ঘায়েল করার সহজ অস্ত্র ধর্ম অবমাননার অভিযোগ
প্রকাশ : 2022-04-12 10:02:03১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল, নওগাঁর মহাদেবপুরের দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পালের ঘটনা পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছে। এরমধ্যে হৃদয় মণ্ডল শিক্ষার্থীদের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে কারাগারে গেছেন। আমোদিনী পাল কারাগারে যাননি ঠিক, তবে তাকেও সামাজিকভাবে হেয় করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে সংবেদনশীল অভিযোগ তোলা হয়েছে। মানুষদের খেপিয়ে দেওয়া হয়েছে। উভয় ঘটনায় সামনে আনা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতির আঘাত।
এই সময়ে কাউকে ঘায়েল করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ। এই অভিযোগ ওঠামাত্র কেউ যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। আমজনতা থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন হয়ে শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের কেউ হঠাৎই নিরাপত্তাহীন হয়ে যাওয়া কারও পাশে দাঁড়ায় না। একপাক্ষিক এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড চলে। এখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হয়। ওই গুজবের মাধ্যমে একশ্রেণির লোক আগ্রাসী হয়ে ওঠে। ‘পরিস্থিতি সামাল দিতে’ প্রশাসনও ভিক্টিমের পক্ষে দাঁড়ায় না। তারা তদন্তের আগেই বিচার করে বসে। পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার পর মামলা হয়, গ্রেপ্তার দেখানো হয়, এরপর আদালত থেকে জামিনও মেলে না সহজে।
স্কুলশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ক্ষেত্রে পরিচিত নিগ্রহের সবগুলো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার সময় গোপনে তার বক্তব্যের অডিও রেকর্ড করে কয়েকজন ছাত্র। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় আলোচনার সময়ে কয়েকজন ছাত্র বারবার ধর্মের প্রসঙ্গ আনে। হৃদয় মণ্ডল স্বাভাবিকভাবেই ধর্মকে ‘বিশ্বাস’ আর বিজ্ঞানকে ‘প্রমাণিত বিষয়’ বলে বর্ণনা করেন। শ্রেণিকক্ষের ওই আলোচনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় তার শিক্ষার্থীরাই, এবং সেখানে গুজব ছড়ায় শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল ‘ধর্ম অবমাননার’। শিক্ষার্থীরাসহ বহিরাগতরা মিছিল করে, শাস্তির দাবি জানায়। প্রধান শিক্ষক উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে জানালে তারা ওই শিক্ষককে আটক করে নিয়ে যায়। এরপর মামলা হয়, গ্রেপ্তারও দেখানো হয় ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগে।
এই ঘটনার আলোচনা থাকতে-থাকতেই ঘটল নওগাঁর ঘটনা, যেখানে শিক্ষক আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হলো হিজাব পরে আসায় ছাত্রীদের মারধরের। অথচ ঘটনা হলো, তিনি হিজাবের জন্যে নয়, স্কুলড্রেস না পরে স্কুলে আসায় শিক্ষার্থীদের ‘শাসন’ করেছেন বলে জানিয়েছেন। তার এই দাবির সত্যতা মেলে কিছু শিক্ষার্থীর বয়ান ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। আমোদিনী পালের সৌভাগ্য যে, তাকে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয়নি। তবে এর আগে তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার হয়েছে, তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মিছিলও হয়েছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগও ওঠেছে।
এই দুই ঘটনা এবং অপরাপর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ঘটনার শিকার হচ্ছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুধর্মাবম্বীরা, এবং তাদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হচ্ছে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জেও প্রায় একই ধরনের ঘটনা আমরা ঘটতে দেখেছি। সেখানে স্কুলশিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে প্রথমে তার ছাত্ররা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হেনস্তা করে, পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য তাকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করিয়ে অপমান করেন। এছাড়াও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দিনাজপুর, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়ও বেশ কয়েকজন শিক্ষককে আমরা লাঞ্ছিত হতে দেখেছি, কারাগারে যেতেও দেখেছি। এসব ঘটনার অব্যবহিত পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রগতিশীল অংশের মানুষজনেরা প্রতিবাদ করলেও লাঞ্ছনার সমাপ্তি ঘটছে না। সরকারও স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজছে না।
দেশে একের পর এক শিক্ষক নিগ্রহের শিকার হলেও সরকার এ ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেমন তাদের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের নিরাপত্তায় উদ্যোগ নিচ্ছে না, তেমনিভাবে উদ্যোগ নিচ্ছে না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। ‘পরিস্থিতি সামাল দিতে’ পুলিশ প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে নিগ্রহের শিকার শিক্ষকদের নিজেদের হেফাজতে নিয়ে এরপর মামলা করে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালত পাঠাচ্ছে। অথচ এখানে ভুয়া অভিযোগের শিকার শিক্ষকদের নিরাপত্তায় তাদের উদ্যোগী হওয়ার দরকার ছিল। এটা দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া, এবং এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে সমাজে-দেশে।
শিক্ষক নিগ্রহের ধারাবাহিক ঘটনাগুলো শ্রেণিকক্ষের স্বাধীনতা হরণ করছে। শিক্ষকদের মুক্তমনে পাঠে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। যার প্রভাব শিক্ষাব্যবস্থার ওপর পড়তে বাধ্য। এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে সন্দেহের পরিবেশ তৈরি করছে, দূরত্ব বাড়াচ্ছে তাদের মধ্যে। যা শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের পথ রচনা করছে।
ধর্ম অবমাননা, ধর্মীয় অনুভূতির আঘাতের যে অভিযোগ তোলা হয় সেগুলো শুরুতে এখন শিক্ষার্থীদের দ্বারা সম্পাদিত হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্রে সেটা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। যাচাই-বাছাই না করেই বেশিরভাগ লোকই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ধর্ম গেল, ধর্ম গেল যে জিগির তার বলি হচ্ছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাই। এ প্রসঙ্গে প্রকাশক ও সংগঠক রবীন আহসান দুঃখ করে লিখেছেন, ‘‘শিক্ষার আগে আমাদের দেশে প্রযুক্তি চলে এসেছে। আমরা প্রযুক্তির অপপ্রয়োগ করছি। প্রযুক্তি এখন আমাদের কলহের প্রধান হাতিয়ার...।’’ ছোট্ট করে বলা কথাগুলো বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং নিকট অতীত বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা মেলে। স্লোগানে আমরা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, কিন্তু সেই ডিজিটাল ব্যবস্থার ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করতে পারছি না মূলত অজ্ঞতায়। হাতে-হাতে আমাদের প্রযুক্তি, মোবাইল-ইন্টারনেট কিন্তু ইতিবাচক ব্যবহারের চাইতে নেতিবাচকভাবেই সেগুলো ব্যবহার করছি। এখানে প্রযুক্তির দোষ নেই সত্য, তবে প্রযুক্তির আগে কিংবা পাশাপাশি আমাদের দরকার ছিল শিক্ষার। এখানে আমরা পিছিয়ে গেছি, পিছিয়ে আছি।
অগ্রগতির জন্যে দরকার শিক্ষার, কিন্তু আমরা শিক্ষা থেকে দূরে। তাই প্রতিষ্ঠানে-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছেন শিক্ষক, এবং সেটা অন্যায় অভিযোগ। এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। অন্যথায় আমাদের সামনে সর্বগ্রাসী অন্ধকার!
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
সৌজন্য-সংবাদপ্রকাশ