উন্নয়নশীল দেশে শান্তি নাই পারিবারিক জীবনে
প্রকাশ : 2022-02-14 11:58:49১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
মানুষের পারিবারিক জীবনের শান্তি ও দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন দুটোই একান্ত প্রয়োজন। শুধু শান্তি খুঁজলে উন্নয়ন হবে না, আবার শুধু উন্নয়নের পিছনে দৌড়ালেও শান্তি আসবে না। শান্তি ও উন্নয়ন দুটোই সমান্তরাল গতিতে এগিয়ে যেতে হবে।বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সারাবিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে সমানতালে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য একটা সুখবর। আপ্রাণ চেষ্টা করার ফলে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নামও লিখিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যখন যে সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকবে তার কাজই হচ্ছে দেশের জনগণের স্বার্থ সুসংহত রেখে রাষ্ট্র কে অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সহযোগীতা করবে দেশের উন্নয়নের মূলশক্তি জনগণ। উন্নয়নের পেছনে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে দেশ। এটা দোষের কিছু নয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সরকার করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে যে মানুষদের নিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠিত, তাদের পারিবারিক ও সামাজিক নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় রীতি-নীতির যে চরম অবক্ষয় ঘটে চলেছে, এদিকে যেন সরকার অনেকটা উদাসীন হয়ে রয়েছে। মানুষের মূল্যবোধের যে ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে গেছে, এ বিষয়টির দিকে দৃষ্টিপাত করছে না। এই উপেক্ষার ফল এখন পরিবার ও সমাজে তীব্র হয়ে উঠেছে। হতাশা, জীবনের প্রতি মায়া-মমতা হারিয়ে শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। বিয়ে বিচ্ছেদের মাধ্যমে পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণে সন্তানরা অসহায় হয়ে পড়ছে। কোনদিকে যাবে, কার দিকে যাবে-এমন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। এ এমনই এক পরিস্থিতি যা অনাথ হয়ে যাওয়া থেকেও কঠিন। বিচ্ছেদ হওয়া বাবা-মায়ের সান্নিধ্য ও আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়ে সন্তানরা হতাশ হয়ে এক অনিশ্চিত পথের যাত্রী হচ্ছে। কখনো কখনো দুর্বিনীত ও বিপথগামী হয়ে পড়ছে। মা বাবা হারিয়ে যাওয়া এসব অনাথ ছেলেমেয়েরা মানসিক ও শারীরিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে রাষ্ট্রের ও সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
সম্প্রতি ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তালাকের মাধ্যমে পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ার এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শুধু রাজধানীতেই দুই সিটি করপোরেশনে প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে। দিন দিন এ আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে। গত তিন বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিচ্ছেদের বেশিরভাগ আবেদনই নারীদের পক্ষ থেকে হচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা এর কারণ হিসেবে বলেছেন, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন, ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা, উচ্চাভিলাসী মনোভাব বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। এছাড়া পরকীয়ায় আসক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি বিচ্ছেদের কারণ হয়ে রয়েছে।
সৃষ্টির শুরু থেকেই মহান আল্লাহ নারী ও পুরুষের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে পরিবার ও সমাজবদ্ধ হয়ে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে এ কথাও বলে দিয়েছেন, যৌক্তিক কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারে। কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন পরিস্থিতিতে বিচ্ছেদ হতে পারে, তা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ এ কথাও ঘোষণা করেছেন, তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ তাঁর সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ। আমাদের পরিবার ও সমাজিক ব্যবস্থা এবং নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, পারস্পরিক বন্ধন, বিশ্বের অন্য সমাজ ব্যবস্থার চেয়ে একেবারে আলাদা। এখানে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের যে দৃঢ়তা, তা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে নেই বললেই চলে। সেখানে যেমন বিয়ে ছাড়াও অনেকে সংসার করে, তেমনি বিয়ে করেও সংসার করে। তবে বিবাহবর্হিভূত সংসারের হারই বেশি। এতে তাদের পারিবারিক প্রথা অত্যন্ত ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। এশীয় দেশগুলো বিশেষ করে আমাদের দেশের যুথবদ্ধ পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থা মানুষের সভ্যতাকে যেমন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনি দেশের শান্তি-শৃঙ্খলাও বজায় রাখছে। ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের দেশের পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থা বিশ্বে প্রশংসিত ছিল। বিদেশি রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে পর্যটকরা সফরে এসে আমাদের দেশের মানুষের আথিথেয়তা ও আচার-ব্যবহারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং করছেন। আমাদের এই ঐতিহ্য এখন হারাতে বসেছে। ভেতরে ভেতরে পরিবার ও সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে বিদ্বেষ বাড়ছে। পরিবারেও এ সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। যার অবসম্ভাবী পরিণতিতে তালাক বা সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার মতো নিকৃষ্টতম ঘটনা ঘটছে। কোরআন ও হাদিসে নারী-পুরুষের ন্যায্য অধিকারের কথা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। ইসলামের এই অধিকারকে উপেক্ষা করার কারণেই পরিবারে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। সময়ের সাথে মানুষের মন-মানসিকতা ও জীবনযাপনের প্রণালী পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। তবে নিজস্ব পরিবার ও সামাজিক ব্যবস্থার মৌলভিত্তি থেকে সরে গিয়ে বা উপেক্ষা করে হওয়া উচিৎ নয়। এক্ষেত্রে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে। নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার রক্ষা এবং তার নিয়মিত তাকিদ দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালকদের। মানুষের নীতি-নৈতিকতা, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ছুটাকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যায় না।
পরিতাপের বিষয়, এক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালকদের উদাসীনতা রয়েছে। তারা মনে করছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা মানুষকে অর্থ রোজগারের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিতে পারলেই উন্নয়ন ঘটবে। এই নীতি যে বুমেরাং হয়ে উঠেছে, তা পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়া বা বিশৃঙ্খল হয়ে উঠার মধ্য দিয়েই প্রতীয়মান হচ্ছে। তরুণ সমাজ যে, বিপথগামী হয়ে উঠছে এবং মানুষকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে ফেলার মতো রোমহর্ষক ঘটনা পরিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের কারণেই ঘটছে। সরকার শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এসব প্রতিকারের দিকে বেশি মনোযোগী। কেন ও কি কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সমাজে কি ঘটছে, তা খতিয়ে দেখছে না। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে যে পরিবার ও সমাজের ভেতরের পচন ধরা সারানো যায় না কিংবা যাবে না, তা আত্মহত্যা, তালাক বা নৃশংস ঘটনার আশঙ্কাজনক বৃদ্ধির মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হচ্ছে। পরিসংখ্যানের সূচক বৃদ্ধি পেলেও মানুষের মানবিকতা ও মূল্যবোধের সূচকটি নিম্নগামীই রয়ে যায়। যার নেতিবাচক ফলাফল এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে দেশের মানুষ নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ হারিয়ে অসুখী হয়ে থাকে, সে দেশে যতই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটুক না কেন, তা কোনো কাজে আসে না। মানুষের নীতি-নৈতিকতা, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ছুটাকে প্রকৃত উন্নয়ন বলা যায় না।ভুটানের মতো ছোট্ট একটি দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে মানুষের সুখের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭২ সালে দেশটি ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ নীতি অবলম্বন করে। ‘গ্রস ডোমোস্টিক প্রডাক্ট বা জিডিপি’র চেয়ে ‘ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে দেশটির সরকার এ নীতি গ্রহণ করে। এ নীতির ফলে দেশটির মানুষ সুখী দেশের তালিকায় প্রথম দিকে রয়েছে। অথচ আমাদের সরকার কেবল কতটা জিডিপি বাড়ল, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেল, এ নিয়ে পরিসংখ্যান তুলে আত্মতৃপ্তি লাভ করছে। মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ যে দিন দিন ক্ষয়ে তলানীর দিকে ধাবিত, এ বিষয়টি বিবেচনায় নিচ্ছে না। ভয়াবহ এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে অর্থনৈতিক ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে, তবে তা মানুষের সুস্থ মানসিকতা বাদ দিয়ে নয়। পরিবারের অভিভাবক এবং বাবা-মাকে এ চিন্তা করতে হবে, তালাক বা বিচ্ছেদের কারণে সন্তানদের তারা কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে। সন্তান যার সাথেই থাকুক, জন্মদাতা পিতা-মাতাকেই তারা একসাথে দেখতে চায়। এ বিষয়টি বিচ্ছেদের আগেই বাবা-মা বা স্বামী-স্ত্রীকে বিবেচনা করতে হবে। তালাকের মাধ্যমে পরিবার প্রথা ভেঙ্গে যাওয়া বৃদ্ধি অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যানে যে চিত্র উঠে এসেছে, বাস্তবতা তার চেয়েও ভয়াবহ। যে পরিবারটি বিচ্ছেদের মাধ্যমে ভেঙ্গে যাচ্ছে, সে পরিবারের সন্তান কী অবর্ণনীয় ও অনিশ্চিত জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তা কেবল তারাই জানে। এক্ষেত্রে পরিবারের বাবা-মায়েদের যেমন দায়িত্বশীল ও যত্নবান হওয়া উচিৎ, তেমনি রাষ্ট্রেরও এদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট
email- ganipress@yahoo.com