ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের মিশেল সোনারং জোড়া মঠে একদিন
প্রকাশ : 2021-07-10 16:44:30১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
বহুদিন ধরে নানা পরিকল্পনা এঁটে চলেছি দেশ ভ্রমণে বের হবো, তা আর হয়ে ওঠে না। যারা যাবে বলে ঠিক করে শেষমেষ পিঠটান দেয় নানা ছলছুতোয়। হ্যানত্যান অমুকতমুক ফলনা। এবারে অবশ্য আমরা ডিটারমিন ছিলাম কোনো ওজর-আপত্তি চলবে না-যে যেতে চাইবে না, না যাবে। বাকিরা যাবো। ঠিক করলাম দেশের অন্য কোনো কোথাও যাওয়ার আগে নিজেদের জেলাটাকে দেখে নিই। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে গুরু মানলাম :
'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’
আমাদের এবারের ভ্রমণ তালিকায় রাখলাম টঙ্গিবাড়ি ও মুন্সীগঞ্জের ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনাগুলোকে-যার মধ্যে পাল, সুলতান, মোগল ও ব্রিটিশ আমল রয়েছে। পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে আমাদের জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো সচিত্র দেখেছি- সম্পর্কে জেনেছি। সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি। কাছ দিয়েই কতবার গিয়েছি-গাড়ি থামিয়ে একটিবার নেমে পড়িনি দেখে আসি বলে। তাই মনে মনে যাবো যাবো ভাবনাটি ছিলই কিন্তু সঙ্গী-সাথী যোগাড় করতে পারিনি।
যাক বাবা এতদিনে হিল্লে হলো। ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে আমিতো সবাইকে ছবি দেখাই আর জায়গাটির গুরুত্ব বর্ণনা করি। দিনক্ষণ ঠিক করে সবাইকে আমাদের সঙ্গী হবার জন্য বলি। দেখে লাইকটাইক দেয়, ইমোজি দেয়। সাক্ষাতেও খুবই উচ্ছাস দেখায় যাওয়ার জন্য। তবে কথায় আছে না ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়’ আমি কিন্তু ওদের উচ্ছাসে পূর্ব অভিজ্ঞতায় তেমন আনন্দিত হতে পারিনি। এমন অনেকবার অনেক ব্যাপারে দেখেছি কিনা তাই।
যাহোক লৌহজং থেকে সকাল ৮ টায় আমরা একটা ব্যাটারিচালিত অটো রিজার্ভ নিয়ে খোদা ভরসা করে সারাদিনের জন্য বের হই। যারা আমাদের সাথে যাবে বলেছিলো তারা গেলে পনের-ষোল জনের একটি দল হতো। গাড়ি তখন একটির জায়গায় দুটো নিতে হতো। আমাদের পরিকল্পনাও তাই ছিলো। ফাইনালি পনের-ষোল জনের দল পাঁচজনের দলে রূপ নেয়।‘যত গর্জে ততো বর্ষেণা’ এখানে যেনো প্রবাদটির সত্যতা মিলে গেলো। তবে আমি কিন্তু একটুও অপ্রস্তুত হইনি। অভিজ্ঞতা তো ছিলোই যা আগেই বলেছি। এক্ষেত্রে মোটামুটি পাঁচ ছয়জনের দল হওয়াই ভালো।
সেদিন খুব সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। কিন্তু গোছগাছ করে বের হতেই ৮টা। এদিকে ড্রাইভার এসে বার কয়েক আমার তালাশ করে গেলো-আমি তৈরি কি না। ড্রাইভার ক্ষ্যাপ না পেয়ে এমনিতে অপেক্ষা করতে পারে কিন্তু গাড়ি ভাড়া নিয়ে লেট করলে অতিরিক্ত দাম হাকায়। আপত্তি করলে হাঙ্গামা বাধাঁয়। তবে আমার ক্ষেত্রে সেদিক দিয়ে দুঃশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিলো না। ড্রাইভার ছিলো পরিচিত-অনুগত। সেভাবেই বেছে নিয়েছি। কথা শুনবে। বিরক্ত হবে না। টেনশন ফ্রি রিল্যাক্স মুডে ঘুরে বেড়াবো। কোনো তাড়া থাকবে না।
গাড়ি নিয়ে আমার বাড়ি থেকেই যাত্রা শুরু করলাম। পথে হানিফ,জুয়েল,বিপ্লব ও হাসপিকে তুলে নিলাম। ফুরফুরে মেজাজে সবাই যে যার আসনে বসে পড়লো। আমি আগে থেকেই ড্রাইভারের বাঁ পাশে বসে ছিলাম ঠিকঠাক মতো দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য। ছোকরা ড্রাইভারতো সব জায়গা চেনে না। ও এসব স্থানে আমাদের সাথে নতুন যাবে। ভয়ে ভয়ে ছিলাম এত দূরের পথ ওর মতো চৌদ্দ-পনের বছরের বালকের গাড়িতে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। বিশেষজ্ঞগণ দুর্ঘটনার জন্য অল্প বয়সী ড্রাইভারদের দায়ী করেন। ওদের নাকি জীবনের প্রতি কোনো দায় বোধ নেই! শেষ অবধি ওর প্রতিই আস্থা রাখলাম।
