‘ভদ্র গলি’তে অভদ্র কারবার

প্রকাশ : 2021-06-06 08:16:51১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

‘ভদ্র গলি’তে অভদ্র কারবার

রাজধানী ঢাকায় এমন কিছু গলি রয়েছে, যেগুলোর নামের সাথে বাস্তবতার মিল নেই। নানা করণে এসব নামের উৎপত্তি। অনেক নামের কারণ খুঁজে পেলেও কিছু কিছু নাম আছে যেগুলোর উৎপত্তিগত কারণ সম্পর্কে কিছু জানার উপায় নেই। তেমনি একটি নাম ‘ভুতের গলি’। একটি নয় দুটি ভুতের গলি আছে ঢাকায়। একটি হাতিরপুলের কাছে, অপরটি নারিন্দা এলাকায়। জীবনে যখন প্রথম ঢাকায় আসি (১৯৬৬) তখন অবস্থান করেছিলাম ওই গলির কাছেই দক্ষিণ মৈশুন্ডি এলাকায়। রাস্তাটির নাম লাল মোহন সাহা স্ট্রিট। তখনই ঘটনাক্রমে ভুতের গলি নামটির সাথে পরিচিত হই। চমকে গিয়েছিলাম। মনে প্রশ্ন জেগেছিল, সেই গলিতে ভুতেরা থাকে কি না। পরে জেনেছি, না, ভুতেরা থাকে না। থাকে অদ্ভ‚ত কিছু মানুষ। সত্তর দশকের শেষ ভাগে সেই ভুতের গলির বাসিন্দা হয়েছিলাম আমি। এখনও মাঝেমধ্যে পুরানো পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করতে সে গলিতে যাই। গলিটির প্রচলিত নাম ভুতের গলি হলেও আসল নাম ভজহরি সাহা স্ট্রিট। ভুতেরা এখন আর ওখানে থাকে না। কোনোকালে ছিল কি না তাও কেউ জানে না। তবে ঢাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, এ শহরটির যখন পত্তন হয়, তখন এসব এলাকা ঝাড়-জঙ্গল সমৃদ্ধ বিরান জনপদ ছিল। সে সময়ের মানুষদের হয়তো ধারণা জন্মেছিল ওই গলিটিতে ভুতেরা বসবাস করে। হয়তো ভুতুরে কোনো কাণ্ড তাদের মনে এ ধারণার জন্ম দিয়েছিল। 

