'মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে সরকার'

প্রকাশ : 2021-07-07 21:01:37১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

'মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে সরকার'

সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

বুধবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল আলোচনায় তিনি এই অভিযোগ করেন। বিএনপির ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা কমিটি’র উদ্যোগে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্স গঠন উপলক্ষে এই আলোচনা হয়।

খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘গত ১২ বছর যারা ফ্যাসিবাদী কায়দায় ক্ষমতায় টিকে আছে, শুধু ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য তারা এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং স্বাধীনতার ৫০ বছরের ইতিহাসকে সম্পূর্ণভাবে বিকৃত করে জনগণকে ও এই প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ, তাদের সাহসিকতাকে আমরা বার বার শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে চাই এবং তাদের সেই প্রেরণা নিয়ে আমরা একটি সুখী-সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, স্বনির্ভর, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়তে চাই- এটাই হোক আমাদের শপথ।’

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা যখন প্রকৃত ইতিহাসের কথা বলি তখন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসে। কারণ তাদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। যদি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানে, যদি ৫০ বছরের স্বাধীনতার ইতিহাস জানে আওয়ামী লীগের এদেশে রাজনীতি করার কোনো ক্ষেত্র থাকবে না। আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। সেজন্য তারা মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাসকে বিকৃত করছে।’
 
তিনি বলেন, ‘বিএনপি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের ঘোষকের দল, মুক্তিযোদ্ধাদের দল, যেহেতু গণতন্ত্রের পক্ষের দল, যেহেতু আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, আমাদের নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। সেজন্য বিএনপির এটা দায়িত্ব প্রকৃত ইতিহাসকে সামনে তুলে এনে নতুন ভবিষ্যত সৃষ্টি করার জন্য আজকের প্রজন্মকে পথ দেখানো।’

জেড ফোর্সের কমান্ডার জিয়াউর রহমানসহ এই ব্রিগেডের সকল সেনা কর্মকর্তা, সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান তিনি।

জেড ফোর্সের অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা- অলি আহমেদ, সাদেক হোসেন, আবদুল হালিম, হুমায়ুন হাই, মইনুল হোসেন চৌধুরী, জিয়াউদ্দিন, সাফায়েত জামিল, আবু জাফর মো: আমিনুল হক, বজলুল গনি পাটোয়ারি, মাহবুবুর রহমান, হাফিজ উদ্দিন, আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী, শমসের মবিন চৌধুরী, মহসিন উদ্দিন আহমেদ, আশরাফুল আলম, আনোয়ার হোসেন, আকবর হোসেন, মহসিন উদ্দিন, এস আই এম নুরুন্নবী খান, খালিকুজ্জামান চৌধুরী, মোদাচ্ছের হোসেন খান, মাহবুবুল আলম, ওয়াকার হাসান প্রমুখের নামও স্মরণ করেন খন্দকার মোশাররফ।
 
ক্ষমতাসীন দলের কাছে প্রশ্ন রেখে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘আজকে যারা ক্ষমতায় গায়ের জোরে আছেন, ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ চালাচ্ছেন আরো ক্ষমতায় থাকার জন্য ইতিহাসকে বিকৃত করছেন। জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের চর বলছেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না বলেছেন। যদি তাই হয় এই জেড ফোর্সের কমান্ডার জিয়াউর রহমানের অধীনে যারা বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছিলেন, তারাও পাকিস্তানের চর ছিল কিনা তা এই সরকারকে জনগণের কাছে পরিষ্কার ভাবে বলতে হবে।’

বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, ‘এই ব্যক্তিরাসহ জেড ফোর্স, এস ফোর্স, কে ফোর্সে যারা সাহসিকতার সাথে ভূমিকা রেখে দেশকে মুক্ত করেছেন এবং পরবর্তিকালে বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তারা কি কেউ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না? যদি তাই হয় তাহলে আমরা বলব, যারা আজকে জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা মানতে রাজি নন, স্বাধীনতার ঘোষক মানতে রাজি নন, প্রথম রি-বোল্টকারী হিসেবে মানতে রাজি নন, জেড ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে মানতে রাজি নন তারা এই সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্বীকার করছেন, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করছেন। এটা যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, ইতিহাস মেনে নেবে না। হয়তো সরকারে থেকে রচনা লেখা যায় কিন্তু ইতিহাস লেখা যাবে না।’
 
তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ জুলাই মুক্তিবাহিনীর প্রথম সামরিক বিগ্রেড জেড ফোর্স গঠন করা হয়। এই পদাতিক ব্রিগেডের নেতৃত্বে দেন এক নম্বার সেক্টার কমান্ডার জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। জিয়াকে ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব প্রদানের সাথে সাথে তাকে লে. কর্ণেল পদে পদোন্নতি দিয়ে ১১ সেক্টারেরও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়।’

