১৩ বছরে প্রথম বিদেশি চাপে সরকার?
প্রকাশ : 2022-01-07 09:56:02১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
টানা তৃতীয় মেয়াদে ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সরকার প্রথমবারের মতো ‘বিদেশি চাপের মুখে’ পড়েছে বলে মনে করছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তবে দেশের কোনো সরকারের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্তি করতে না পারা, দেশি ও বিদেশি চাপে অস্থিতিশীলতা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি একবার ক্ষমতায়, তো পরেরবার বিরোধীরা—এ ধারা গত এক যুগে বদলে দেয় আওয়ামী লীগের সরকার। আগামীকাল ৭ জানুয়ারি টানা ১৩ বছর পূর্ণ করছে সরকার। আরেকটি বছর পূর্তির সময়ে সরকার কতটা ‘বিদেশি চাপের’ মুখোমুখি?
নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান সংলাপে বিএনপি ও দলটির নেতৃত্বের জোট অংশ না নেওয়ার ঘোষণা কী দেশের ভেতরে ‘চাপে’ ফেলতে পেরেছে সরকারকে? ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে’ গত বছরের ডিসেম্বরে র্যাব ও সংস্থাটির সাবেক কয়েক কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং একই মাসে অনুষ্ঠিত দেশটির প্রেসিডেন্টের ‘গণতান্ত্রিক সম্মেলনে’ বাংলাদেশের আমন্ত্রণ না পাওয়াকে ‘বিদেশি চাপ’ হিসেবে দেখছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। অতীতে দেশে বিভিন্ন সরকারের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্তি করতে পারা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সামরিক হস্তক্ষেপ, আন্দোলন ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে টেনেহিঁচড়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছিল।
গত ১৩ বছরে ধারাটি পাল্টে দেয় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার এ দেশে একটি স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ ও দেশি-বিদেশি চাপ বেশ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতৃত্বের টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের তৃতীয় বছরপূর্তি হচ্ছে ৭ জানুয়ারি। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ নেয়।
সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্র মত ও পথকে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথমবার আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক সম্মেলনে’ বাংলাদেশের আমন্ত্রণ না পাওয়ায় ‘কূটনৈতিক সম্পর্কে’ অবনতির কিছু নেই। অনেক দেশের নামই প্রথমবারের আমন্ত্রিত তালিকায় ছিল না। পরের বারের সম্মেলনে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পাবে বলে আশাবাদী। র্যাব ও সংস্থাটির সাবেক কয়েক কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে দুইদেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। কোনো কিছুই টানা তৃতীয়বারের সরকারের পথচলায় রাজনৈতিক অস্বস্তির সৃষ্টি করতে পারেনি। দেশি ও বিদেশি সব চাপ দূরে ঠেলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে সরকার শুরু থেকেই অনেকটা নির্ভার বলে সূত্রের দাবি।
ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে বিএনপির অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে আমলে নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। দলটি বলছে, বিএনপি সংলাপে এলো কি এলো না, তার ওপর ফলাফল নির্ভর করবে না। কেউ না এলেও ইসি গঠন থেমে থাকবে না। সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলেই রাষ্ট্রপতি ‘স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন কমিশন উপহার দেবেন। ২০১২ ও ২০১৬ সালেও রাষ্ট্রপতি সংলাপের আয়োজন করেন। ওই দুটি সংলাপের পর গঠিত সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। বিএনপি বলছে, দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে নিরপেক্ষ ইসি গঠন হলেও কোনো লাভ নেই। তাই আগে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায় করতে হবে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি বিদেশিদের কাছে নানা অভিযোগ তুলে ধরে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছেও ঐক্যফ্রন্ট অভিযোগ জানায়। কোনো কোনো দেশ ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচার’ হিসেবে ঐক্যফ্রন্টের অভিযোগ তদন্তে সরকারকে আহ্বান জানালেও প্রায় পুরো বিশ্ব সম্প্রদায় নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানায়। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে তারা। নির্বাচন সব দলের অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ায় তারা একে ইতিবাচক হিসেবে দেখে।
সরকারের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার করে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো। ফলে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর যে চাপ তৈরি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তা সরকার গঠনের পরপরই কেটে যায়। নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ থাকলেও বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট সরকারবিরোধী সফল কোনো আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে পারেনি সাংগঠনিক দুর্বলতা ও নেতৃত্বে সমস্যার কারণে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যার মধ্য দিয়ে এ দেশে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থার ওপরে প্রথম বড় আঘাত আসে। এরপর থেকে দেশের রাজনীতি ও সরকারব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তী সময়ে এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় থেকে দল গঠন করলেও কেউই সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। এরশাদ সরকারের পতনের পরে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি। সর্বশেষ ২০০৬ সালেও ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতায় অচলাবস্থা তৈরি হলে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আলোচিত এক-এগারো পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ দেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই প্রথম কোনো দল যে টানা তিন মেয়াদে দেশ শাসন করছে।
তবে গত ১৩ বছরে নানা রাজনৈতিক সহিংসতা ও ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে হয়েছে সরকারকে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ের পর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এক-এগারো পরবর্তী সেই কঠিন সময়ে সরকার পরিচালনা ও দলকে সুসংগঠিত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ বেশ ভালোভাবেই উতরে যায়।
সরকারের শুরুতেই বিডিআর বিদ্রোহের মতো একটি ঘটনা সামাল দিতে গিয়ে অনেক বেগ পোহাতে হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট। বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্পন্ন করে আবারও ক্ষমতায় যাওয়া এবং সরকার পরিচালনা করতে পারা অনেক দুরূহ কাজ ছিল। সেখানেও সফল হয় সরকার।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিলে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের লাখো নেতাকর্মী জমায়েত হয়ে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে। সে সময়ে ওই গোষ্ঠীকে মোকাবেলা করতে সফল হয় সরকার।
এ ছাড়া দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শাস্তির পর তাঁকে কারাবন্দি করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সে চ্যালেঞ্জ তারা সফলভাবে সামাল দেয়। এর বাইরে দেশি ও বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই সরকার দেশকে একটি স্থিতিশীল জায়গায় আনতে সক্ষম হয়।
গত ১৩ বছরে সরকারের সাফল্য ও অর্জন অনেক, ব্যর্থতাও আছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়েই মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপিত হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে মুজিববর্ষ হিসেবে উদযাপিত হয় এ সরকারের নেতৃত্বেই। সরকারবিরোধীরা দেশে গণতন্ত্র না থাকার অভিযোগ তুললেও দেশের যে প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই কারো। ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকায় দেশকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।