না, রাজধানী ঢাকার অলিগলির নাম নিয়ে গবেষণার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আর ওটা আমার কম্মও নয়। কথাটি মনে পড়ল একটি গলি বা এলাকার নাম পত্রিকায় দেখে। ঢাকার মগবাজারের নয়াটোলায় গলিটির অবস্থান। নাম ‘ভদ্র গলি’। অদ্ভ‚ত নাম একথা অস্বীকার করা যাবে না। ধরেই নিচ্ছি ওই গলিতে যারা বসবাস করেন তারা ভদ্র। তাহলে রাজধানীর অন্যান্য অলিগলিতে যারা বসবাস করেন. তারা কি অভদ্রজন? কেন, কারা গলিটির নাম ‘ভদ্র গলি’ রেখেছে সে ইতিহ্সা হয়তো কারোই জানা নেই। তবে, ভদ্র গলির সুনাম বোধকরি আর ধরে রাখা গেল না। কারণ ওই গলিতে শুরু হয়েছে চাঁদাবাজির মতো অভদ্র কায়কারবার। ৪ মে সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই ভদ্র গলির একটি চক্র ‘মগবাজার সোসাইটি (ভদ্র গলি)’ নামে সংগঠন গড়ে এলাকাবাসীর কাছ থেকে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। সংগঠনের আহবায়ক জনৈক আলিমউল্লাহ খোকন তার স্বজন ও স্যাঙ্গাতদের নিয়ে দঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন এলাকাটি। নিরাপত্তা ও আইনশৃক্সখলা পরিস্থিতি রক্ষার দোহাই দিয়ে ওই গলির বাড়ি, ফ্ল্যাট এবং সব পর্যায়ের ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে প্রতি মাসে আদায় করা হচ্ছে ১২০ টাকা করে। পত্রিকাটির সরেজমিন ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সংগঠনের চাঁদাবাজিতে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। কিন্তু কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করার সাহস দেখাচ্ছেন না। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী পত্রিকাটিকে জানিয়েছেন, চলতি বছরের মার্চ মাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, গেট রঙ করা এবং নৈশ প্রহরীর খরচ বাবদ প্রতিটি বাড়ি থেকে তিন হাজারেরও বেশি করে টাকা আদায় করেছে ওই চক্রটি।  অভিযুক্ত আলিমউল্লাহ খোকন টাকা আদায়ের কথা স্বীকার করে বলেছেন, যারা সুবিধা ভোগ করবে তারাই তো টাকা দিবে। তবে, এই সোসাইটির কোনো রেজিষ্ট্রেশন নেই, নেই এলাকাবাসীর থেকে চাঁদা আদায়ের বৈধ কোনো অনুমোদন। বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, আলিমউল্লাহ খোকনের সাঙ্গপাঙ্গরা বলশালী হওয়ার কারণে এলাকাবাসী নীরবেই সবকিছু হজম করে চলেছে। তাদের এ ক্ষমতার উৎস কোথায়, কে বা কারা তাদের ওই গলিটি লীজ দিল, সে সম্পর্কে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। তবে, অনুমান করা যায়, এদের পেছনে এমন কোনো মুরব্বি আছেন, যিনি এদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। 

শুধু মগবাজরের ভদ্র গলিতেই  চাাঁদাবাজির অভদ্র কারবারের চলছে এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষা, সমস্যা সমাধান ইত্যাদির নাম করে এলাকাবাসীর কাছ থেকে এ ধরনের চাঁদা আদায় অনবরতই চলছে। 

ক’বছর আগে ঢাকার মতিঝিল-ফকিরেরপুল-আরামবাগ এলাকায় একজন কাউন্সিলর ছিলেন; যিনি ক্যাসিনোকান্ডের পর দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। তিনিও তার এলাকাবাসীর ওপর এ ধরনের কর ধার্য করেছিলেন। ওই এলাকাবাসীর অভিযোগ থেকে জানা গেছে, চাঁদাবাজি করে তার প্রতি মাসে আয় ছিল প্রায় কোটি টাকা। প্রতিটি দোকান, বাসা-বাড়ি, ব্যবসায়িক অফিস থেকে তার ক্যাডাররা মাসিক ভিত্তিতে ওই চাঁদা আদায় করত। ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের ঢাকা মহানগরীর যুগ্ম-সম্পাদকর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদের সাইনবোর্ডটি ছিল তার ক্ষমতার অন্যতম উৎস। তার ওপর হয়েছিলেন সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর। সুতরাং তার কেশাগ্র স্পর্শ করে এমন সাধ্যি কি কারো ছিল সে সময়? কিন্তু ওই যে কথায় আছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এমন এক ঝড় এলো, যে তা ওদের সাজানো রাজ্য একেবারে তছনছ করে দিয়ে গেল। এখন কেউ জেলে বসে বিচারের রায়ের অপেক্ষায় দিন গুজরান করছে, আর কেউ সবকিছু ফেলে পৈত্রিক প্রাণটি নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছে। 

