চলচ্চিত্র বাঁচাতে সরকারের কাছে যে ৭ প্রস্তাব রাখলেন দীপন

প্রকাশ : 2024-09-18 18:03:45১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

চলচ্চিত্র বাঁচাতে সরকারের কাছে যে ৭ প্রস্তাব রাখলেন দীপন

দিকে দিকে সংস্কারের রব উঠেছে। সংস্কৃতি অঙ্গনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম মূলধারার চলচ্চিত্রের সামগ্রিক অবকাঠামো একেবারেই রুগ্ণ। এই মাধ্যমের সংস্কার ভীষণ জরুরি। পরামর্শ দিয়েছেন ‘ঢাকা অ্যাটাক’খ্যাত নির্মাতা দীপংকর দীপন।

দেশের চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক ধারা যে প্রায় মৃত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রায় দেড় দশক ধরে এই মাধ্যম ধুঁকছে, সাম্প্রতিক সময়ে একেবারে থমকে গেছে। এর জন্য চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট মানুষ যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী সরকারের চলচ্চিত্রবিষয়ক নীতি ও কর্মকাণ্ড। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা প্রায় বেকার হয়ে অন্য পেশায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

যাঁরা এখনো রয়েছেন, তাঁরা হতাশায় ডুবে গেছেন। এই হতাশাগ্রস্ত পেশাজীবী মানুষগুলোর জন্য অপেক্ষা করে আছে করুণ পরিণতি। এখান থেকে মুক্তির জন্য চাই বড় পরিসরে সংস্কার। সিনেমা না চলার নেপথ্যে দায়ী মূলত কনটেন্ট, বিপণন ও প্রদর্শনব্যবস্থা, দর্শক নয়।

পণ্য না চললে যেমন ভোক্তাকে দায়ী করা যায় না, তেমনিভাবে দর্শককেও দায়ী করা যায় না। তাই কনটেন্ট, বিপণন ও প্রদর্শনব্যবস্থার মাধ্যমেই চলচ্চিত্রকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তবে রাষ্ট্রীয় ভূমিকা এখানে খুব দরকার। এ পর্যন্ত কোনো সরকারই সে ভূমিকাটি সঠিকভাবে পালন করেনি।

বিগত সময়গুলোতে ভারতীয় চলচ্চিত্র এনে প্রেক্ষাগৃহ বাঁচানোর যে চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে সিনেমা হল তো বাঁচেইনি, বরং নন-ফেস্টিভাল সিনেমার ধারাও একেবারে শেষ হয়ে গেছে।

দুটি ঈদে চারটি সিনেমা ব্যবসা করলে যে একটা ইন্ডাস্ট্রি বাঁচে না, সেটা আমরা সবাই এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। সারা বিশ্বে দেশ আছে ১৯৫টি, কিন্তু নিজস্ব চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি আছে এমন দেশের সংখ্যা মোটে ৫০টির কমবেশি। অর্থাৎ অনেক দেশেরই নিজস্ব চলচ্চিত্রশিল্প নেই। সার্কভুক্ত দেশেই আছে সে উদাহরণ।

বাংলাদেশের থেকে আয়তনে প্রায় চার গুণ বড় মায়ানমার। এ দেশটির কোনো সিনেমার নাম কি কেউ জানেন? এ রকম আরো অনেক দেশের নাম বলা যায়। একটি দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি থাকার অর্থ হলো সেই দেশের সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও গভীর শেকড় আছে। কালচারের প্রতি উদার ও প্রগতিশীল অ্যাপ্রোচ আছে। এ অ্যাপ্রোচটিকে সারা বিশ্ব সম্মান করে। বাংলা পৃথিবীর সপ্তম জনসংখ্যার ভাষা [মতান্তরে অষ্টম]। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বাদ দিলেও অবস্থানটা খুব নিচে যাবে না। এ রকম একটি দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না কোনোভাবেই।

