সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে

প্রকাশ : 2024-10-19 11:52:39১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। দীর্ঘ আট বছর পর ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ শুনানির উদ্যোগ নেওয়ায় এমন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। আগামী রোববার মামলাটি আপিল বিভাগের দৈনন্দিন কার্যতালিকার এক নম্বর এমিকে রয়েছে। ওইদিন মামলাটি নিষ্পত্তি হলে সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকজন বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ বদান্তর বাধা দূর হবে বলে জানিয়েছেন আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার রিভিউ শুনানির উদ্যোগ না নেওয়ায় দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ উঠার পরও হাইকোটের তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত ঝুলে রয়েছে পাঁচ বছর ববে। এখন রিভিউ নিষ্পত্তি হলেই ওই তিন বিচারপতিসহ মোট ১৫ বিচারপতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক-আর হক বলেন, আপিল বিভাগের বায়ে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি পুনর্বহাল করা হয়েছে। এই রায়ের উপর কোন স্থগিতাদেশ নাই। রোববার আপিল বিভাগে রিভিউ নিষ্পত্তির পর বিচারপতি অপসারনের পথ পরিষ্কার হবে বলেও জানান তিনি।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করে নিলে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি পুনরুজ্জীবিত হবে। যখন ওই পদ্ধতি পুনরুজ্জীবিত হবে এখন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের কাউন্সিল গঠন করতে কোন বাধা থাকবে না।

প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতে বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিলো। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা চালুর পর এই ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে সরিয়ে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা হয় রাষ্ট্রপতির হাতে। কিন্তু পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি। এ পদ্ধতির মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের দুর্নীতি ও গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হত। দীর্ঘদিন ধরে চলা ওই পদ্ধতি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করে বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা ২০১৪ সালে আবারো জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেয় তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তখন বিএনপিসহ বিরোধী বাজনৈতিক দলগুলো এই সংশোধনীর তীব্র বিরোধিতা করে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ ছিলো, এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের উপর আওয়ামী লীগ সরকার নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।

ওই বছরই এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দশজন আইনজীবীর পক্ষে হাইকোর্টে রিট করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। ওই রিটের প্রেক্ষিতে বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ ঘোড়শ সংশোধনীকে সংবিধান পরিপন্থী ও বেআইনি ঘোষণা করে। তিন বিচারপতির সম্বয়ে গঠিত বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি এই রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের বিরুদ্ধে তত্কালীন সরকার আপিল করে। আপিল শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ দশজন আইনজকে অ্যামিকাসকিউরি হিসাবে নিয়োগ দেয় আপিল বিভাগ। আইনজ্ঞদের নয়জনই হাইকোর্টের রায় বহালের পক্ষে মত দেন। মামলার সকল পক্ষ এবং অ্যামিকাসকিউরিদের মত নিয়ে ২০১৭ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন সাও বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ সরকারের আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। ফলে পুনরুজ্জীবিত হয় সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ। এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ পিটিশন দাখিল করে তখনকার সরকার। ওই রিভিউ পিটিশন গত আট বছরেও শুনানির উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে রিভিউ না শুনেই আপিলের উপর রায়দানকারী সাত বিচারপতিই পর্যায়ক্রমে অবসরে যান।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রিভিউ নিষ্পত্তির উদ্যোগ :

কোটা সংস্কার আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। ওই আন্দোলন দমাতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। পরে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তিকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেন। এরপর হাত-জনতার দাবির মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন তত্কালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি। দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাভ আহমেদকে। তিনি বিচার বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারে আমলে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতিদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে তাদের অপসারণেরদাবি জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, আইনজীবী ও শিক্ষার্থীরা। আইনজীবীদের একটি দল স্মারকলিপি দিয়ে ৩০ জন বিচারপাতির একটি তালিকাও প্রধান বিচারপতিকে দেন। আইনজীবীদের অভিযোগ, এসব বিচারপতিগণ বিভিন্ন রায় ও আদেশ দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছিলেন। যার মধ্য দিয়ে বিচারপতিরা শপথ ও আচরণবিধিমালা ভঙ্গ করেছেন।