 চাদঁবাজি শব্দটির সাথে পরিচয় নেই এমন কাউকে আমাদের দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এই অপকর্মটির শিকার হননা এমন কেউ নেই এদেশে। আর চাঁদাবজির ব্যাপক বিস্তারের কথা কে না জানে? কোথায় নেই চাঁদাবাজি? নগর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ, হাঁট-বাজার, অফিস-আদালত সর্বত্র চাদাবাজির দৌরাত্ম্য চলছে। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে এলাকা ভিত্তিক ক্যাডাররা চাঁদাবাজি করে থাকে। নিউমার্কেট গাওছিয়া, চাঁদনিচকের ব্যবসায়ীরা বহুবার চাঁদাবাজদের সাথে দ্ব›দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন। ঢাকার প্রতিটি ফুটপাথ এখন হকারদের দখলে। শুধু কি ফুটপাথ? রাস্তার দুই পাশের একটি বড় অংশও রয়েছে হকারদের দখলে। সেখানে চলে দেদার চাাঁদাবাজি। ক্যাডার নামের একটি গ্রুপ এ চাঁদাবাজির দেখভাল করে। তাদের রয়েছে লাইনম্যান নামের সাগরেদ, যারা ফুটপাথের ওইসব দোকানির কাছ থেকে দৈনিক হারে চাঁদা আদায় করে থাকে। আদায় হওয়া এসব চাঁদার গন্তব্য অনেক দূর, অনেক উঁচুতলা পর্যন্ত। রাজনৈতিক দলের কর্মী, নেতা, পুলিশের সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক শ্রেণির কর্তাব্যক্তি এসব চাঁদার টাকার অংশ পেয়ে থাকেন। ফলে চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠরা প্রতিকারের জন্য কোথাও যে যাবেন সে উপায় নেই। কারণ সব রসুনের এক শেকড়ের মতো এরা সবাই একই গোত্রভ‚ক্ত। 

সবচেয়ে বড় চাঁদাবাজির ঘটনাটি ঘটে পরিবহন সেক্টরে। প্রতিটি বাস টার্মিনালে, বাস স্ট্যান্ডে মালিক সমিতি, শ্রমিক কমিটি, কল্যাণ ফান্ড নানা নামে আহরণ করা হয় চাঁদা। শ্রমিক কল্যাণের নামে প্রতিদিন সারা দেশে আদায় করা হয় কয়েক কোটি টাকা চাঁদা। ওই টাকা পরিবহন শ্রমিকদের কোন কল্যাণে লাগে কিনা কেউ জানে না। বিপদে পড়লে কোনো পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড থেকে কোনো সাহায্য পেয়েছে এমন নজির নেই। তবে এই চাঁদা পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা প্রাথমিক পর্যায়ে পরিশোধ করলেও শেষ পর্যন্ত তা বর্তায় যাত্রীদের ঘাড়ে। পরিবহন ভাড়ার সঙ্গে চাঁদার টাকার অঙ্কটি যোগ করেই তারা আদায় করে ভাড়া। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শ্রমিকদের নামে আদায় করা হলেও তাতে ভাগ্য খোলে শ্রমিক নেতা নামে একটি শ্রেণির। এদের প্রায় সবার গায়ে আবার রাজনৈতিক জার্সি রয়েছে। যখন যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে, সে দলের নেতারা নিয়ন্ত্রণ করে সড়ক পরিবহন খাতের চাাঁদাবাজি। আরো মজার ব্যাপার হলো, রাজহনৈতিক বিভেদ-বৈরিতা থাকলেও এই চাঁদার ব্যাপারে তাদের একটি অলিখিত সমঝোতা আছে। যারা ক্ষমতায় থাকেন তার সিংহভাগ পান, আর যারা ক্ষমতায় থাকেন না, তারা কম হলেও একেবারে বি ত থাকেন না। 

