এই ক্রেস্ট কি খুব দরকার ছিল ?
প্রকাশ : 2022-02-22 15:38:38১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
৯ ফেব্রুয়ারির দৈনিক পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদ ও ছবি নানা কথার জন্ম দিয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে নভোচারীদের মতো বিশেষ পোশাকে আপাদমস্তক আবৃত এক ব্যক্তি সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার হাতে একটি ক্রেস্ট তুলে দিচ্ছেন। ছবির ক্যাপশন না পড়লে কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয় ক্রেস্ট প্রদানকারী ব্যক্তিটি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। খবরে বলা হয়েছে, কানাডার মানবাধিকার সংগঠন ‘কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন’ (সিএইচআরআইও) ২০১৮ সালে খালেদা জিয়াকে ‘মাদার অব ডেমোক্র্যাসি’ ও ২০১৯ সালে ‘ডেমোক্র্যাসি হিরো’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছিল। বিএনপি মহাসচিব সে ক্রেস্টই খালেদা জিয়ার হাতে অর্পণ করেছেন। পুরস্কার প্রাপ্তির এত বছর পরে কেন তার সনদ দেওয়া হলো, এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, পুরস্কারটি যখন খালেদা জিয়াকে দেওয়া হয় তখন তিনি কারাগারে ছিলেন। এরপর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে থাকায় তা আর তাঁকে দেওয়া সম্ভব হয়নি। গণতন্ত্রের প্রতি খালেদা জিয়ার অসামান্য অবদানের জন্যই কানাডার ওই সংগঠনটি তাঁকে এ পুরস্কার দিয়েছে বলে মির্জা আলমগীর জানিয়েছেন।
কানাডার ওই প্রতিষ্ঠানটির এ পুরস্কার নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মহলে কথা উঠেছে। খালেদা জিয়ার বিরোধী পক্ষ এ পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তীব্র সমালোচনায় রত হয়েছেন। তারা বলছেন, কানাডার যে সংগঠনটি এ পুরস্কার দিয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার কোনো পরিচিতি নেই। কেউ কেউ ওই পুরস্কার বিএনপির অতিউৎসাহী ব্যক্তিদের সংগ্রহ বলেও মন্তব্য করেছেন। বলা হচ্ছে, পুরস্কারের যে সনদের কথা বলা হচ্ছে তাতে সংগঠনটির কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই। এমনকি সনদ দেওয়ার তারিখটি পর্যন্ত নেই; যদিও বিএনপি বলেছে, ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই কানাডার ওই সংগঠনটি ওই পুরস্কার দিয়েছিল। সরকারি দলের নেতারা এ নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন এবং এ প্রসঙ্গে তাঁরা খালেদা জিয়াকে তুলাধোনা করছেন। আমার ভাগ্নিজামাই আবু সাঈদ লীপু কানাডার ক্যালগরিতে সপরিবারে বাস করে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। সে জানাল, টরেন্টোয় ওই নামে একটি সংগঠন আছে। তবে ওদের ওয়েবসাইটে খালেদা জিয়ার নাম নেই। ফলে এ পুরস্কারের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অসংগত নয়।
প্রশ্ন উঠেছে, এই সময়ে এসে অসুস্থ খালেদা জিয়ার হাতে এ ক্রেস্ট তুলে দেওয়া কি খুব দরকার ছিল? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতিহীন একটি সংগঠনের এ সনদ খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি কতটুকু বৃদ্ধি করবে? এ সনদ সংগ্রহের উদ্যোক্তা কারা? আমরা জানি বড় মানুষের অনেক মোসাহেব থাকে, যারা কর্তাভজন নীতিতে বিশ্বাসী। তারা কর্তাকে (আলোচ্য ক্ষেত্রে কর্ত্রী) খুশি করতে এমন সব কান্ড করে যা কর্তার সম্মান বৃদ্ধির পরিবর্তে তাঁকে আরও অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। আলোচ্য ক্ষেত্রেও তেমনি ঘটেছে। কোনো অতিউৎসাহী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কাজটি করেছে। কিন্তু সমালোচনায় ঘায়েল হতে হচ্ছে বেগম জিয়াকে। খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে তিনি কাউকে এ ধরনের ‘পুরস্কার’ জোগাড়ের কথা তো বলেনইনি, এর বিন্দুবিসর্গও জানতেন না।