫টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এ বিষয়ে কুমিল্লা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. দুলাল তালুকদার বলেন, অনলাইনে ও শারীরিক উপস্থিতি-দুইভাবেই জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করছেন। ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমার অঞ্চলের কর্মচারী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

লকডাউন শুরুর দিন ১৪ এপ্রিল থেকে গত ২৭ জুলাই পর্যন্ত বরিশাল অঞ্চলের সাতটি জেলার ৪২টি উপজেলা ও থানা নির্বাচন অফিসে নতুন ভোটার হয়েছেন ২ হাজার ৯৩৬ জন। ওই সময়ে ১১ হাজার ৮৮৮টি জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয় এ অঞ্চলে। ৭ হাজার ১৫৭টি জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করা হয়।

জানতে চাইলে বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বলেন, টিকা কার্যক্রম শুরুর পর থেকে নতুন ভোটার হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এছাড়া বিদেশগামী শিক্ষার্থী, সরকারের বিশেষ উপহারসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে জাতীয় পরিচয়পত্র লাগছে। এসব কারণে নির্বাচন অফিসগুলোতে ভিড়ও বাড়ছে।

তিনি বলেন, নতুন ভোটার করতে হলে আমাদের স্টাফদের তাদের সংস্পর্শে যেতে হচ্ছে। এতে আমার অঞ্চলের অন্তত ২৬ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং একজন অফিস সহায়ক মারা গেছেন।

খুলনা জেলার সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এম মাজহারুল ইসলাম জানান, ৩ মার্চ থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত শুধু খুলনা জেলায় দুই হাজার ৪৫৮ জন ভোটার হতে আবেদন করেছেন। ভোটার করা হয়েছে এক হাজার ৪৪৩ জনকে।

তিনি বলেন, প্রত্যেক নির্বাচন অফিসের সামনে আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা হাত ধোরায় ট্যাব বসানো হয়েছে। কিন্তু নতুন ভোটার হতে আসা ব্যক্তিদের থেকে ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দূরে রাখার কোনো প্রযুক্তির ব্যবহার সম্ভব হয়নি।

প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন ঢাকার সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার মো. মনির হোসাইন খান ও রংপুরের সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেনসহ কয়েকটি জেলার নির্বাচন কর্মকর্তারা।