সেই ভয়ঙ্কর সকালের কথা বলছি

প্রকাশ : 2021-08-16 13:53:09১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

সেই ভয়ঙ্কর সকালের কথা বলছি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা মনে হলে এখনও বুকটা কেঁপে ওঠে, চোখ ভিজে আসে। ওই দিনটি আমাদের জন্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার তথা ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য হওয়ার কথা ছিলো অত্যন্ত আনন্দ-উচ্ছ্বাসময়, স্মরণীয় একটি দিন। রাষ্ট্রপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের কথা ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার তাঁকে স্বাগত জানাতে, বরণ করতে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিলো। বেশ কদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে চলছিলো সাজগোজ, আয়োজন, প্রস্তুতি।

আমরা যারা ছাত্রকর্মী, যারা বঙ্গবন্ধুকে বরণ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নানা প্রস্তুতি-কাজে যুক্ত ছিলাম, আমাদের মধ্যে চলছিলো দারুণ উত্তেজনা। বঙ্গবন্ধুকে আমরা আবার খুব কাছ থেকে দেখতে পাবো, শুনতে পাবো তাঁর জাদুকরী কণ্ঠস্বর। সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য তাঁর নতুন রাজনৈতিক পরিকল্পনার কথা তিনি তুলে ধরবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক-কর্মচারীদের সামনে, যে বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে সূতিকাগার হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট রাতের আঁধার কেটে দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কানে এলো সেই ভয়াবহ দুঃসংবাদ। ঘাতক মেজর ডালিমের নির্দয় কণ্ঠ ইথারে ছড়িয়ে দিয়েছে সেই নিষ্ঠুর শব্দাবলী: ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে'!

বলে কী? এ-ও হতে পারে!
পাকিস্তানি জালেমরা অনেক ষড়যন্ত্র করে, বিচারের নামে প্রহসন করে যাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করতে চেয়ে সফল হতে পারেনি, তাঁর বক্ষ ভেদ করেছে, তাঁরই সৃজিত স্বাধীন বাংলাদেশের কতিপয় কুলাঙ্গার বাঙালি সৈনিকের ছোঁড়া বুলেট! না না, এ হতে পারে না। এ মিথ্যা। এ অপপ্রচার। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শত্রুরা, পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা নিশ্চয়ই কোনো গোপন বেতার থেকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াসে চালাচ্ছে।

হ্যাঁ, প্রথম যখন শুনি বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা, তখন প্রাথমিকভাবে আমার মতো অনেকের এ রকমই মনে হয়েছিলো। কারণ এ খবর ছিলো অবিশ্বাস্য। আকাশ ভেঙে মাটিতে পড়তে পারে, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা কীভাবে সম্ভব!

বঙ্গবন্ধুর আগমম উপলক্ষ্যে বেশ কয়েক দিন ধরেই সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চলছিলো পরিচ্ছন্নতা অভিযান। শিল্পীরা তৈরি করছিলেন দৃষ্টিনন্দন তোরণ ও অন্যান্য উপকরণ। এর মধ্যেই ১৪ আগস্ট দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এলাকা, কার্জন হল ও অ্যানেক্স ভবনে একযোগে তিনটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছিলো। ভোরের দিকে জগন্নাথ হলের উত্তর গেটের (শামসুন্নাহার হলের উল্টোদিকে) দেয়ালে সাঁটা পাওয়া গিয়েছিলো কাগজে তৈরি একটি ছোট্ট পাকিস্তানি পতাকা।

বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগের দিনের এ ঘটনাগুলো সে সময বিচ্ছিন্ন বলেই আমাদের অনেকের কাছে মনে হয়েছিলো। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ‘স্বাধীনতা’ দিবস, তাই হয়তো পাকিস্তানপন্থীরা এসব করে নিজেদের হারানো মনোবল ফিরে পাবার দুঃস্বপ্ন দেখাচ্ললো। কিন্তু পরে বোঝা গেছে, এগুলো ছিল তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ।