সড়কপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে রয়েছে চাঁদাবাজির উৎপাত। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যটি ঢাকা বা বড় শহরে আসতে কয়েক ঘাটে চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদার কারণে দশ টাকার ফুলকপিটির দাম ঢাকা শহরে হয়ে যায় পঞ্চাশ টাকা। সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবজি ব্যাপক আকার ধারণ করে কোরবানীর ঈদের সময়। পশু বহনকারী ট্রাকগুলো শিকার হয় চাঁদাবাজির। চাদাবাজদের চাহিদা না মিটিয়ে পশু বোঝাই ট্রাক ঢাকা বা নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাবার চিন্তাও করা যায় না। বলতে পারেন পুলিশ কি করে। ওই যে কথায় আছে- ‘ভুত তাড়ানো সর্ষেতেই ভুতের বাসা’। এক্ষেত্রে সেটাই প্রযোজ্য। সড়ক-মহাসড়কে গবাদিপশু বা পণ্য বোঝাই ট্রাকে বেপরোয়া চাঁদাবাজির সাথে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা গোপন কোনো বিষয় নয়। এসব নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু খবর বেরিয়েছে, সম্পদকীয়-উপসম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি রয়ে গেছে যথা পূর্ব তথা পরং। মাঝেমধ্যে অবশ্য এইসব চাঁদাবাজি বন্ধের হুংকার শোনা যায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কর্তাব্যক্তিদের বায়বীয় হুংকার ইথারেই মিলিয়ে যায়।

কিছু মানুষ আছে (আসলে তারা মানুষ পদবীর যোগ্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে) যারা দৃশ্যমান কোনো পেশার সাথে জড়িত নয়। অথচ দিব্যি শান-শওকতের সাথে জীবন যাপন করছে। কেউ কেউ বিত্ত-বৈভবে সমাজের উঁচুতলার মানুষ! চাঁদাই এদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন। তারা আবার রাজনৈতিক পরিচয়ধারী। যখন দল ক্ষমতায় থাকে এদের চাঁদাবাজির পরিধি বেড়ে যায়। আর যখন ক্ষমতায় থাকে না, তখন নিজেদের দলের ভেতররেই প্র্যাকটিসটা অব্যাহত রাখে। তখন এরা কমিটি কিংবা পদ বিক্রি করে বেঁচেবর্তে থাকে। এমন দু’য়েকজনের কথা জানি, যারা কোনো কাজকর্ম না করেও ঢাকায় একাধিক বাড়ি করেছেন, চড়েন দামি বিলাসবহুল গাড়িতে।

এ কথা বলা নিশ্চয় অত্যুক্তি হবে না যে, ‘চাঁদাবাজি শিল্পে’র যে ব্যাপক প্রসার আমাদের দেশে হয়েছে, সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলো এবং প্রশাসনের একটি অংশ সমানভাবে দায়ী। চাঁদাবাজ হিসেবে যারা সমাজে পরিচিত, তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকে ওই দুটি জায়গা থেকেই। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, যে কোনো অপরাধের বিস্তারের পেছনে প্রভাবশালীদের মদত টনিকের ন্যায় কাজ করে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক অশ্রয়- প্রশ্রয় অপরাধীদের অন্যতম রক্ষাকবচও। নামের সাথে রাজনৈতিক পরিচয় যুক্ত থাকলে সমাজে সহজে কেউ তাকে ঘাটাতে চায় না। প্রশাসনের লোকেরাও খাতির করে। অবশ্য এ খাতির বেশিরভাগ সময় হয়ে থাকে পারস্পরিক লেনদেন ও ভাগ বাটেয়ারা ভিত্তিক।  

মগবাজারের ‘ভদ্র গলি’তে চাাঁদাবাজির যে অভদ্র কাজটি চলছে, তার পেছনে মদতদাতা কে বা কারা তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে কোনো না কোনো ‘বড়ভাই’ যে এর পেছনে রয়েছে তা অনুমান করা যায়। কিন্তু থানা পুলিশ কী করছে? তারা কি দেখছে না এ অপরাধ? পত্রিকায় রিপোর্ট বেরোনোর পর প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে এখন পর্যন্ত তা শোনা যায় নি। আদৌ তা নেওয়া হবে কি না তাও বলা যাচ্ছে না। তবে, ভদ্র গলির ভদ্রলোকদের যে মুখ বুঁজে নীরবেই এ অত্যাচার সহ্য করতে হবে, তা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। কারণ ভুত তাড়ানোর সর্ষেই যে ভুতাক্রান্ত। 

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।