সুরো কৃষ্ণ চাকমার সাফল্যে উদ্ভাসিত বাংলাদেশের বক্সিং
প্রকাশ : 2023-06-26 15:50:55১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
খেলা হিসেবে বাংলাদেশে প্রো বক্সিং, অর্থাৎ পেশাদারি বক্সিং একদমই নতুন। তবে অনন্য সাফল্যের মধ্য দিয়ে এই নতুন খেলাটিকেই দেশের মানুষের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলছেন সুরো কৃষ্ণ চাকমা। তীব্র আকাঙ্ক্ষা, দৃঢ় সংকল্প আর আত্মবিশ্বাসের মধ্য দিয়ে অসম্ভব সব বাধা অতিক্রমের ইতিহাস গড়ে চলেছেন সুরো, প্রমাণ করে যাচ্ছেন – নিজের সক্ষমতার ওপর পূর্ণ আস্থা আর লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ় প্রত্যয় থাকলে কোনো স্বপ্ন পূরণই অসম্ভব নয়। তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে কোনো সীমানা দিয়েই বেঁধে রাখা যায় না, যা সুরো এরই মাঝে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর এভাবেই ক্রীড়াপ্রেমীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের প্রথম প্রফেশনাল বক্সার।
রাঙামাটির যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুরোর উঠে আসার গল্পটি শুরু হয়, সেখানে বাধাবিপত্তিই ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা, বিশেষ করে ফুটবলের প্রতি তার ভীষণ ঝোঁক ছিল। বড় হওয়ার সাথে সাথে মার্শাল আর্টের প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়। ব্রুস লি, জেট লি’দের সিনেমাগুলো ভীষণ আগ্রহ নিয়ে দেখা শুরু করেন সুরো। বাবার মৃত্যুর পর পড়াশোনা আর খেলাধুলায় প্রশিক্ষণ নিতে যোগ দেন বিকেএসপি’তে। উচ্চতার কারণে বিকেএসপি’র ফুটবল ট্রায়াল থেকে বাদ পড়লেও দমে যাননি সুরো, বরং এর মাধ্যমে বক্সিংয়ের দিকে তিনি আরো বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেন। সেসময় বক্সিং ততোটা জনপ্রিয় ছিল না, পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক প্রতিকূলতা তার মনকে আরো নড়বড়ে করে দেয়। কিন্তু দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের কারণেই সুরো একসময় সকল বাধাবিপত্তি কাটিয়ে সাফল্যের সন্ধান পান। ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ
গ্রহণের পর ২০১৪ সালে সুরো কৃষ্ণ চাকমা বাংলাদেশ জাতীয় বক্সিং দলে যোগদান করেন।
বক্সিংয়ের স্বল্প জনপ্রিয়তার কারণে প্রথমদিকে সুরোকে সীমিত সম্পদ ও অপ্রতুল প্রশিক্ষণ সুবিধার মতো বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। একটি জীর্ণদশা ব্যায়ামাগার আর নিজের দৃঢ় সংকল্পকে পুঁজি করে দক্ষতাকে ক্রমশ বাড়াতে থাকেন সুরো, এগিয়ে যান একটু একটু করে। ভোরবেলার নিয়মিত দৌড় আর অক্লান্ত অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বক্সিংয়ের প্রতি প্রবল আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটান সুরো। এই কঠোর পরিশ্রম সুরোকে ২০০৯ সালে তার প্রথম রৌপ্যপদক অর্জনের দিকে নিয়ে যায়। ২০১১ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সিনিয়র লেভেলে খেলার সুযোগ পান এবং বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আর্মির এক বক্সারকে পরাজিত করেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে সুরো বাংলাদেশ রেলওয়ের হয়ে খেলায় অংশ নেন এবং প্রথমবারের মতো সিনিয়র লেভেলে স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালে তাকে জাতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য ডাকা হয়, যেখানে তিনি ইউক্রেনিয় কোচ আলেক্সান্ডার গুরিয়েঙ্কোর অধীনে ছয় মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ক্রমাগত নিজের দক্ষতাকে শান দিয়ে একসময় সুরো কমনওয়েলথ গেমসে অংশ নিতে স্কটল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য অপেশাদার বক্সিং ক্যারিয়ারে সুরোর ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে নানা মেডেল ও অর্জন। একসময় প্রফেশনাল বক্সিংয়ে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। দেশে গতবছর প্রথমবারের মতো ‘এক্সসেল প্রেজেন্টস সাউথ এশিয়ান প্রো বক্সিং ফাইট নাইট - দ্য আল্টিমেট গ্লোরি’ শীর্ষক টুর্নামেন্টের আয়োজন করে বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের ১৪ জন বক্সার অংশগ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে ভারতে দুই বার প্রফেশনাল বক্সিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সুরো কৃষ্ণ এই টুর্নামেন্টের লাইটওয়েইট ক্যাটাগরিতে অংশ নিয়ে নেপালের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মহেন্দ্র বাহাদুর চাঁদকে পরাজিত করেন। এই আসরে সুরোর দূর্দান্ত ক্ষিপ্রতা আর মনোবলে মুগ্ধ হয়ে বক্সিংপ্রেমী আর বিশেষজ্ঞরা সকলেই একবাক্যে সায় দেন – এবারে সুরোর পরবর্তী গন্তব্য হওয়া উচিত এমএমএ’র (মিক্সড মার্শাল আর্টস) বিশ্বমঞ্চ!
দেশের প্রথম প্রফেশনাল বক্সার সুরো কৃষ্ণ চাকমার স্বপ্ন রাঙ্গামাটি শহরে একটি ক্রীড়া প্রশিক্ষণ একাডেমি তৈরি করা, যেখানে পুরো রাঙ্গামাটি থেকে শিশুরা খেলাধুলার প্রশিক্ষণ নিতে আসবে। খুবই সাধারণ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছেন সুরো, আর তাই বিশ্বের সামনে সেরা ক্রীড়া তারকা হলেও সবসময় নিজ মাটি ও মানুষের কাছাকাছিই থাকতে চান তিনি। দেশ আর আদিবাসী মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার মধ্য দিয়েই তিনি সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পান। মার্শাল আর্ট বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীগুলোকে ক্ষমতায়িত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন সুরো কৃষ্ণ। নৃগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা সহজাতভাবেই খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতার অধিকারী হয়ে থাকেন, আর তাই পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে সুরোর মতো তারাও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের দক্ষতা তুলে ধরতে পারবেন বলেই সুরো বিশ্বাস।
সুরো কৃষ্ণ চাকমার এই সাফল্য বাংলাদেশের বক্সিংয়ের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নিজের লক্ষ্যের দিকে অবিচল এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে সুরোর গল্প আগামীতে আরও হাজারো তরুণকে উদ্দীপিত করবে, এমনটাই প্রত্যাশা।