তখন দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছিলো। নাশকতা-অন্তর্ঘাতের মাত্রা বাড়ছিলো। দুর্ভিক্ষের কবলেও পড়েছিলো দেশ। সদ্যস্বাধীন দেশের সমাজ ও রাজনীতি অস্থিতিশীল করার নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ১৯৭৫ সালের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন দেশে সক্রিয় এবং ইচ্ছুক সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল– বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ– সংক্ষেপে, বাকশাল।

 বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তনে একদলীয় ‘বাকশাল’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে দেশের রাজনীতিতে কিছুটা গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো বৈকি। বাকশাল নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা যতোটা ছিলো, তার চেয়ে বেশি ছিলো সন্দেহ-সংশয়। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে সমান আগ্রহ ছিলো না। আবার বাকশাল এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা অর্থাৎ পদ-পদবি পাওয়া না-পাওয়া নিয়েও ছিলো অসন্তোষ-ক্ষোভ। পদবঞ্চিতরা ছিলেন হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আবার যারা পদ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যেও বাকশাল ব্যবস্থার সাফল্য বা অগ্রযাত্রা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিলো।

আওয়ামী লীগের মধ্যে অসন্তোষ ছিল ‘ক্ষমতার’ ভাগ যৎসামান্য হলেও অন্যদের হাতে চলে যাওয়ায়। আবার অন্যরা, বিশেষত বাকশাল নিয়ে অতিউৎসাহী বলে মনে হওয়া সিপিবি-ন্যাপও শেষ পর্যন্ত খুশি হতে পারেনি বাকশালের কমিটিতে তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব না থাকায়।

বাকশালের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটিতে ন্যাপ-সিপিবির কেউ ঠাঁই পাননি। ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ অন্তত ওই কমিটিতে থাকবেন বলে আশা করা হয়েছিলো। কিন্তু সেটা হয়নি। আবার আওয়ামী লীগের যাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ ছিলো, যাদের নিয়ে বিতর্ক ছিলো তাদের ঠিকই জায়গা হয়েছিলো ওই কমিটিতে।

বাকশালের কমিটি গঠনের পর ন্যাপ-সিপিবির কর্মীরা অনেকটাই চুপসে গিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতের ন্যাপের সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্যের নামও ছিলো না। আবার ন্যাপ যাকে পছন্দ করতো না সেই সৈয়দ আলতাফ হোসেন কেবল বাকশালের কমিটিতে নয়, মন্ত্রিসভায়ও জায়গা পেয়েছিলেন। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ ছাড়া আর কোনো নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন না। কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মণি সিংহ জাতীয় কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন, মূল বাকশালে ছিলেন না।

২৩ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় ছাত্রলীগের কমিটিতে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধি ছিলেন মাত্র ৫ জন। আবার ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ‘বহিষ্কৃত’ ডা. শাহাদৎ হোসেন ঠিকই ওই ২৩ জনের মধ্যে ছিলেন। ডা. শাহাদাৎ আওয়ামী লীগ নেতা মোজাফফর হোসেন পল্টুর ছোট ভাই। তখন অনেকেই ভেবেছিলো, ছাত্র ইউনিয়নকে ‘জব্দ’ করার জন্যই শাহাদৎ হোসেনকে জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হয়েছিলো।

মোট কথা, বাকশাল গঠনকে  কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে নতুন গতিবেগ প্রতিষ্ঠার যে আশা ছিলো, বাস্তব সে রকম ছিলো না। বরং এক ধরনের সন্দেহ-অবিশ্বাস নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিলো। তারপরও ধরে নেওয়া হচ্ছিলো যে, ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাবে, কিছুটা সময় পেলে বঙ্গবন্ধু সবকিছু সামাল দিতে পারবেন। তখন সব কিছুই আবর্তিত হচ্ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই। মানুষের সব স্বপ্ন-প্রত্যাশাই ছিল তাঁকে ঘিরে। এমনকি বাকশালে যে সব রাজনৈতিক দল ও নেতারা যোগ দিয়েছিলেন, সবাই তাঁর মুখ চেয়েই তা করেছিলেন।

