উপকূলীয় বাঁধে শিশুরা কাঁদছে
প্রকাশ : 2022-08-31 13:40:06১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
জলবায়ু পরিবর্তনে একটার পর একটা দুর্যোগের কবলে পড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফণী, আম্ফান, ইয়াস ও বুলবুলের মতো শক্তিশালী ঝড় আঘাত হেনে ইতিমধ্যে উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। এছাড়া লবণাক্ততা, বন্যা, নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো জলবায়ুগত সমস্যা উপকূলের স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা এলোমেলো করে দিয়েছে। জলবায়ুগত দুর্যোগে উপকূলে দারিদ্র্য বাড়ছে। নদীভাঙনে হাজার হাজার পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। উপকূলে কাজ হারিয়ে, দুর্যোগের কবলে পড়ে বহু পরিবার চরম দারিদ্র্যের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। উপর্যুপরি ঘূর্ণিঝড়ের কাছে হার মেনে নিজেদের বসতভিটা হারিয়ে বহু পরিবার বাঁধের ওপর বসবাস করছে। ঘূর্ণিঝড় যেন উপকূলীয় মানুষের জীবনসঙ্গী! সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুরের বহু মানুষ এখনো উপকূলের বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছে। এসব মানুষের ঘরবাড়ি ছিল কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে এসব পরিবার এখন নিঃস্ব ও নিরুপায় হয়ে বাঁধের ওপর মানবতের জীবন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি, খুলনার কয়রা, বাগেরহাটের শরণখোলা উপকূলীয় বাঁধে এখনো শত শত পরিবার কোনো রকমে ছাউনি ও বেড়া দিয়ে ছোট্ট ঘরে বসবাস করছে। শুধু দক্ষিণা লে নয় দেশের যেকোনো বন্যা, নদীভাঙনে ও ঘূর্ণিঝড়ে বিভিন্ন সময় উত্তরা লের বিভিন্ন বেড়িবাঁধে হাজার হাজার পরিবারকে আশ্রয় নিতে দেখা যায়। এসব পরিবারের শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পায় না।
বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ বললেও অত্যুক্তি হবে না। একটা দুর্যোগ কাটিয়ে না উঠতেই আরেকটি দুর্যোগের হানা। নদীভাঙন প্রতিদিনকার সমস্যা বললে বেশি বলা হবে না! প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো স্থানে নদীভাঙনের খবর পাওয়া যায়। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় মৌসুমভিত্তিক দুর্যোগ হলেও এতে ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। দেশের দক্ষিণা লের উপকূলের বিভিন্ন বাঁধে এখনো সহায়-সম্বলহীন হাজার হাজার পরিবার বসবাস করছে। এসব পরিবারের শত শত শিশু ন্যূনতম শিক্ষা, চিকিৎসা, পুষ্টি পাচ্ছে না। অনেক শিশুর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে! অনেকে আবার লেখাপড়া বাদ দিয়ে শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে। বাঁধের ওপর নেই ভালো কোনো পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, নেই বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা। সুপেয় পানির অভাব আর ভালো শৌচাগারের অভাবে পরিবারের শিশুরা নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। একপাশে গবাদিপশু অন্য পাশে বসবাস। এ যেন দূষিত পরিবেশের সাথে আলিঙ্গন। এভাবেই বছরের পর বছর বাঁধের ওপর বসবাস করছে বহু শিশু। বাঁধের ওপর শিশুদের জীবন কাঁটছে নানাবিধ ভয়ে। জোয়ারের পানি এসে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ডর সবসময় কাজ করে। উপকূলের শিশুরা মৌলিক অধিকার থেকে বি ত। বিদ্যালয় অনেক দূরে হওয়ায় বাঁধের উপর বসবাস করা শিশুরা অনেকে অনিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে আবার অনেকে যাচ্ছে না। বাঁধের উপর বসবাস করা পরিবারগুলোও অভাব-অনটনে জর্জরিত। দরিদ্র পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য অসচেতন হওয়ায় তারাও শিশুদের উপর নজর দিতে পারছে না। অনেক পরিবারের শিশুরা পথশিশুর জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকে আবার বিপথে চলে যাচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি সংকটে বহু শিশু রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বাঁধে শিশুদের জীবন কতদিন স্থায়ী হবে তা কেউ বলতে পারে না! সমাজের একটি অংশের শিশুদের মৌলিক অধিকার থেকে বি ত রেখে সংশ্লিষ্ট এলাকার বা দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। উপকূলীয় অ লের শিশুরা যাতে কোনোভাবে মৌলিক অধিকার থেকে বি ত না হয় সে দায়িত্ব সকলের। কেননা যে বয়সে শিশুদের বিদ্যালয়ে থাকার কথা, সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলা করার কথা সে বয়সে লেখাপড়াহীন জীবন কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বাঁধের উপর বসবাস করা শিশুদেরও এগিয়ে নিতে হবে। তাদেরও অন্য সব শিশুর মতো বাঁচার অধিকার আছে। বাঁধের উপর বসবাস করা শিশুরা যাতে লেখাপড়া করতে পারে স্থানীয় প্রশাসন থেকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয়ভাবে বাঁধের উপর বসবাসকারী দরিদ্র পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করলে সেক্ষেত্রে পরিবার ও শিশু সবার জন্য ভালো হবে। অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। বাঁধের শিশুরা যেন মৌলিক অধিকার থেকে বি ত না হয় সেদিকে স্থানীয় কর্র্তৃপক্ষসহ সবার দৃষ্টি রাখা দরকার।
লেখকঃ শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা)