সুরকার নচিকেতা ঘোষের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি 

প্রকাশ : 2021-10-13 10:46:02১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

সুরকার নচিকেতা ঘোষের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি 

প্রবীর বিকাশ সরকার 
------------------


১৯৮২ সাল, তখন আমি ২৩। 
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আর দশজন ছাত্রের মতো আমিও গান পাগল। তবে একটু বেশিই। সে-বছর দুর্গা পুজোয় একটি গান শুনে বিমোহিত হয়ে গেলাম! আরতি মুখোপাধ্যায়ের গান। 
“লজ্জা! 
মরি, মরি, এ কি লজ্জা! 
লজ্জা! 
মরে যাই! এ কি লজ্জা! 
ওগো, তুমি না এলে যে কাঁটাতে ভরে গো 
আমার এ ফুলের শয্যা!
লজ্জা!” 
গানটি ভেসে আসছিল কান্দিরপাড়স্থ বাবলাদা’র বাসার পুজো মণ্ডপ থেকে মাইকে। আমরা তখন আড্ডায় মশগুল রানী দিঘির পশ্চিমপাড়ে ঘাসের ওপর। গানটি শোনা মাত্রই চঞ্চল হয়ে উঠল মন! নতুন গান মনে হল। একেবারে অন্যরকম! এর আগে শুনিনি। 
পরের দিন স্টেডিয়াম মার্কেটে রতনদা’র বৈদ্যুতিন পণ্যসামগ্রীর দোকানে খোঁজ নিয়ে জানলাম, গানটি অনেক আগেই রিলিজ হয়েছে এবং সুপার-ডুপার হিট! হতেই হবে। সুরকার যে নচিকেতা ঘোষ! আমার অন্যতম প্রিয় সুরকার। এই গানটির গীতিকার তাঁরই সুহৃদ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। 
নচিকেতার বাঁধা দুই প্রিয় গীতিকার, একজন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তরুণকালের বন্ধু আর পরবর্তীকালের বন্ধু পুলক। এই দুই গীতিকারকে দিয়ে অনেক গান লিখিয়েছেন তিনি, রীতিমতো প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে দিয়ে, তারপর তো গানগুলো ইতিহাস! প্রায় সব গানই সুপার হিট। জনপ্রিয়তার শীর্ষে আজও। 
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে অমিত প্রতিভার অধিকারী একরোখা, দুষ্টুর শিরোমণি নচিকেতার ৪৫তম প্রয়াণ দিবস আজ ১২ই অক্টোবর। তাঁর সুযোগ্য সন্তান সুপর্ণকান্তি ঘোষের স্মৃতিকথা এবং সারেগামা গানের অনুষ্ঠান থেকে নচিকেতা ঘোষ পরিবেষ্টিত চারজন যথাক্রমে গৌরীপ্রসন্ন, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে চমকপ্রদ অনেক ঘটনার কথা জানা যায়। সৃজনপাগল মানুষগুলোর কলতানে কী মুখরই না ছিল কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ভাবলে আজ অবিশ্বাস্য মনে হয়! 
আরতি মুখোপাধ্যায়ের উক্ত অসাধারণ গানটির কারণে নচিকেতা ঘোষকে আরও ভালো লেগে যায় আমার। ক্রমে ক্রমে তাঁর সুরের আরও গভীরে হারিয়ে যেতে থাকি। ভালোবেসে ফেলি তাঁর সুরারোপিত গান গেয়ে ধন্য অপ্রতিম দুই শিল্পী দ্বিজেন এবং তরুণকে। তরুণকে আরও আগেই আবিষ্কার করেছিলাম “পৃথিবী আমারে চায় / রেখো না বেঁধে আমায়” গানটির জন্য। আমার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় রোমান্টিক গান, যদিও এটা একটি স্বদেশিযুগের দেশাত্মবোধক গান। রোমান্টিক লোকেরাই বেশি স্বদেশকাতর হয়। যেমন এই প্রবাসে আমি! 