১২ আগস্ট সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বর্তমান প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এম আসাদুজ্জামান বলেন, বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে কারাগার, ব্যবসাপাড়া, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লিতেও একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে সরকারি দলের সংশ্লিষ্টতা থাকলে বিচারকদের নিকট থেকে আনুকূল্য পাওয়া যায়। এটা আর ধারণার পর্যায়ে নেই, এটা বিচার বিভাগ ফাংসের এক নির্মম বাস্তবতা। দুর্নীতির প্রচলিত ধারণায় অর্থনৈতিক লেনদেনকে বুঝালেও, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ডিনামাইটের চাইতেও ধ্বংসাত্মক, এটম বোমার চেয়েও ভয়াবহ, ক্যান্সারের চেয়েও মরণঘাতি। তাই গোটা জাতি প্রত্যাশা করে বিচার বিভাগ সিন্ডিকেটমুক্ত থোক। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সকল ধরণের দুর্নীতি নির্মূলের আহ্বান জানান তিনি।

পরবর্তীকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিগত দেড় দশকে যেসব বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দলকানার অভিযোগ রয়েছে তাদেরও অপসারণ চান। ঘেরাও করেন হাইকোর্ট। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের ১২ জন বিচারপতিকে বিচার কাজ থেকে সরিয়ে দেন প্রধান বিচারপতি রেফাত আহমেদ। তাদেরকে কোন ধরনের বেঞ্চ না দিয়ে ছুটিতে পাঠানো হয়।

এছাড়া দুর্নীতি ও গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্টের তিন বিচারপতিকে বিচার কাজ থেকে সরিয়ে দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে ওই সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বিচার কাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া তিন বিচারক হলেন, বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হক। কিন্তু বিচারপতিদের বিরুদ্ধে উঠা দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ তদন্ত ও অপসারনের কোন পদ্ধতি না থাকায় গত পাঁচ বছরেও তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত কোন ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আগামী রবিবার ঘোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ শুনানির জন্য রয়েছে। রিভিউ পিটিশন নিষ্পত্তি হলেই দুর্নীতি ও অপসারনের অভিযোগ উঠা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারবেন প্রধান বিচারপতি।

আপিলের রায়ে যা বলা হয় :

২০১৭ সালে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, ঘোড়শ সংশোধনী যেহেতু সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক সেহেতু ওই সংশোধনীর আগে যে ব্যবস্থা ছিলো [সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল) তা পুনঃস্থাপিত হলো। অর্থাৎ রায়ের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ছয়টি যারা পুনর্বহাল হওয়ায় বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরে আসে। ১৬[৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে প্রধান বিচারপতি এবং দু’জন জ্যেষ্ঠ বিচাপরককে নিয়ে। কাউন্সিলের কোন সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন বা অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন কারনে কাজে অসমর্থ হন অথবা কাউন্সিলের কোন সদস্যের বিরুদ্ধেই যদি তদন্ত চলে সেক্ষেত্রে পরবর্তী জ্যেষ্ঠ বিচারপতি কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে কাজ করবেন।

এই রায়ে উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য ৩৯ দফার আচরণবিধি চূড়ান্ত করে দেয় আপিল বিভাগ। বিচারকদের পেশাদারিত্ব ও নৈতিক মানদ্ল কেমন হবে, কোন কোন বিষয়ে তাদের সচেতন থাকতে হবে, কোন ধরনের আচরণ পরিহার করতে হবে, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তাদের কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে তার সুনিদ্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে এই আচরণবিধিতে। আপিল বিভাগ বলেছে, এই আচরণবিধি মেনে না চললে তা বিচারকের অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। অভিযোগ পেলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট বিচারককে অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া যাবে।