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অনন্যসাধারণ নাম এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। সাধারণ গৃহবধূ থেকে তিনি একজন সফল রাজনীতিবিদে পরিণত হয়েছেন। দীর্ঘ নয় বছর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি পরিণত হয়েছেন গণমানুষের নেত্রীতে। স্বৈরশাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র উদ্ধারে তাঁর সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভূমিকার কথা দেশ-বিদেশে সবাই জ্ঞাত। স্বৈরশাসকের নানা প্রলোভন ও ভয়ভীতি তাঁকে এতটুকু টলাতে পারেনি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সে আন্দোলনে অবিস্মরণীয় ভূমিকার জন্য তিনি ভূষিত হয়েছেন ‘দেশনেত্রী’ অভিধায়। এর চেয়ে বড় অলঙ্কার তাঁর জন্য আর কী আছে? সম্ভবত ১৯৮৯ সালে হংকংয়ের বিখ্যাত সাময়িকী ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’ এক প্রতিবেদনে তাঁকে অভিহিত করেছিল ‘মোস্ট আনকমপ্রোমাইজিং লিডার অব দি ইস্ট’ হিসেবে। কানাডার ওই অখ্যাত সংগঠনের তথাকথিত পুরস্কার কি এর চেয়ে বড়? ১৯৮৩ থেকে ২০২২- দীর্ঘ ৩৯ বছরে খালেদা জিয়ার অর্জন অসামান্য। গৃহবধূ থেকে তিনি রাজনৈতিক নেত্রী হয়েছেন। তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেছেন। আমাদের সংসদীয় ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের নেতাও তিনি (১৯৯৬-২০০১)। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্মানও তিনি অর্জন করেছেন। নির্বাচন করে কখনো পরাজিত হননি। বেগম জিয়া যদি তাঁর বাকি জীবনে আর রাজনীতি না-ও করেন বা না করতে পারেন, তার পরও তাঁর এ অর্জনই তাঁকে ইতিহাসে বাঁচিয়ে রাখবে। তাঁকে মহিমান্বিত করার জন্য ব্যক্তি বা রাজনৈতিক জীবনের পড়ন্ত বেলায় এ ধরনের নামগোত্রহীন বিদেশি সংগঠনের কথিত পুরস্কারের কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম বিএনপির এক শুভানুধ্যায়ীর সঙ্গে। তাঁর কাছে আমার প্রশ্ন ছিল- এ ধরনের অখ্যাত সংগঠনের পুরস্কার খালেদা জিয়ার জন্য খুব দরকার ছিল কি না? তা ছাড়া বিএনপি মহাসচিবকে তো আমরা একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি বলেই জানি। তিনি কীভাবে এমন একটি কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন? ভদ্রলোক বললেন, কোথা থেকে যে কী হচ্ছে কিছুই ঠাওর করতে পারছি না। তবে মনে হয় মহাসচিব কারও আজ্ঞা পালন করেছেন মাত্র। বললাম, যদি তা-ও ধরে নিই তাহলে প্রশ্ন- হুকুমদাতাকে কি তিনি এর মেরিট-ডিমেরিট বোঝাতে পারতেন না? একটু হেসে তিনি বললেন, ‘সে সাহস বা ক্ষমতা যদি মহাসচিবের থাকত তাহলে বিএনপিতে এখন যেসব ‘কান্ডকারখানা’ ঘটছে তার অনেক কিছুই ঘটত না।’ তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘বিএনপিতে তো অনেক মহাসচিব দেখেছেন। বলুন তো মির্জা ফখরুলের মতো এমন মেরুদন্ডহীন মহাসচিব আর কাউকে দেখেছেন?’ আমি তাঁর কথার কোনো জবাব দিলাম না। কী জবাব দেব? একসময় দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম বিধায় এর পূর্বাপর অনেক ঘটনাই তো আমার জানা। এখন দলটির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তার পরও বিভিন্ন সূত্রে যেসব খবর পাই তাতে বিস্ময়ে হতবাক হই এই ভেবে যে একটি রাজনৈতিক দলে এমন অব্যবস্থা-অরাজকতা চলে কীভাবে?