নচিকেতা ঘোষ বহু চলচ্চিত্রের গানে সুর করেছেন এবং গানের জন্য জনপ্রিয় হয়েছে সেইসব ছবিগুলো। কাহিনি যাই হোক, গান ছিল অপ্রতিম সুরের কারণে বাজিমাৎকরা। 
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষদিকে প্রায়শ যেসকল রোমান্টিক গানে আমি বুঁদ হয়ে থাকতাম, তার অন্যতম দুজন প্রিয় শিল্পী হলেন দ্বিজেন মুখোপাধায় এবং তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। 
দ্বিজেনের গীত, ১. “ঝাউবনটাকে পেরিয়ে 
পায়ে পায়ে যেপথটা গেছে পাহাড়ের কাছাকাছি
তুমি সেখানে আসবে বলে আমি বসে আছি” 
আহা! কী রোমান্টিক গান! কী কাব্যিক কথা! পুলকের লেখা, নচিকেতার সুর। 
কুমিল্লায় বাসার কাছেই ধর্মসাগর দিঘির পাড়সংলগ্ন সবুজ উদ্যানে দু-তিনটি ঝাউগাছ ছিল। সারাদিন ঝির ঝির শব্দে বাতাস কাটত সুরু সরু পাতাগুলো। তাই দেখে আমার খুব ভালো লাগত। হৈমন্তিক সন্ধ্যায় এই ঝাউগাছের নিচে ঘাসে বসলে এই গানটি মনের মধ্যে বেজে উঠত। 
২.“ আবার দুজনে দেখা সেই যমুনারই কিনারে 
না না বৃন্দাবনে নয়, নয় ব্রজপুরে, 
তার থেকে কিছু দূরে যমুনার কিনারে 
কুতুবের মিনারে....”
এটাও পুলকের লেখা, নচিকেতার সুর। 
দারুণ এক রোমান্টিক বিষণ্নতায় আমাকে অনেকদিন নিমগ্ন করে রেখেছিল এই গানটি। তারুণ্যে একটা অহেতুক বিরহ-বিরহ একাকীত্বের মেজাজ থাকে। থাকে অর্থহীন একটা বিষণ্ন ভাবালুতা। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। মাঝে মাঝে আমি দুপুরের পরে বাসার কাছেই চারতলা কালেক্টরেট ভবন বা ডিসি ভবনের ছাদে উঠে একা একা হাঁটতাম। উপর থেকে দেখা যেত শহরটাকে। মনে মনে এই গানটি শুনতাম, নিজেও গাইতাম। মনে হত: সত্যিই তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি না হলে ভালোই ছিল! তবু হল! হয়ে গেল! 
৩. দ্বিজেনের আরেকটি অসামান্য রোমান্টিক গান উন্মাদপ্রায় করেছিল আমাকে! বিশেষ করে বর্ষার দিনে গানটি শুনলে মন সজল হয়ে উঠত অকারণেই। আসলেই কি অকারণে? 
