ইভিএম নয়, প্রয়োজনে পদত্যাগ করবেন: সিইসিকে বিশিষ্টজনেরা
প্রকাশ : 2022-03-22 20:54:06১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সাহসী হতে সিইসিকে তাগাদা দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। তারা নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরানো, ইভিএম ব্যবহার না করা, দলীয় সরকারের সময় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করাসহ নানা পরামর্শ দিয়েছেন। একইসঙ্গে দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা এলে বর্তমান কমিশনকে প্রয়োজনে পদত্যাগের পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার (২২ মার্চ) সকালে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে দ্বিতীয় ধাপের এ সংলাপে বিভিন্ন পেশার ১৯ জন অংশ নেন।আলোচকরা বলেছেন, ভোট ব্যবস্থাপনার প্রতি ভোটারদের আস্থা ফেরাতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে উদ্যোগী হতে হবে। সেইসঙ্গে কমিশনকে কাজ দিয়েই প্রমাণ করতে হবে, তারা নিরপেক্ষভাবে ভোট করবেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন ইসি গঠনের পর ধারাবাহিক সংলাপ চলছে। দুই দফায় শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের সঙ্গে বসলেন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। সবার মতামত পর্যালোচনা করে অংশগ্রহণমূলক ভোট করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের আশ্বাস দেন নতুন সিইসি।
ইভিএম নিয়ে বিশিষ্টজনদের পরামর্শের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘ইভিএম-এ কোনও অসুবিধা আছে কিনা; মেশিনের মাধ্যমে ভোটে কোনও ডিজিটাল কারচুপি হয় কিনা—এটা আমাদের দেখতে হবে। অনেকে অভ্যস্ত নন। ইভিএমের প্রতি আস্থা নিয়ে কথা উঠেছে।’
তিনি বলেন, ‘ইভিএমে ভালো দিক রয়েছে, দ্রুত গণনা হয়ে যায়। কিন্তু পুনর্গণনার সমস্যা রয়েছে; ব্যালটে পুনর্গণনা করা যায়। কারিগরি কমিটির সঙ্গে মিটিং করে আমাদের ইভিএম সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, সঠিক হলে তা চালিয়ে যেতে হবে। কাজে না লাগলে বর্জন করাই ভালো। এসব মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মকে যেন নির্বাচনে কোনোভাবে উপজীব্য না করা হয়। নির্বাচনে এটাকে কেউ কাজে না লাগায়, সেটা অবশ্যই আমরা দেখবো।’
সিইসির মতে, ‘যে দল সরকারে থাকে তাদের কিছুটা বাড়তি অ্যাডভান্টেজ থাকে। কারণ, প্রশাসন, পুলিশ সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইসি তাদের ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, আইনের কোনও অভাব নেই, কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে বাস্তবে ঘাটতি রয়েছে। আমরা এনফোর্সমেন্টটা যেন ভালোভাবে করতে পারি সেটা চেষ্টা করবো। এনফোর্সমেন্ট ক্যাপাসিটি আরও বাড়াতে পারলে তৃণমূলে ভোটারদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি হয়। তাহলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গন্ডগোল হবে না। আমরা অনুকূল পরিবেশ পাবো।’ এ বিষয়ে সিইসি সবার সহযোগিতা চান।
ইভিএমের বিরোধিতা
সংলাপে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ইভিএমের ব্যবহার অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। এটা থেকে দূরে থাকা ভালো। ইভিএম ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিতে পারে। ঝুঁকি নিয়ে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত নয়।’
সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহার করলেই প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। একটি ভালো ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন।’
লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ যন্ত্রে যে ম্যানুপুলেট করা যায় না, তা নিশ্চিত না করে ব্যবহার করা যাবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন বলেন, ‘ইভিএম সব সময় বিতর্কিত। এটার সমাধান না করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। জোরের সঙ্গে বলবো, ইভিএম ব্যবহার না করার জন্যে।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ইভিএম’র বিরোধিতা করে বলেন, ‘বিনা টেন্ডারে কীভাবে ইভিএম এলো। ইভিএম নিয়ে একজনের এত উৎসাহ কেন, তা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। কোনোভাবে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। চাইলে ৫-১০ কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করতে পারে। তবে এটা না হওয়াই ভালো।’
দুই-একজন ইভিএমের পক্ষে মত দিলেও ইভিএমের ভোটে পোলিং এজেন্ট না রাখার প্রস্তাব করেন তিনি।
দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করুন, সুষ্ঠু নির্বাচন দিন
নিরপেক্ষ থেকে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনদের সবাই। আস্থা ফেরাতে কাজ দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করার পরামর্শ দেন তারা।
দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনকালীন আইন-বিধির যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেন কিনা তা দেখা যাবে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন। সাহসিতার সঙ্গে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। প্রতিবন্ধকতা এলে পদত্যাগের সাহস রাখবেন।’
লিডারশিপ স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সিনহা এম এ সাঈদ, বলেন, ‘ইসি এত সংলাপ করার মানে হচ্ছে এখানে সংকট রয়েছে। আপনার কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন, আস্থা অর্জন করুন সবার। নির্বাচনের সময় কতটুকু নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন সংশয় রয়েছে। আমি আশাবাদী মানুষ।’
নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্রের ধরণ, কেমন নির্বাচন হবে—এ নিয়ে বিদ্যমান আইন বিধিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনা যায় সে বিষয়ে কাজ পরার পরামর্শ দিয়েছেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য আইনে কোনও পরিবর্তন করা যায় কিনা তা চিহ্নিত করেন আপনারা।’ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন ইফতেখারুজ্জামান।
সরকারের অনুগত না থেকে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে যাওয়ার পরার্শ দিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রয়োজনে ইস্তফা দেবেন। সব অংশীজন, ভোটার, আমরা আপনাদের পক্ষে আছি।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। ইসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অতীতের ভুলভান্তি স্বীকার করে কাজ এগিয়ে নিতে হবে।’
তিনি জানান, ক্ষমতায় থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। গত দুটি নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়টি সরকার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন জানান, ভোটের আগে- পরে ছয় মাস নির্বাচনকালীন কর্তৃত্ব কমিশনের কাছে থাকা উচিত। ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে একাদশ সংসদের অধিবেশন থাকবে না। এ জন্যে ভোটের আগে চার মাস, ভোটের পরে দুই মাস-এ ছয় মাসের জন্য ক্ষমতা ইসির হাতে থাকতে পারে। আস্থা অর্জন করতে পারলে সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট করা সম্ভব।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানান, সার্চ কমিটির কারণে বর্তমান কমিশন কিছুটা আস্থা সংকটে পড়েছে। সবার নাম প্রকাশ করেনি কমিটি। এছাড়া নূরুল হুদা কমিশনের সাবেক সচিব ও আরেক সাবেক সচিবের শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় নতুন ইসির দুই সদস্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জোনায়েদ সাকি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার দলের নিবন্ধন দেওয়ারও অনুরোধ করেন তিনি।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সাহসী পদক্ষেপ ও সত্য বলার পরামর্শ দিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এটি কঠিন সমস্যা। দেশের বিরাট একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করে বেড়াচ্ছে। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব না অনেকে বলেছেন।’
শুরু থেকেই অংশগ্রহণমূলক ভোট আয়োজনে রাজনৈতিক সমঝোতার তাগাদা দিয়ে আসছেন নতুন সিইসি। দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় ১৩ মার্চ শিক্ষাবিদদের মতামত নেয় তার নতুন কমিশন। ২২ মার্চ বসেন দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে। সংলাপের শেষে গণমাধ্যম ব্যক্তিদের সঙ্গে সবার কথা হয়েছে।