জেড ফোর্সের অন্যতম সেনা কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম বলেন, ‘জিয়াউর রহমানকে আমরা সবাই একজন মহান রাষ্ট্রপতি রূপে জানি, তিনি যে কত কৌশলী সমরনায়ক ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অঙ্গনে তিনি একজন তেজোদীপ্ত কমান্ডার ছিলেন। আজকে বিনা ভোটের এই সরকারের কারণে ক্রমাগতভাবে সেই ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি আমার কমান্ডার শহীদ জিয়াউর রহমানকে।’

তিনি বলেন, ‘জেড ফোর্স ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ব্রিগেড কিন্তু এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিগেড। অন্য যে দুটি ব্রিগেড ছিল কে ফোর্স ও এস ফোর্স, সেখানে দুটি করে পদাতিক ব্যাটেলিয়ন ছিল। কিন্তু জেড ফোর্সে তিনটি পদাতিক ব্যাটেলিয়ন ছিল। এই জেড ফোর্স ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শক্তিশালী একটি ব্রিগেড যারা রণাঙ্গনে অনেক গৌরব দীপ্ত ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সাহসিকতার পদক অর্জন করেছে জেড ফোর্স এবং আত্মদানে ও শহীদের সংখ্যাও সবচাইতে বেশি এই জেড ফোর্সে।’

মেজর হাফিজ বলেন, ‘রৌমারী একটি জায়গা, এটি সবসময় স্বাধীন রেখেছে জেড ফোর্স। এখানে বারংবার আক্রমণ চালিয়েছে পাকিস্তান বাহিনী নৌপথে, কোদালকাঠিতে যুদ্ধে হয়েছে কয়েকবার। পরে তারা রণভঙ্গ দেয়। এই রৌমারী সবসময় স্বাধীন ছিল।’

তিনি বলেন, রৌমারীতে জিয়াউর রহমানে সাথে আমি গিয়েছি, আমাদের অন্য কমান্ডাররা গিয়েছেন। সেখানে আমরা ডাক চালু করেছি, একটি সিভিল প্রশাসনও চালু করেছিলাম। এই রৌমারী ৯টি মাস মুক্ত রাখার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে জেড ফোর্স।’
 
ময়মনসিংহ, জামালপুর, সিলেট অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর জেড ফোর্সের বিভিন্ন অভিযানের ঘটনা তুলে ধরে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রথম, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের ব্যাটেলিয়ানকে নিয়ে ১৯৭১ সালের জুন মাসে নির্দেশ দেয়া হয় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম ব্রিগেড জেড ফোর্স গঠন করার জন্য। এই তিনটি ব্যাটেলিয়ানে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত রিক্রুট ছাত্ররা রয়েছে যাদের কোনো সামরিক ট্রেনিং নেই। এদেরকে ট্রেনিং দেয়ার জন্য নিয়ে আসা হলো মেঘালয়ের তুরাগ থেকে ২০ মাইল উত্তরে তেলঢালা নামক জায়গায়। তেলঢালা ছিল উঁচু পাহাড়ে ঘেরা একটি ঘন বনাঞ্চল। এখানে জেড ফোর্সের গোড়াপত্তন করা হয়। জুলাই মাসের শেষ দিকে এসে যোগদান করেন জেড ফোর্সের কমান্ডার জিয়াউর রহমান। তিনি এসে দেখতে পান আমরা নতুনদের ট্রেনিং দিচ্ছি। তিনি এই ট্রেনিংয়ের তত্ত্বাবধান করেন।’

তিনি বলেন, ‘দুঃখের বিষয় আমরা যারা বিএনপি করি আমরা নিজেরাই জানি না। সিলেটে কোথায় যুদ্ধ হয়েছে আমি সিলেটের নেতৃবৃন্দকে জিজ্ঞাসা করেছি তারাও বলতে পারেনি। এই হলো বাস্তবতা। যখন আমরা ক্ষমতায় থাকি তখন আমরা জীবিত নেতাদের তোষামোদে ব্যস্ত থাকি। যখন ক্ষমতায় থাকি তখন জেড ফোর্সেরে নামও শোনা যায় না। এখন কিছুটা শুনতে পারছি সেজন্য দলের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’

হাফিজ বলেন, ‘জেড ফোর্সে সমরনায়কদের মধ্যে, সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে চারজন বিএনপিতে ছিলেন। একজন কর্ণেল আকবর হোসেন, তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, অন্য দুজন কর্ণেল অলি আহমেদ ও মেজর শমসের মবিন চৌধুরী-তারা অন্য দলে চলে গিয়েছেন। আমি একমাত্র কোনোক্রমে অনেক অস্বস্তি নিয়ে এখনো টিকে আছি।’

দলের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা কমিটির আহ্বায়ক ব্যারিস্টার অবসরপ্রাপ্ত মেজর শাহজাহান ওমর বীর উত্তমের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল জয়নাল আবেদীনের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আব্দুস সালাম, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাদেক আহমেদ খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।