“ওগো সুন্দরী আজ অপরূপ সাজে সাজো সাজো সাজো 
ওগো সুন্দরী মোর পরাণ বাঁশিতে বাজো বাজো বাজো”
কী অপূর্ব সুর এবং গলার কাজ! দ্বিজেনের ভরাট গলাটাই তো রোমান্টিক! গানের সূচনাসঙ্গীতই কোন্ দূরঅতীতের অমরাতীতে নিয়ে যায় মনকে। গৌরীপ্রসন্নর লেখা গানটিতে নিজেই সুর করেছেন। রাগ-রাগিনী, বাদ্যযন্ত্র এবং সুরসৃষ্টির ব্যুৎপত্তি কত গভীর হলে পরে কণ্ঠশিল্পী নিজেই গানের সুর করতে সক্ষম হন, ভাবলে অবাক না হয়ে পারা যায় না! বাংলা গানের স্বর্ণযুগে জনপ্রিয় অনেক কণ্ঠশিল্পী সুরকার হিসেবেও অসামান্য প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন, যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, লতা মুঙ্গেশকর প্রমুখ। 
৪. “আমাকে সেথায় খুঁজে পাবে শিউলি ফোটানো ভোরে 
যদি কখনো মনে পড়ে 
পাখিরা যখন উড়ে যাবে চঞ্চল কলস্বরে 
আলোর সে পথ ধরে”
এই গানটি প্রথম শুনি কলেজে ওঠার পর। কলকাতার বেতার আকাশ বাণীর অনুরোধের আসরে। শোনা মাত্রই অভিভূত হয়ে গেলাম! মনে হল, এ যে আমারই মনের কথা! সদ্য ফেলা আসা কৈশোরের কারো দুগ্গা-দুগ্গা মুখ মনে পড়ে যেত! জানি না এই গানটির গীতিকার ও সুরকার কারা? মন বলছে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা আর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় নিজেই সুর করেছেন। ভুলও হতে পারে। 
আজও এই গানগুলো আমাকে অপার আনন্দ দেয়, কখনো কখনো স্মৃতিকাতর করে তোলে। 
তরুণ বন্দ্যোপাধায়:
......................................
তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভরাট গলার আরেক অসাধারণ ভালোলাগার শিল্পী। নানা ধরনের গান তাঁর কণ্ঠে সাবলীলভাবে গীত হয়েছে। দ্বিজেনের চেয়ে তরুণ মঞ্চ মাতিয়ে রাখতে পারতেন। স্বনামধন্য গীতিকার পবিত্র মিত্রর লেখা, শ্যামল মিত্রের সুরে তাঁর গীত “কাজল নদীর জলে ভরা ঢেউ ছলোছলে / প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া” সেই কৈশোর থেকে শোনা। আজও এই গান জনপ্রিতার তুঙ্গে। 
তরুণের দুটি অসাধারণ রোমান্টিক গান আমার অত্যন্ত প্রিয়। প্রথমটি হল: 
“চলো রীনা...... ক্যাসুরিনা.... ছায়া গায় মেখে 
এঁকে বেঁকে লাল কাঁকরের পথ ধরে 
একটু একটু করে এগিয়ে যাই, চলো যাবে কি না!”
এরকম গান আর দুটি নেই আধুনিক বাংলা গানের জগতে। গৌরীপ্রসন্নর লেখা আর নচিকেতার পরীক্ষামূলক সুরে এই গানটি এক ব্যতিক্রম উদাহরণ। যেমন গানের কথা, তেমনি বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনা। 
দ্বিতীয় গানটি হল: 
“সেই তুমি জানি না কী করে হলে এই তুমি 
আর সেই আমি কীভাবে হয়েছি আজ এই আমি 
জানি না জানি না...” 
আহা! সত্যিই মন কেমন করা গান! স্মৃতিকাতর করে ফেলে এই বয়সকে। সেই তারুণ্যে কতবার যে শুনেছি ঘুরেফিরে তার হিসেব নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলের বাসিন্দা যখন ছিলাম তখন ছোট্ট ক্যাসেট প্লেয়ারে একাকী এই গান শুনলে কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়তাম। অথচ কোনো কি কারণ ছিল? মনে হয় না! জানি না এই গানটির গীতিকার ও সুরকার কে? ধারণা করি, গীতিকার পুলক এবং সুরকার নচিকেতা ঘোষ। ভুলও হতে পারে। বাদ্যযন্ত্রের রিদম বলে দিচ্ছে নচিকেতা ঘোষই হবেন সুরকার। 
ব্যতিক্রম কত গানেরই না সুর করেছেন অকাল প্রয়াত নচিকেতা ঘোষ, মাত্র ৫১ বছর বয়সে চলে গেলেন। বেঁচে থাকলে আরও কত রোমান্টিক গানের সুর করতেন তা আর না বললেও চলে। গভীর গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।