আমার মনে আছে, ছাত্রকর্মীদের বাকশাল সম্পর্কে উৎসাহিত করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির একটি সভায় পার্টির একজন প্রবীণ নেতা বলেছিলেন: ‘‘আশঙ্কার কিছু নেই। বঙ্গবন্ধু আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তিনি সমাজতন্ত্রের পথেই চলবেন।’’
একজন ছাত্রকর্মী অকস্মাৎ প্রশ্ন করলেন: ‘বঙ্গবন্ধুর যদি কিছু হয়…’

ছাত্রকর্মী কথা শেষ করতে না করতেই আকাশে রাশিয়ার তৈরি একটি মিগ বিমান ওড়ার তীব্র শব্দ শোনা যায়। মিগের শব্দ শুনে প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। তিনি বললেন: ‘দেখছো না, ঢাকার আকাশে রাশিয়ার মিগ উড়ছে। বঙ্গবন্ধুর কিছু হওয়া খুব সহজ নয়'।

বাকশাল গঠনের পর আওয়ামী লীগের ভেতরেও নানা স্রোত বইছিলো। আওয়ামী লীগে যারা রক্ষণশীল বা ডানপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন, খন্দকার মোশতাক গং, তারা কিন্তু ‘ষড়যন্ত্র’ থেকে পিছু হটেননি। তারা চাপ দিয়ে বাকশাল এবং বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতৃত্বে যেমন জায়গা করে নিয়েছিলেন, তেমনি কমিটিতে ঢুকেও বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ ব্যর্থ করার অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকেননি।

 বাকশাল ব্যবস্থার বিরোধিতা করে এবং বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয় আগমন আয়োজনের সমালোচনা করে একটি লিফলেট ছাপতে দেওয়া হয়েছিলো নবাবপুরের ভেতরের দিকে একটি ছাপাখানায়। ওই ছাপাখানার মালিক ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. মুশাররফ হোসেনের ভাই। লিফলেট ছাপার খবরটি যেকোনো উপায়েই হোক না কেন, আগেভগে জেনে গিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এবং সে সময় জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কাজী আকরাম হোসেন। আকরাম ভাই আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওই প্রেসে গিয়ে ছাপা লিফলেটগুলো বিলি হওয়ার আগেই নষ্ট করে দিয়েছিলেন।

ওই লিফলেট ছাপার পেছনে ছিলেন জাতীয় ছাত্রলীগেরই এক বা একাধিক সদস্য, যিনি বা যারা ১৫ আগস্টের পর খন্দকার মোশাতাকের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।

আবার আসা যাক, সেই ভয়াবহ ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে। পরিকল্পনা ছিলো বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। প্রথমে তিনি জগন্নাথ হলে গণকবরে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে তারপর টিএসসিতে গিয়ে ভাষণ দেবেন। সে জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিক দিয়ে, অর্থাৎ জগন্নাথ হলের দক্ষিণ গেট দিয়ে ঢুকে উত্তরবাড়ির সামনে নির্মিত স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে হলের উত্তর গেট অর্থাৎ শামসুন্নাহার হলের সামনে দিয়ে বেরিয়ে টিএসসিতে যাবেন।

যেহেতু তিনি জগন্নাথ হলে প্রথম আসবেন, সেহেতু হলের ছাত্র হিসেবে আমাদের ওপর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিশেষ দায়িত্ব ছিলো। স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বানানো হয়েছিলো বিশেষ ক্যাম্প (টুপি) এবং স্কার্ফ। জগন্নাথ হলের উত্তরবাড়ির নিচতলায় একটি রুমে এসব টুপি ও স্কার্ফ রাখা ছিলো, ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে বিতরণের জন্য।