ব্যাটারিচালিত অটো গাড়ি শাঁ শাঁ করে বাতাস কেটে আমাদের পরিচিত গ্রামগুলোকে পেছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে গন্তব্য কাছে চলে আসছে।
বর্ষা চলছে। হুটহাট বৃষ্টি চলে আসে। ভাবনায় ছিলাম ভ্রমণের দিন বৃষ্টি এসে না সব পন্ড করে দেয়। তা অবশ্য ঘটেনি। দিনটি ঝকমকে ছিলো। রাস্তার দু'ধারের খাল-বিল-চকে তেমন পানি আসেনি। শাপলা-শালুক ফুটে থাকতে দেখবো-তা হয়নি। এবার কেমন করে যেনো তালের শাঁষের দিনগুলো চলে গেল। কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে প্রতিদিনই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দা দিয়ে শাঁষ বের করে বিক্রি করতে দেখি-খাবো খাবো করে আর হয়ে ওঠে না। এভাবেই বর্ষা যায় আর বর্ষা আসে। সংকোচ ভাঙে না।
ড্রাইভার ছোকরা উড়াধুড়া গাড়ি টানে না। মনে হচ্ছিলো বয়সে পরিপক্ক কোনো চালক-জীবনের প্রতি যার অসীম দরদ-গাড়ি চালাচ্ছে। গত কয়েকদিন বেশ খেটেছি ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজাতে। কোথায় কখন কীভাবে যাবো। কোথা দিয়ে শুরু করে কোথায় গিয়ে শেষ করবো। কোন পথ ধরে এগুবো। বিকল্প পথ রয়েছে কিনা। কী খাবো। গুগল ম্যাপ দেখে মাইন্ড ম্যাপ করে নিয়েছি। খুব একটা বেগ পেতে হয়নি খুঁজে পেতে।
গন্তব্য ছিলো সোনারং জোড়া মন্দির। অনেকে মঠও বলেন। সোনারং পাইলট হাই স্কুলের কাছাকাছি স্থানে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে এ অসম্ভব সুন্দর পুরাকীর্তি! প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে ওঠি। সশব্দে বেরিয়ে আসে বাহ! দারুন!। ভালো লাগার হাওয়া মনের মধ্যে দোলা দিয়ে ওঠে। নেটে এ মঠের অনেক পিকচার দেখেছি বটে-এর বিশালতা ও সৌন্দর্য যে এমন উপভোগ্য হয়ে ওঠবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। পাশাপাশি জোড়া লাগানো মঠ দুটির একটি অন্যটির তুলনায় একটু বড়। মঠের উপরের দিকে রয়েছে অসংখ্য কোটর যেখানে টিয়ে ও চন্দনা পাখি বাসা বেঁধে সংসার সাজিয়েছে। এক কোটর হতে অন্য কোটরে টিয়ে ফুরুৎ ফারুৎ ঢুকছে বের হচ্ছে। যেনো আমাদের মতো অতিথি পেয়ে আনন্দে দিশেহারা।
টঙ্গিবাড়ির সোনারং গ্রামে এ মন্দিরটির অবস্থান। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন। রূপচন্দ্র নামে এক হিন্দুলোক বড় কালীমন্দিরটি ১৮৪৩ সালে ও ছোট মন্দিরটি ১৮৮৬ সালে নির্মাণ করেন। ছোট মন্দিরটি মুলত শিবমন্দির। লোকে এটিকে মঠ বললেও মুলত মন্দির। এর সামনে রয়েছে বিশাল বাধাঁনো পুকুর। বড় মন্দিরটি তৈরির সময়েই পুকুরটি কাটা হয়। প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড টানানো আছে। কিন্তু ও টুকুই। দেখে মনে হয় না এর দায়িত্ব কেও নিয়েছে। তারপরও শান্তনা, যাক কাজীর গরু কাগজেতো আছে! মন্দিরের ভেতরে পাতা ভর্তি কয়েকটি বস্তা। মূর্তি নেই। সামনের খোলা স্থানটুকুতেও পাতা-খড়ি শুকোতে দেওয়া হয়েছে। সর্বত্রই যেনো অযত্ন অবহেলার ছাপ। অথচ আরেকটু যত্নবান হলে এটিও হতে পারে দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। পুকুরটিকে ঘিরে রয়েছে গৃহস্থের বাড়ি। কালো রঙের বদ্ধজলাশয়ে দুইজোড়া শাদা হাঁস সাতরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যেই জলে মাথা গুঁজে কি যেনো সন্ধান করছে। পুকুরে ওদের রাজ্যে ওরা যেনো রাজা। নোনাধরা শ্যাওলাগজানো স্যাঁতস্যাঁতে বুনো গন্ধভরা পরিবেশটি যেনো কোনো এক অজানা কারণে ভালো লেগেগেলো।
সঙ্গীরা আমাকে রেখেই গাড়িতে গিয়ে বসলো। এমন দশাসই মঠতো জিন্দেগিতে দেখিনি। আমিতো ছবি তুলেই চলেছি। আর আসা হয়, না হয়! প্রথমবার আসতেই অনেক দেরি করে ফেলেছি ! এ যেনো একটি গোলাপের কাছেই জীবন পার, বাগানটা আর দেখা হলো না। আর হয়তো কখনো আসা হবে না ভেবে একটু সময় নিচ্ছি। কিন্তু তাড়াও ছিলো আরও বেশ কয়েকটি স্থানে যেতে হবে। যেতে হবে বহুদূর। (চলবে)