করোনায় কর্মহীন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর হাজার হাজার নারী, অনেক বিউটি পার্লার বন্ধ

প্রকাশ : 2021-05-03 11:16:16১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

করোনায় কর্মহীন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর হাজার হাজার নারী, অনেক বিউটি পার্লার বন্ধ

মহামারি করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে গত বছর মার্চের শেষে লকডাউনে বিউটি পার্লার বন্ধ হয়। লকডাউন উঠে গেলে অন্য সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো খোলা হয় বিউটি পার্লারও। কিন্তু আগের আবস্থায় ফিরতে পারেনি দেশের নামিদামি বিউটি পার্লারগুলো।

ব্যবসা মন্দার কারণে এখন টিকে থাকাটাই তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে লোকসানে পড়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এতে কর্মহীন হয়ে পড়ে এই পেশায় যুক্ত হাজার হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী শ্রমিক। কাজ না থাকায় অনেকের খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করে অন্য কাজ করে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতারা বলছেন, এই খাতকে সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনলে টিকে থাকতে পারবেন তারা। আর বিউটি সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে—ভ্যাট, ট্যাক্স, বাড়িভাড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছে তারা। প্রণোদনার টাকা সেভাবে আসেনি এই খাতে।

বিউটি পার্লার খাত সম্প্রতি শিল্প হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু তেমনভাবে বাড়েনি সুযোগসুবিধা। বিউটি সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, দেশের ৬৪ জেলাতেই আছে ছোট-বড় অনেক বিউটি পার্লার, সেলুন ও স্পা কেন্দ্র। বর্তমানে নিবন্ধিত পার্লারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ, যেখানে কাজ করে ১০ লাখের বেশি মানুষ। এদের ৯৫ শতাংশ কর্মীই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। অনামিকা সাংমা ঢাকায় একটি বিউটি পার্লারে কাজ করতেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার পেতেছিলেন ঢাকাতেই। কিন্তু দিনের পর দিন কাজ বন্ধ থাকায় এখন আর পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকা হচ্ছে না তার। গত বছর লকডাউনের পর যখন পার্লার খোলা হয় তখন তার বেতন অর্ধেক করা হয়। কারণ আগের মতো গ্রাহক নেই। তাই পরিবারের সবাইকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে পাঁচ জন বিউটি পার্লার কর্মীর সঙ্গে একটি ঘর ভাড়া করে থাকছেন।

কুহেলিকা নামে একজন জানান, চার জন মালিক নিয়ে মোট ১২ জন তার রূপচর্চাকেন্দ্রে ছিলেন। তাদের পার্লারে যা আয় হতো তা দিয়ে বেশ ভালোই চলত। লকডাইন আর করোনার কারণে এখন আর টিকতে পারছেন না। খেয়ে না খেয়ে, ধারদেনা করে কোনো মতে চলছেন তিনি। কুহেলিকা বলেন, গত বছর তাও কিছু সহযোগিতা পেয়েছেন তারা। কিন্তু এ বছর এখনো তেমন কিছুই পাচ্ছেন না। তিনি অনুরোধ করে বললেন, ‘কেউ যদি কোনো রকমের সহযোগিতা করে তাহলে আমাদের নামটা দিয়েন।’ বাংলাদেশ গারো পার্লার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কুহেলিকা জানান, ঢাকায় ৪২টি গারো নারী মালিকানাধীন বিউটি পার্লার আছে। তাদের সবারই প্রায় একই অবস্থা। কর্মীরা অনেকে বাড়ি গিয়ে কৃষিকাজ করছেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কিছু সংখ্যক বিউটি পার্লার কর্মীকে অর্থ সহায়তা করে। প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প পরিচালক জাহেদ হাসান ইত্তেফাককে জানালেন, ১১৩ জন কর্মীকে বিকাশের মাধ্যমে তারা ২ হাজার টাকা করে দেন।

সম্প্রতি মধুপুরে বিউটি পার্লার কর্মীদের কলাবাগান আর আনারসের খেতে কাজ করার ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। কেউ কেউ আবার গৃহশ্রমিকের কাজ করছেন। কেউ কেউ এখনো বেকার আছেন। এই মহামারিতে দেশের নামিদামি পার্লারগুলোও খরচ কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে কোনো কোনো শাখা বন্ধ করে দিচ্ছেন। যেমন—ঢাকার মিউনি ব্রাইডালের উত্তরা শাখা বন্ধ করা হয়েছে। ফার্জানা শাকিল হেয়ার অ্যান্ড বিউটি পার্লার খরচ কমাতে প্রতিষ্ঠানের পরিসর ছোট করেছে। এমনকি পারসোনার অনেক কর্মীকে তারা ধরে রাখতে পারেনি। বাংলাদেশ আদিবাসী (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) ফোরামের তথ্য মতে বিউটি পার্লারে কাজ করা ৩০-৪০ শতাংশ শ্রমিক ফিরে আসতে পারছেন। তবে কাজে ফিরলেও তারা বেতন পাচ্ছেন অর্ধেক কিংবা তারও কম।

ফেরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ইত্তেফাককে বলেন, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে পার্লারগুলোতে ৫ হাজার গারো মেয়ে কাজ করছেন। এরা সিলেট, নেত্রকোনা, মেহেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, মধুপুর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি এলাকার বাসিন্দা। দেশের নৃ-গোষ্ঠীর মেয়েরা কাজ করে দক্ষ ও পেশাদার রূপচর্চাকর্মী হিসেবে নিজেদের জীবনমানের উন্নয়ন করেছেন। স্বাবলম্বী হয়ে অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তারা আজ খুবই ঝুিঁকর মধ্যে আছেন। সরকারকে এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে আলাদা প্রণোদনা দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বিউটি সার্ভিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কানিজ আলমাস খান গণমাধ্যমকে বলেন, নারীদের পার্লার, সেলুন ও স্পা পরিচালনায় উদ্যোক্তা থেকে কর্মী মিলিয়ে রয়েছেন অন্তত ১০ লাখ নারী। বাংলাদেশের নারী কর্মজীবীদের মোট সংখ্যার ১৮ শতাংশ পার্লারে কাজ করছেন। এই খাতের টার্নওভার বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকা। বেশির ভাগই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। কিন্তু আজ ভ্যাট, ট্যাক্স আর বাড়ি ভাড়া দিয়ে অনেকের পক্ষে ব্যবসায় টিকে থাকা দায় হয়ে যাচ্ছে। আমরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনগোষ্ঠীতে পরিণত করি। তাই তাদের কাজ থেকে বঞ্চিত করতে চাই না। কিন্তু এখন বাধ্য হচ্ছি। আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের অনেক নারী উদ্যোক্তা শোধ করতে পারবেন না ভেবে ঋণের জন্য আবেদন করেননি। অনেকে আবেদন করেও ঋণ পাননি। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আলাদা বরাদ্দের দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ গণমাধ্যমকে বলেন, কৃষি ও অকৃষি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে সস্তা শ্রমেই নারী বেশি জড়িত। উচ্চশিক্ষিত বা প্রশিক্ষিত শ্রমের ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি কম। কোভিডের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি হারিয়ে নারীরা অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কাজ করছে। আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্র থেকে কাজ হারিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়েছে। আসন্ন বাজেটে এই দিকটিতে গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।