১৪ আগস্ট গভীর রাত পর্যন্ত আমরা ব্যস্ত ছিলাম। খুব অল্প সময় হয়তো ঘুমিয়েছিলাম। কারণ খুব ভোরে ওঠার গরজ ছিলো। শেষরাতে ঘুম চোখেই গোলাগুলির শব্দ শুনে মনে নানা আশঙ্কা তৈরি হলেও আমাদের এক ‘দাদা’ আমাদের এই বলে আশ্বাস্ত করেন যে, বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে কোনো হলের ছাত্ররা হয়তো বাজি ফুটিয়ে উল্লাস করছে।

তাড়াতাড়ি স্নান সেরে প্রস্তুত হয়ে সকাল ছয়টার মধ্যেই হলের উত্তরবাড়ির ক্যান্টিনে নাস্তা খেতে যাই। নাস্তা শেষে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে পান-সিগারেটের ছোট দোকানের সামনে আসতেই  জীতেনদা কাঁপতে কাঁপতে ছোট একটি রেডিও আমার সামনে এগিয়ে ধরে বলেন: ‘বাবু, রেডিওতে এসব কী বলছে'!

আমি স্পষ্ট শুনতে পাই রেডিওর ঘোষণা : ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ আমারও হাত-পা কাঁপতে থাকে। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। মুখ দিয়ে কোনো কথাও বের হয় না। পা অবশ হয়ে আসে। সামনে এগিয়ে কাউকে যে কিছু বলবো তাও পারি না।

কয়েক মুহূর্ত এ রকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় থাকার পর চোখ যায় হলের স্মৃতিসৌধের দিকে। দেখি নিরাপত্তাকর্মীরা কী এক যন্ত্র দিয়ে মাঠ পরীক্ষা করছেন। বঙ্গবন্ধু এখানে নামবেন এবং সৌধে ফুল দিবেন বলেই এই ব্যবস্থা। ধীর পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে রেডিওর ঘোষণা সম্পর্কে জানতে চাইলে, তারা ধমক দিয়ে বলে ওঠেন: ‘কী গাঁজাখুরি কথা বলছেন? ওটা নিশ্চয়ই পাকিস্তানি রেডিওর কাজ'।

আহা, ধারণাটা যদি সত্যি হতো!
এর মধ্যেই লক্ষ্য করি হলের ছাত্ররা একে একে রুম থেকে বেরিয়ে আসছে। সবার চোখেমুখেই আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা। কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না। অথচ রেডিওতে ঘোষণা ক্রমাগত চলতে থাকায় বিহ্বলতাও কাটছে না। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশ নিশ্চয়ই এখন প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ফেটে পড়বে।

জগন্নাথ হলে জাতীয় ছাত্রলীগের তিনজন কেন্দ্রীয় নেতা থাকেন। তারা কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু বলতে পারলেন না। খবরাখবর জানার জন্য তারা দ্রুত হল থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমরা দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। সত্যি কি বঙ্গবন্ধু আর বেঁচে নেই? কী হবে এখন তাহলে?

সকাল সাড়ে আটটার দিকে একটি মোটর সাইকেলে চেপে জগন্নাথ হলে আসেন জাতীয় ছাত্রলীগের প্রভাবশালী দুই নেতা, ইসমত কাদির গামা এবং কাজী আকরাম হোসেন। তারা জানান, ঘটনা সত্য। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাসায় ঢুকে ঘাতকরা পরিবারের অন্য সদস্যসহ হত্যা করেছে।

এখন আমরা কী করবো?
তারা বললেন: 'আপনারা অপেক্ষা করুন। আমরা সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনাদের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানাচ্ছি'। তারা চলে গেলেন। হলের ছাত্ররা সবাই একেবারে বিমর্ষ হয়ে পড়লো। এতোক্ষণ যে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব চলছিলো, এখন আর তা নেই। সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধু আর নেই। সব শেষ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা যে উল্টোপথে যাত্রা শুরু করছে তা স্পষ্ট হয়ে যায় ১৫ আগস্ট প্রভাতেই বাংলাদেশ বেতারের নাম পাকিস্তানের স্টাইলে রেডিও বাংলাদেশ বলার মধ্য দিয়ে।

