উত্তর-উপনিবেশিক পর্বের অন্যতম শিল্পী রশিদ চৌধুরী
প্রকাশ : 2022-12-12 15:25:24১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
সরকারি রেডিও ও কাগজের মাধ্যমে রক্তপিপাসু জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাঙালি প্রীতির তুচ্ছ নিদর্শনস্বরূপ কয়েকজন বাঙালি কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিককে স্বর্ণপদকসহ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন। জেনে মর্মাহত হলাম আমার নামও সেখানে ছিল। অথচ, হয়তো ঐ সময় তাদেরই হাতে বাংলার কোনো গ্রাম দাউদাউ করে জ্বলছে, নির্মম অত্যাচারের অসহ্য যন্ত্রণায় বাংলার মা-বোনেরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে কিংবা জালিমদের মেশিনগানের মুখে হয়তো বাঙালির জীবন নিঃশেষ হচ্ছে। ... বাংলার শিল্পীর সম্মান, বাঙালির হাত থেকেই গ্রহণযোগ্য। তোমার কোনো অধিকার নেই সম্মাননার। তোমার স্বর্ণপদক তোমার মুখে ছুঁড়ে আজ একমাত্র তোমার ধ্বংস কামনা করে বাঙালি। সফল হোক জয় বাংলার।
–রশিদ চৌধুরী
১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পারিবারিক নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় ৪ এপ্রিল রশিদ তার স্ত্রী অ্যানি এবং কন্যা রোজা ও রীতাকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একটি মার্কিন জাহাজে পাঠিয়ে দেন ফ্রান্সের প্যারিসের উদ্দেশ্যে। প্যারিসে অ্যানির পৈতৃক বাড়ি অবস্থিত। রশিদ এসময় চরম একাকীত্বের কারণে কাব্যচর্চা শুরু করেন। রঙ-তুলি ছেড়ে ব্যক্তিগত ডায়েরি ভরে তুললেন নানা ধরনের লেখাযোখায়। প্রায় ছয় মাস ধরে স্ত্রী ও কন্যাদের ত্যাগ করে যুদ্ধ শেষ হবার তিন মাস পূর্বে ১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি প্যারিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছানোর পর তিনি ফরাসি সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এসময় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তাকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এ-বিষয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে তখনকার অনুভূতি একটি টুকরো কাগজে ব্যক্ত করেন।
১৯৭২ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পর রশিদ চৌধুরী প্যারিস ত্যাগ করে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর সে বছরই বেসরকারি উদ্যোগে চট্টগ্রামে শিল্প-প্রদর্শনকেন্দ্র হিসেবে সর্বপ্রথম একটি 'কলাভবন' প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তিনি, যা বর্তমানে জেলা শিল্পকলা একাডেমি হিসেবে পরিচিত। একই বছর ফরাসি মনীষী আঁদ্রে মালরো চট্টগ্রামের দাম পাড়া, মোহাম্মদ আলী সড়কে অবস্থিত বর্তমান জেলা শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে এর উদ্বোধন করেন। এই কলাভবনই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী অধিভুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হতে শুরু করে। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম চারুকলা মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে চারুকলা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠায় মুখ্য উদ্যোক্তা হিসেবে রশিদ চৌধুরীর ভূমিকা ছিল অন্যতম। এরপর তিনি বিভিন্ন স্থাপনা-ভবনসমূহে তাপিশ্রী এবং ফ্রেস্কোর কাজ শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি গণভবনের সার্বিক সজ্জার কাজ শুরু করলেও তা অসমাপ্ত থেকে যায়। ১৯৭৫ সালে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় অবস্থিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কার্যালয়ে এবং ১৯৭৬ সালে ঢাকায় অবস্থিত ৩২ তলা বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের প্রধান কার্যালয়ে তাপিশ্রীর কাজ করেন। ১৯৭৭ সালে চারুকলায় বিশেষ করে তাপিশ্রী শিল্পে সৃজনক্ষমতার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাকে জাতীয় এবং সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক প্রদান করা হয়। তিনি চারুকলা বিষয়ে একুশে পদক বিজয়ী সর্বপ্রথম চিত্রশিল্পী। ১৯৭৮ সালে সৌদি আরবের, জেদ্দায় ইসলামিক ব্যাংক ভবনে তাপিশ্রীর কাজ করেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনালে তাপিশ্রী ও তৈলচিত্রের কাজ শুরু করেন তিনি, এবং ১৯৭৯ সালে একই ব্যাংকের চট্টগ্রাম ভবনে তাপিশ্রীর কাজ সম্পন্ন করেন।
রশিদ হোসেন চৌধুরী, যিনি রশিদ চৌধুরী নামে পরিচিত, (১ এপ্রিল ১৯৩২–১২ ডিসেম্বর ১৯৮৬) ছিলেন বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, লেখক এবং অধ্যাপক। বাংলাদেশে শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে জয়নুল আবেদীন প্রবর্তিত উত্তর-উপনিবেশিক পর্বে সৃজনশীল ও মৌলিকত্বে তিনি ছিলেন সর্বজন প্রশংসিত ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যেও অন্যতম এবং পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প-আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে স্বকীয় শিল্পচর্চার সূচনা করেছিলেন।
ভারত উপমহাদেশে, বিংশ শতাব্দীর তাপিশ্রী শিল্পী হিসেবে তিনি অন্যতম অগ্রগামী। এ-মাধ্যমেই তিনি সর্বাধিক মৌলিক এবং আধুনিক শিল্পধারার চর্চাকারী হিসেবে অগ্রগণ্য। তাপিশ্রীর পাশাপাশি প্রচলিত তেলরঙ ছাড়াও তিনি কাজ করেছেন টেম্পেরা, গুয়াশ এবং জলরঙ ইত্যাদি অপ্রচলিত মাধ্যমসমূহে। দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি এবং রাষ্ট্রীয় ও সাধারণ ভবনসমূহে তাপিশ্রী মাধ্যমে বহুসংখ্যক কাজ করেছেন তিনি। এই তাপিশ্রী শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে তাকে বাংলাদেশের জাতীয় এবং সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক এবং ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়।
রশিদ বিশ্বশিল্পের প্রাণকেন্দ্র মাদ্রিদ এবং প্যারিসে শিল্প বিষয়ক শিক্ষা গ্রহণ করায় তার শিল্পকর্মে পশ্চিমা আধুনিক শিল্পের আঙ্গিক এবং প্রাচ্যের দেশজ ঐতিহাসিক শিল্পের অবয়ব ও বর্ণের উল্লেখযোগ্য সমন্বয় ঘটেছে। তৎকালীন সময়ে ঢাকায় রঙের খুব আক্রা থাকলেও রং ব্যবহারে তার কার্পণ্য ছিল না। তার শিল্পদর্শনে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আধুনিক শিল্পের দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে শিল্প আন্দোলনের পাশাপাশি শিল্প-শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলার পেছনেও রয়েছে তার বিশেষ অবদান। তার অনেক শিল্পকর্ম বর্তমানে দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে সংরক্ষিত রয়েছে।