চলচ্চিত্রের মূলধারা মানে বাণিজ্যিক ধারাটা বাঁচলে অন্য ধারাগুলোও বেঁচে থাকে। মূলধারার সূত্র ধরে সিনেমার বিভিন্ন সেক্টর যেমন প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসা, প্রেক্ষাগৃহসংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, প্রদর্শন বিভাগ, বিক্রয় ও বিপণন বিভাগ, স্পেশাল ইফেক্ট, কারিগরি বিভাগ, শিল্পী ও কলাকুশলী, জুনিয়র আর্টিস্ট—সবাই বেঁচে থাকে। চলচ্চিত্র বাঁচাতে হলে সবার আগে দরকার ভালো কনটেন্ট। ভালো কনটেন্ট নির্মাণের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার। চলচ্চিত্রে আমার এক যুগের অভিজ্ঞতা থেকে সরকারের কাছে সাতটি প্রস্তাব পেশ করছি।

৫০টি মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটার
দেশে এখন আছে ২৭টির মতো মাল্টিপ্লেক্স, এর মধ্যে ১৮টিই স্টার সিনেপ্লেক্সের। স্টার সিনেপ্লেক্সের মতো অন্তত আরো দুটি চেইন চালু করতে হবে। ন্যূনতম ১০০টি সিঙ্গেল স্ক্রিন সংস্কার করতে হবে। সংস্কার মানে বসার চেয়ার মেরামত বা বাথরুম পরিষ্কার নয়। পর্দা, প্রজেক্টর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও নিরাপত্তা ঠিক করতে হবে। দর্শকের সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাকে উন্নত করতে হবে। উপভোগ্য ও আরামদায়ক অভিজ্ঞতা পেলে জনগণ যে গাঁটের পয়সা খরচ করে, তা আমরা খাবার ও অ্যামিউজমেন্ট পার্কের ব্যবসায় দেখেছি।

ই-টিকিটিং
ই-টিকিটিং চালু করতে হবে। এটাকে কেন্দ্রীয় সার্ভারের আওতায় আনতে হবে। এমনভাবে সার্ভারটিকে ডিজাইন করতে হবে, যেন সাবস্ক্রিপশন ও গোপন পাসওয়ার্ডের ভিত্তিতে সেখানে প্রযোজক ও পরিবেশকের অ্যাক্সেস থাকে। রাত ১২টায় তাঁরা যেন জানতে পারেন, কোন হলে কত টিকিট বিক্রি হলো। এটি কোনো উদ্ভাবনী তত্ত্ব নয়, বাংলা সিনেমা বিদেশে পরিবেশন করে—এমন কারো কাছে চাইলে এই ধরনের এক্সেল শিট এক মিনিটেই মেইল করে দেবে।

লভ্যাংশ বণ্টন
দর্শক যে টাকায় টিকিট কেনে, তার কত টাকা প্রযোজক পাবে, এর একটা সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। বিভিন্ন দেশে এটা ৪০+৪০+২০—অর্থাৎ হল মালিক শতকরা ৪০ টাকা পায়, প্রযোজক-পরিবেশক ৪০ টাকা ও সরকার ট্যাক্স হিসেবে পায় ২০ টাকা। পরের সপ্তাহগুলোতে হল মালিকের শতকরা হার বাড়তে থাকে, আর প্রযোজকের ভাগ কমে। অথচ আমাদের দেশে দর্শক ১০০ টাকায় টিকিট কিনলে প্রযোজক পায় কম-বেশি ২০ টাকা। সিনেপ্লেক্সের ৩০০ টাকার টিকিটে মাত্র ৬০ টাকা পায় প্রযোজক, যেটা হওয়ার কথা ১২০ টাকা।