সবাই যখন কিছু একটা করার জন্য ছটফট করছে, কিন্তু হতবিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না, তখন আমার হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে দেখেই আসি না কী ঘটেছে বা ঘটছে!অসীম দাশগুপ্তকে বলায় তিনিও আমার সঙ্গে যেতে রাজি হলেন। আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের উদ্দেশ্যে।

 জগন্নাথ হল থেকে বেরিয়ে দেখতে পাই শামসুন্নাহার হল ও রোকেয়া হলের ভেতরে ছাত্রীরা ভয়ে-আতঙ্কে ছোটাছুটি করছেন। কেউ কেউ কান্নাকাটিও করছেন। চিৎকার করে জানতে চাইছেন, তারা কী করবেন সে কথা। কিন্তু কে তাদের করণীয় জানাবে? সবাই তো ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়-বিমূঢ়। বঙ্গবন্ধুকে কেউ মেরে ফেলতে পারে সেটা যেমন ছিলো ভাবনার বাইরে, তেমনি তাকে হত্যা করলে কী করণীয় সেটাও যেন কারও ভাবনার মধ্যে নেই।

শামসুন্নাহার হলের সামনে বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে একটি সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিলো। তাতে লেখা ছিলো: ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছো জ্যোতির্ময়, তোমারই হোক জয়।’ তোরণ পার হওয়ার সময় লক্ষ করলাম, কেউ একজন কাঁচা হাতে এক কোণায় লিখে রেখেছে– ‘দেশকে যারা গোষ্ঠীচক্রের হাত থেকে রক্ষা করলো তাদের সালাম।’

আমার বিস্ময়ের শেষ থাকে না। মাত্র ঘণ্টা তিন- চারেকের মধ্যেই কে এই নতুন স্লোগান লিখলো? সে কি খুব দূরের কেউ? নাকি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত-স্তাবকদের মধ্যেই লুকিয়ে ছিলো?

আমি আর অসীম দাশগুপ্ত (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক)  রোকেয়া হলের দিকে মোড় নেওয়ার আগেই দেখতে পাই শাহবাগের দিক থেকে একটি ট্যাংক টিএসসির দিকে এগিয়ে আসছে। ট্যাংক আসতে দেখে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। যে দিকে পারে ছুটতে থাকে। আমরা নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি অতিক্রমের সময় দেখি ফাঁড়ির পুলিশরাও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ছাত্রদের কাছে তাদের কিছু করার আছে কি না জানতে চাইছে। কিন্তু নির্দেশনা দেওয়ার মতো কাউকেই যে পাওয়া যায়নি।

আমরা নিউ মার্কেট হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ধানমণ্ডির দিকে এগোতে থাকি। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। দুয়েক জায়গায় ছোট জটলা। কেউ উচ্চস্বরে কথা বলছে না। কলাবাগান মাঠের কাছে গিয়ে দেখি রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে মানুষের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে কালো পোশাক পরা সামরিক লোকজন। রাস্তা ফাঁকা। আমার মনে হয়েছিলো, অসংখ্য মানুষ হয়তো ততোক্ষণে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে ছুটে গেছে। কিন্তু তেমন কিছু না দেখে যারপরনাই হতাশ ও ব্যথিত হলাম।

মাত্র পাঁচ মাস আগে, ১৭ মার্চের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো । সেদিন ছিলো বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ৩২ নম্বরে নেমেছিলো মানুষের ঢল। আমরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতীয় ছাত্রলীগের ব্যানারে মিছিল নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে। দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে বঙ্গবন্ধু সমাগত জনতার প্রতি শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন, ছাত্রদের মিছিল পৌঁছানোর পর তিনি নিচে নেমে আসেন। নিরাপত্তার কথা না ভেবে তিনি ছাত্রদের মধ্যে মিশে যান।

এমন একজন হৃদয়বান দেশঅন্তপ্রাণ নেতাকে আজ সপরিবারে হত্যা করলো যারা, তারা কেমন মানুষ? আদৌ কি তারা মানুষের পর্যায়ে পড়ে?