স্মর্তব্য, কিছুদিন আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীর বেগম খালেদা জিয়াকে দেশের ‘প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর সে উক্তির তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। কেন এবং কোন যুক্তিতে তিনি খালেদা জিয়াকে প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন পরবর্তীতে তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি। মির্জা আলমগীরের ওই উক্তিতে খালেদা জিয়ার ভাবমর্যাদা বাড়েনি, বরং আমার মতে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কারণ তিনি যা নন তাঁকে তা বানানোর চেষ্টা তাঁকে অসম্মানিত করারই নামান্তর বলে আমার মনে হয়। ‘খালেদা জিয়া’ শব্দ দুটি উচ্চারণ করলেই মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজন গণতান্ত্রিক নেত্রী এবং মার্জিত রুচিবোধসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। তাঁকে যত দূর জানি তিনি এ ধরনের মোসাহেবি তোষামোদ পছন্দ করেন না। তাহলে কেন মির্জা সাহেব তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টায় নেমেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বেগম জিয়া ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন তাঁর দুই শিশু পুত্রসহ। স্বামী মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। শত্রুশিবিরে বন্দি থাকা কি মুক্তিযুদ্ধে বেগম জিয়ার অবদান নয়? তাহলে কেন স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরে এসে তাঁকে ‘প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা’ বানানোর কসরৎ করতে হবে?
সবারই স্মরণ থাকার কথা, কয়েক বছর অগে বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ আখ্যায়িত করে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন। একটি দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সংবিধানস্বীকৃত পদ্ধতি আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সে হিসেবে বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তাহলে তারেক রহমান কেন জিয়াউর রহমানকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে অহেতুক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন? এটা কি পিতা জিয়াউর রহমানকে আরও উচ্চতায় নিতে, নাকি বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা খাটো করার বোকাটে অভিপ্রায়ে? এ সত্যটি স্বীকার করতেই হবে যে সম্মানীয় কাউকে হেয় প্রতিপন্ন বা অমর্যাদা করে আরেকজনকে মহিমান্বিত করা যায় না। জিয়াউর রহমান আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর সে ভূমিকার কথা ইতিহাস -স্বীকৃত। তাঁকে তো জাতির সামনে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তাহলে কেন এ বালখিল্যতা? জ্ঞানীরা বলেন, রাজনীতিতে বালখিল্যতা বা অর্বাচীনতার কোনো জায়গা নেই। তবে অপরিপক্বরা এ কথাটি হয় জানে না বা জানলেও মানতে চায় না।
রাজনীতিতে আবেগ নাকি সবেগে বিপাকের দিকে ঠেলে দেয়। তাই অভিজ্ঞরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আবেগ পরিত্যাজ্য বলে উপদেশ দিয়ে গেছেন। আর অতি আবেগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি করে। কানাডিয়ান ওই পুরস্কারটির সংগ্রাহক কারা জানা নেই। হতে পারে খালেদা জিয়ার ভক্ত বা দলীয় কর্মীরা ওটা ম্যানেজ করেছেন। কিন্তু এ কাজটি করে যে তাঁরা নেত্রীকে নতুন করে প্রতিপক্ষের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করলেন তা বোধহয় খেয়াল করেননি। এজন্যই মহাজনরা বলে গেছেন, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’।
লেখক : মহিউদ্দিন খান মোহন
সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।