নিয়মিত সিনেমা নির্মাণ ও মুক্তি
এটি খুব কঠিন ধাপ। জনপ্রিয় ঘরানার সিনেমা নির্মাণ করার মতো আমাদের অনেক ভালো নির্মাতা আছেন, নতুনদের সুযোগ দিলে সংখ্যাটা আরো বাড়বে। কিন্তু সিনেমা বাণিজ্যের বেহাল এই অবস্থায় বিনিয়োগ করবে কে? যদিও উপরোক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করলে এক বছরের মধ্যে প্রযোজকদের বিনিয়োগে আস্থা ফিরবে। তত দিন পর্যন্ত সিনেমা হল চালানোর জন্য তো কনটেন্ট দরকার। হল সংস্কারের পর এক বছর চালানোর জন্য দরকার কমপক্ষে ২৪টি সিনেমা। এই ২৪টি জনপ্রিয় ঘরানার সিনেমা নির্মাণে আগ্রহী প্রযোজকদের প্রণোদনা দিতে হবে।

আমদানির পরিষ্কার নীতিমালা
হল মালিকরা যদি ব্যবসা নিশ্চিত করার জন্য ভারতীয় বা বিদেশি সিনেমা আনতেই চান, তাহলে আমদানির পরিষ্কার নীতিমালা থাকতে হবে। যেখানে আমাদের চলচ্চিত্র ব্যবসায়ীরা জানতে পারবেন, আগামী এক বছরে কোন সময়ে কোন বিদেশি সিনেমা মুক্তি পাবে। কোন সিনেমা, কবে আনতে চায়, এসব চূড়ান্ত করে সবার সামনে প্রকাশ করবেন আমদানিকারকরা। প্রেক্ষাগৃহে যেন দেশি সিনেমা বঞ্চিত না হয়। সেটি নিশ্চিত করতে হবে। মাল্টিপ্লেক্সে কোনো ভারতীয় সিনেমার ১০টি প্রদর্শনী চললে, দেশীয় সিনেমারও ১০টি প্রদর্শনী চলতে হবে। সিঙ্গেল স্ক্রিনেও একই দিনে একাধিক সিনেমা চলতে পারে, সারা বিশ্বে চলেও।

সেন্সর নয় সার্টিফিকেশন
সেন্সরশিপ বাতিল করে সার্টিফিকেশন পদ্ধতি চালু করতে হবে। শুধু সার্টিফিকেশন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করলেই হবে না। অনেক দেশে সার্টিফিকেশন পদ্ধতি থাকার পরও অনেক সিনেমা আলোর মুখ দেখে না। যে আইন দিয়ে সার্টিফিকেশন পদ্ধতি থাকার পরও কেউ চাইলে সফট পর্ন বানিয়ে চালাতে পারবে না, সে আইন দিয়ে অনেক কিছুরই গলা টিপে ধরা যায়। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা শিথিল করতে হবে। কোনো পেশাজীবীকে খারাপ দেখানো যাবে না, গল্পের প্রয়োজনেও গালি বা যৌনদৃশ্য দেখানো যাবে না—এ মানসিকতার পরিবর্তন দরকার।

চিত্রনাট্যকারদের সম্মানি
চিত্রনাট্যকারদের ন্যূনতম সম্মানি পাঁচ লাখ ও পরিচালকের সম্মানি সিনেমা প্রতি ২০ লাখ হতে হবে। মুম্বাইতে পাঁচ কোটি টাকার সিনেমাতেও চিত্রনাট্যকারদের ন্যূনতম সম্মানি ৩৫ লাখ রুপি। তবে সিনিয়র কোনো চিত্রনাট্যকার ৫০ লাখ রুপির কমে কাজ করেন না। এর সঙ্গে ফিল্ম ইনস্টিটিউট, স্কলারশিপ, কারিগরি মানোন্নয়নে উচ্চতর প্রশিক্ষণ—এসবও প্রয়োজন। তার আগে তো সিনেমা বাঁচাতে হবে। যেভাবে চলে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে, সে রকম চলতে দিলে বিনোদনের জন্য আমাদের ভারতের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়া ছাড়া গতি থাকবে না। প্রেক্ষাগৃহে না হলেও ওটিটি বা টরেন্ট—যেকোনো মাধ্যমেই ভারতীয় সিনেমার প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে ও বাড়ছে। যদি আমরা চলচ্চিত্রের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করতে না পারি, তাহলে ভারতীয়রা অচিরেই আমাদের সিনেমাকে গ্রাস করে নেবে।