আমি আর সেই অসীমদা ঘুরপথে ভেতর দিয়ে ৩২ নম্বরের কাছাকাছি সড়কে উপস্থিত হই। কিন্তু মূল সড়কে যেতে আমাদের বাধা দেওয়া হয়। এখানেও ওই কালো পোশাকধারীদেরই অস্ত্র হাতে পাহারা দিতে দেখি। একজন সৈনিকের কাছে আমি ঘটনা জানতে চাইলে ওই সৈনিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভঙ্গিতে বলেন : ‘মুজিবের গুষ্ঠি শেষ'!

আমি জানতে চাই: ‘‘সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে? আপনারা কারা? আপনাদের নেতা কে?’’

আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে ওই সৈনিক ‘ভাগ ভাগ’ বলতে থাকেন। আমরা একটু সরে যাই, কিন্তু চলে যাই না। আবারও আগের প্রশ্ন করি। এবার সৈনিকটি চোখ পাকিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখিয়ে বলে: ‘ওর ভেতরে কেউ আর জীবিত নেই'!
 
আমাদের আর কিছু জানতে ইচ্ছে হয় না। হাত-পা আবার অবশ হয়ে আসে। মাথায় কোনো চিন্তা আসে না। কোথায় কী হচ্ছে জানার ইচ্ছা হয় না। আমরাই-বা কী করবো বুঝে উঠতে পারি না। কোথায় যাবো, কী করা উচিত কিছুই ঠিক করতে না পেরে ৩২ নম্বরের উল্টোদিকের এক গলিপথে বসে পড়ি। মনে হতে থাকে, ওখান থেকে আর বোধহয় উঠতে পারবো না।

সেদিন ছিলো শুক্রবার। জুমার নামাজ পড়ার জন্য দলে দলে মানুষকে মসজিদের দিকে যেতে দেখি। এর আগে ঢাকা শহরে এত নামাজি দেখেছি বল মনে পড়ে না। হঠাৎ আমার ভেতর একটি ভাবনা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ভালো হবে যদি নামাজ শেষে এই মানুষেরা প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে রাজপথে নামে। আমিও ওই মিছিলে শামিল হবো।

কিন্তু নামজ শেষে কাউকে মিছিল করতে দেখি না। কারও মুখে স্লোগান নেই। সবাই চুপচাপ। যার যার গন্তব্যে সবাই হাঁটতে থাকে। এ কি অধিক শোকে পাথর, নাকি অন্য কিছু? মানুষের এই প্রতিক্রিয়া আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। বঙ্গবন্ধু এত বড় নেতা। এত তাঁর ভক্ত। অথচ তাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর মানুষের এই নিরবতার ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যায়। আমরা বসে থাকি কলাবাগানের এক গলির মধ্যে। হলে ফিরব কি না, ফিরলে কী হবে সে সব যখন ভাবছি, তখন সঙ্গী অসীমদা প্রস্তাব দেন কলাবাগানে তার এক বোন-ভগ্নিপতির বাসায় যাওয়ার। খুব কিছু না ভেবেই সন্ধ্যার দিকে ওই বাসায় গিয়ে উঠি আমরা দুজন। আমাদের দেখে বোন-ভগ্নিপতি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। আমরাও অশ্রু সম্বরণ করতে পারি না। এভাবে কতোক্ষণ অশ্রুপাতের পর যেন কিছুটা হালকা বোধ করলাম। বঙ্গবন্ধুর জন্য আর কিছু না হোক ক'ফোটা চোখের জল ফেলার সান্ত্বনা নিয়েই কেটে যায় ঘোর দুঃস্বপ্নের ১৫ আগস্ট দিনটি।

আমাদের পেটে সারাদিন আর দানাপানি পড়েনি। যে বাসায় গিয়ে উঠেছিলাম সে বাসায়ও সারাদিন চুলায় হাঁড়ি চড়েনি। ঘাতকদের বিরুদ্ধে সেদিন এটাই আমার কাছে এক ধরনের প্রতিবাদ বলে মনে হয়েছিলো।

লেখকঃ জেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক