একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের স্মৃতি  

প্রকাশ : 2022-03-10 11:12:48১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের স্মৃতি  

১৯৭১ সালে আমি বিক্রমপুরের শ্রীনগর কলেজে আইএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। শ্রীনগর থানা ও কলেজ শাখা ছাত্র লীগের সভাপতিও তখন আমি। অন্যান্য দিনের মতো পহেলা মার্চে কলেজে যাই । থার্ড পিরিয়ডে পৌরনীতির ক্লাস নিতে আসেন আবদুর রউফ খান। তিনি জানান যে রেডিওতে শুনেছেন ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিয়েছেন। স্যারের কথা শুনে আমি সকল ছাত্রকে ক্লাস ত্যাগ করে কলেজ প্রাঙ্গনে আসতে বলি। সকল ছাত্র-ছাত্রী তাই করে। আমরা স্লোগান দিই ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা - মানি না মানি না, তোমার আমার ঠিকানা - পদ্মা মেঘনা যমুনা, বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব শেখ মুজিব, জয়বাংলা।’ মিছিল নিয়ে আমরা কলেজ এলাকা ছেড়ে শ্রীনগর বাজারে চলে যাই। এ সময় শ্রীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ও বাজারে আসা মানুষ আমাদের মিছিলে যোগ দিয়ে শ্লোগান দিতে থাকেন। শ্রীনগর শ্রীনাথ হাসপাতালের সামনের প্রাঙ্গনে সমবেত জনতার উদ্দেশে আমি বক্তৃতা করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করি এবং করণীয় সম্পর্কে তাঁদের অবহিত করি। সেলিম, আনোয়ার ও আরো কয়েকজন বক্তৃতা করে। পহেলা মার্চের পরে আমরা আর কলেজে যাইনি। মার্চ মাসের প্রতিটি দিন কাটে নানাবিধ সংগ্রামী কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে।

প্রত্যহ আকাশবাণী, বিবিসির খবর শুনে ও সংবাদপত্র পড়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে থাকি। ৩ মার্চের পত্রিকায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা ও ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের ছবি ও খবর প্রকাশিত হয়। যা দেখে আমরাও অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রীনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর চিন্তা করি। শ্রীনগর থানা ছাত্রলীগের সহকর্মী সেলিম, আনোয়ার, মোফাজ্জল, মোজাম্মেলের সাথে আলাপ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসি, ঢাকায় গিয়ে আমাদের এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে দেখা করে পতাকা ওড়ানোর তারিখ ঠিক করবো এবং তাঁকে দিয়েই পতাকা ওড়ানো হবে।

৬ মার্চ বিকেলে ঢাকা বেতার থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দিবেন তা বেতার থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। ৭ মার্চে দুপুরের পরে প্রতিবেশীর ঘরে রেডিও নিয়ে বসি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্যে। কিন্তু দু একটা দেশাত্ববোধক গানের পরে কোন ঘোষণা ছাড়াই ঢাকা বেতার বন্ধ হয়ে যায়। মনটা দুঃখে ভরে গেল। রাতে আকাশবাণী ও বিবিসি শুনে জানতে পারি বঙ্গবন্ধু চারটি দাবি পেশ করেছেন। রাতে ঢাকা বেতার থেকে বিশেষ ঘোষণা দিয়ে প্রচার করা হয় যে, ৮ মার্চ সকালের বাংলা খবরের পরে বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া ভাষণ প্রচার করা হবে।

৮ মার্চ সকালে আমরা শ্রীনগর কাঠপট্টিতে আশু পোদ্দারের মাইক এনে দুটি হর্ন দুদিকে মুখ করে টানিয়ে দেই। ৯ টার সংবাদের পরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারিত হলো। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শত শত মানুষ মাইক দিয়ে প্রচারিত ভাষণ শোনে। ভাষন শুনে আমার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল- ‘বোধকরি বঙ্গবন্ধু সিরাজ- উদ দৌলা হয়ে এসেছেন বাংলার স্বাধীনতার জন্যে’। ঐ দিনের সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ওপর বিশদ প্রতিবেদন পড়ে সব কিছু অবহিত হই।

স্বাধীন বাংলার পতাকার তিন রং এর কাপড় শ্রীনগরের তৎকালীন সবচেয়ে ভাল টেইলার কাজী এমারত হোসেনকে দিয়ে পতাকার মাপ বুঝিয়ে দিয়ে ১০ মার্চ আমি ও সেলিম ঢাকা আসি। মোয়াজ্জেম ভাইয়ের সাথে দেখা করে পতাকা উত্তোলনের জন্য তাঁকে শ্রীনগরে আসতে অনুরোধ করি। তিনি আমাদের কর্মসূচির সাথে একমত হয়ে জানান, বঙ্গবন্ধু এ সময়ে সকল এমএনএ এবং এমপিএদের ঢাকা ত্যাগ না করতে বলেছেন। তিনি আমাদের ছাত্রলীগের কোন নেতাকে নিয়ে গিয়ে পতাকা উত্তোলন করার পরামর্শ দেন। পরের দিন আমরা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস শহীদ খান সেন্টুর সাথে দেখা করি। তিনি ১৩ মার্চ বিকেলে সময় দেন। আমরা শ্রীনগরে ফিরে মাইকিং করে ও ঢোল দিয়ে পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি প্রচার করি। ছাত্র ইউনিয়নের নেতা দিলওয়ার হোসেন পতাকা উত্তোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দেন।

১৩ মার্চ বিকেলে শ্রীনগর খেলার মাঠে ‘জয়বাংলা মে ’আমার সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। সভায় আবদুস শহীদ সেন্টু তাঁর বক্তৃতার এক পর্যায়ে আমাদের বাম হাত বুকে ও ডান হাত উর্ধে তুলে দেশের স্বাধীনতার জন্যে জীবন উৎসর্গ করার শপথ করান। সভায় ছাত্র লীগের হারুন চৌধুরী (ষোলঘর), মোফাজ্জল হোসেন (বেজগাঁও), মোহাম্মদ আলী টুকু (মজিদপুর দয়হাটা), শেখ মোঃ ইদ্রিস আলী (হরপাড়া), ছাত্র ইউনিয়নের মাহফুজুর রহমান (মাশুরগাঁও) ও আওয়ামী লীগের প্রবীণ সদস্য কেফাজউদ্দিন মাতব্বর (আটপাড়া) বক্তৃতা করেন। সভা শেষ করে আমরা মাঠের পশ্চিম প্রান্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে যাই। ঠিক সে মূহুর্তে আনিসুল ইসলাম তালুকদার (আনিস মেকার) একটি পাকিস্তানি পতাকা ও দিয়াশলাই আমার হাতে দিয়ে বলেন- ‘আগে এটি পোড়াতে হবে’। আমি তাই করি। পাকিস্তানি পতাকা পোড়া শেষ হলে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের হলুদ বর্ণের মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে উড়াই।

সভা ও পতাকা উত্তোলন শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বাবাকে খুব চিন্তাযুক্ত দেখি। তিনি বারবার শুধু আমাকে বলতে থাকেন, ‘তুমি নিজ হাতে পাকিস্তানি পতাকা পোড়াতে গেলে কেন?’ ১৪ মার্চ থেকে শ্রীনগরে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য আসার পূর্বদিন পর্যন্ত শ্রীনগর থানা আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়মিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করতাম।

১৭ মার্চ শ্রীনগর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশীদ মিয়া ঢাকা থেকে ফিরে আমাদের জানান যে, ২১ মার্চ শ্রীনগর খেলার মাঠে থানা আওয়ামী লীগের উদ্যেগে জনসভা হবে। আমরা মাইকিং ও ঢোলের মাধ্যমে জনসভার প্রচার শুরু করি।

২১ মার্চ সকাল থেকেই আমরা সভার ম  তৈরি করি। দুপুরের পরে শ্রীনগর ল ঘাট থেকে শ্লোগান দিতে দিতে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে মাঠে নিয়ে যাই। সভায় এত জনসমাগম হয় যে তিল ধারনের স্থান ছিল না। এই জনসভায় আমরা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রিয় মধু দা ( মধু সুধন দে যিনি শ্রীনগরের সন্তান ও বিখ্যাত মধুর ক্যান্টিনের মালিক) বক্তৃতা করেন। জনসভায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে দীর্ঘক্ষণ বক্তৃতা করেন। তিনি এক পর্যায়ে বলেন- ‘এবারে যদি পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের সাথে অতীতের মতো আচরণ করে, তাহলে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক দফার (স্বাধীনতার) আন্দোলন শুরু করবো।’

২ মার্চ থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশাবলী দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হতো- যা পড়ে আমরা জনসাধারণকে তা মেনে চলতে পরামর্শ দিতাম।

২৬ মার্চ সকাল থেকে শত শত মানুষ ঢাকা ছেড়ে শ্রীনগর আসতে থাকে। তাদের সাথে কথা বলে আমরা ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যদের বাঙালি হত্যার তথ্য জানতে পারি। আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের সহায়তায় শ্রীনগরের সর্ব শ্রেণীর মানুষ ঘরমুখো মানুষদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে। শ্রীনগর কলেজ ও উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমগুলো খুলে দেওয়া হয় ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়ের জন্য।

এ সময়ে আমরা নিয়মিত শ্রীনগর বাজারের ব্যবসায়ী প্রমথ চন্দ্র সরকারের দোকানে বসে রেডিওর খবর শুনতাম। ২৭ মার্চে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নামে একটি অল্প ক্ষমতা সম্পন্ন বেতার তরঙ্গ ধরা পরে। এ বেতার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বারবার বলা হয় । বঙ্গবন্ধু তাদের সাথে আছেন এবং তাঁর নির্দেশেই মুক্তিযুদ্ধ চলছে বলা হয়।

২৮ মার্চে আমরা জানতে পারি যে, ২৬ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কোয়ার্টারে ঢুকে পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যরা মধুসুধন দে, তাঁর স্ত্রী যোগমায়া দে, জেষ্ঠ্যপুত্র রঞ্জিত চন্দ্র দে ও পুত্রবধুকে হত্যা করেছে। মধুদার এক কন্যা আহত হয়েছে। এ সংবাদে আমরা মুষড়ে পড়ি । ব্যথায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে । বারবার মধুদার চেহারা মনের পর্দায় ভেসে উঠে। ২১ মার্চে শ্রীনগরের জনসভায় তাঁর বক্তৃতার স্মৃতিও মনে জাগে।

২৯ মার্চ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকা থেকে শ্রীনগরে আসেন। আওয়ামী লীগ অফিসে আমাদের সাথে আলাপ করেন। তিনি জানান-‘বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। গ্রেফতারের আগে তিনি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।’ তাঁর সাথে আমরা শ্রীনগর থানায় যাই। থানার রাইফেল ও গুলি দিতে তিনি ওসিকে নির্দেশ দেন। ওসি সৈয়দ আহমদ গড়িমসি করায় আমি একটি চেয়ার উঠিয়ে তাঁর দিকে ছুঁড়ে মারি। থানার এএসআই আব্দুল খালেক রাইফেল গুলি দিবে না বললে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তাকে একটা চড় মেরে রাইফেল ও গুলি দিতে নির্দেশ দেন। রাইফেল ও গুলি নিয়ে আমরা শ্রীনগর উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জড়ো হই। এ সময়ে এত জনসমাগম হয় যে- তা এক জনসভার রূপ নেয়। এ সময়ে ঢাকার ফায়ার সার্ভিসের ফায়ারম্যান আবদুস ছামাদ তাঁর পোশাকে রক্তের দাগ দেখিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাঙালি হত্যার বিবরণ দেন। ছামাদের কথা শুনে শ্রীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু মন্ডল উত্তেজিত হয়ে বলেন, ’প্রয়োজনে আমরা তীর ধনুক নিয়ে পাকিস্তানি বর্বরদের সাথে যুদ্ধ করবো।’ থানার রাইফেল নিয়ে আমরা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকেসহ আলমপুরে চলে যাই। এ সময় আমরা একজনও রাইফেল চালাতে জানতাম না। শুধু দেশপ্রেম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলি।

১৯৭১-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে চলে তাঁর সুযোগ্য সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত মুজিবনগর সরকারের পরিচালনায় যুদ্ধ করে ভারত- রাশিয়ার সহায়তায় ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এ অর্জনে একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে জড়িত থাকার সুযোগ পেয়ে আমি ধন্য।

 

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।