সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ৮৭তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশ : 2021-09-07 11:13:21১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ৮৭তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

মহসীন দেওয়ান লিটন 
----------------------- 
 
 
‘ … এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ রয়ে গেল
কিছুতেই বড় হতে চায় না
এখনো বুঝলো না ‘আকাশ’ শব্দটার মানে
চট্টগ্রাম বা বাঁকুড়া জেলার আকাশ নয়
মানুষ শব্দটাতে কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই
ঈশ্বর নামে কোন বড় বাবু এই বিশ্ব সংসার চালাচ্ছেন না
ধর্মগুলো সব রূপকথা
যারা এই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে
তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে পায় না
তারা গর্জন বিলাসী …। ’
 
দেখো দেখো, দেশ পত্রিকায় কবিতা বেরিয়েছে এক জনের। তাঁর নামও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
১৯৫০ সালে যে কিশোরী কথাগুলো বলেছিল, তার সামনে দাঁড়ানো ষোলো বছরের ছেলেটিই সুনীল। আর সেই কবিতা, ‘একটি চিঠি’ লেখা হয়েছিল ওই মেয়েটির কথা ভেবেই। সে জানতে পারেনি। পরে ‘কৃত্তিবাস’ নিয়ে মেতে ওঠার পর্বে তার সঙ্গে সুনীলের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। 
ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা আর দ্বিতীয় কবিতার মধ্যে তিন বছরের ব্যবধান। লেখা বন্ধ ছিল না, কিন্তু ছাপতে দেননি কিছু। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য জীবনে ওই তিনটে বছরই নীরবতার বছর। ওই প্রথম, ওই শেষ। 
 
১৯৫৩ সালেই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ কবিতা বেরোল। চতুর্থটি বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় বেরোল আর অচিরেই আবু সয়ীদ আইয়ুবের সম্পাদনায় ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ সংকলনে নির্বাচিত হল। ওই বছরই ছাপা হল প্রথম ছোট গল্প, ‘বাঘ’। এবং আত্মপ্রকাশ করল ‘কৃত্তিবাস’। সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঙ্গে দীপক মজুমদার এবং আনন্দ বাগচী। নিজেকে যে কত ভাবে ছড়িয়ে দেবেন সুনীল, ওই উনিশ বছর বয়স থেকেই তার দিকচিহ্নটি ছিল স্পষ্ট।
 
উনিশ থেকে আটাত্তর। এর মধ্যে সুনীলের শুধু বইয়ের সংখ্যাই আড়াইশোর বেশি। সম্পাদিত গ্রন্থ পঞ্চাশের অধিক। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণসাহিত্য, নাটক, চিত্রনাট্য, শিশুসাহিত্য এতগুলি শাখায় সাবলীল বিচরণের রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারটি সুনীলের জন্যই তোলা ছিল। যৌবনে রবীন্দ্র-বিরোধী বলে তকমা জুটেছিল যদিও। সুনীল কিন্তু পরে বলেছিলেন, ওঁর বিদ্রোহ রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল না। ছিল, রাবীন্দ্রিকতার নামে বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে। 
 
আরও দু’টি দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি ছিলেন সুনীল। বাঙালি মধ্যবিত্তসুলভ কূপমণ্ডূকতা ওঁর স্বভাবে ছিল না কোনও দিন। সুনীল মানেই পায়ের তলায় সর্ষে। আর, সুনীল মানেই দরজা-জানলা খোলা একটা তরতাজা মন। অজস্র বিষয়ে আগ্রহ, পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সদা সচেতন। স্পষ্টবাক, প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নিজস্ব মতামত তা সে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়েই হোক বা রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া নিয়েই হোক। নীরা কে, এই প্রশ্নটি ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে প্রশ্নকর্তাকে কখনও নিরাশ করেননি সুনীল। 
ছাত্র বয়স থেকেই হুটহাট বেরিয়ে পড়তেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই বাউন্ডুলেপনা কোনও দিন থামেনি। সাঁওতাল পরগনা থেকে প্যারিস, নিউ ইয়র্ক থেকে শান্তিনিকেতন, সুনীলের উৎসাহ সমান। নিজেই বলতেন, লেখক হওয়ার কোনও দুরাকাঙ্ক্ষা তাঁর ছিল না। 
 
কলেজ জীবনে সুনীলের স্বপ্ন বলতে একটাই, জাহাজের খালাসি হয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়া। খালাসির চাকরি সুনীলকে করতে হয়নি, কিন্তু বাংলা সাহিত্য নীললোহিতকে পেয়েছে। বাঙালির অভিধানে দিকশূন্যপুর শব্দটা চিরকালের মতো ঢুকে গিয়েছে।
 
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। সাবেক পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলায় মাইজপাড়া গ্রামে ছিল ওঁদের পৈতৃক বাড়ি।
 
চলে গিয়েও সুনীল রয়ে গেল’ শিরোনামের লেখায় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর লেখাটি শুরু করেছেন এভাবে – ‘যখন এ লেখা লিখছি, তখন সুনীল বড় একা হয়ে শুয়ে আছে ঠান্ডা ঘরে, পিস হ্যাভেনে। ডোরবেল বাজিয়ে কেউ আসবে না আজ। সুনীল উঠে গিয়ে দরজা খুলে প্রসন্ন মুখে বলবে না, আরে, এসো এসো -! … বেড়াতে যেতে বড় ভালবাসত সুনীল। নতুন অচেনা কোনও জায়গায় যাওয়ার কথা শুনলেই উজ্জ্বল হয়ে উঠত চোখ। আজও সুনীল চলল নতুন এক দেশে।’ 
একবার তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কোন থিমের কবিতা লিখতে পছন্দ করেন?
 
এর জবাবে তিনি বলেন, “ব্যর্থ প্রেম।”
আবার প্রশ্ন করা হয়, জীবন থেকে নেওয়া?
সুনীল বলেন, “হ্যাঁ, সব সময় মনে হচ্ছে ব্যর্থ, সবকিছু ব্যর্থ। একটু ভালবাসা চেয়েছিলুম কেউ দিল না।”
‘ব্যর্থ প্রেম’ শিরোনামে তার একটি কবিতাও আছে। সুনীল লিখেছেন—
“প্রতিটি ব্যর্থ প্রেম-ই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়/আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি/দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়/… আমাকে কেউ ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে মনে হয় খুব আপন/…আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও আঘাত না লাগে/আমার তো কাউকে দুঃখ দেবার কথা নয়।” ——(ব্যর্থ প্রেম)
 
তাঁর হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হবে। পিয়ারলেস হাসপাতালের ঘরে তিনি আধশোওয়া। ঘণ্টাখানেক পরে তাঁকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হবে। ঘরভর্তি লোক। কেউ পুজোর ফুল এনেছেন, কারো হাতে মন্ত্রপূত জল, কেউ খুব সেজেছে, কারো আঁখি ছলছল।
 
এই সময় ইষৎ ক্ষ্যাপাটে এক ভক্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলল, ‘সুনীল, এক ঘণ্টা পর আপনার অপারেশন, যদিও হাঁটু অপারেশন এমন কিছু বিপজ্জনক নয়, তবু হাসপাতালের ব্যাপারে যদি আপনার আজ, ইয়ে মানে ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে যায়, তাই আমার এখন আপনার কাছে একটা প্রশ্ন আছে।’
 
ঘরভর্তি লোক তখন প্রশ্নকারীর দিকে চমকে দেখছে। কারো চোখে দারুণ রাগ, কারো বিরক্তি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘বলো।’
সে বলল ‘আজ অপারেশন টেবিলে ওঠার আগে আপনি আমায় এমন কিছু বলে যান, যে-কথাটার আশ্রয়ে আমি সারাজীবন বাঁচতে পারি।’
মুহূর্তে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ক্ষমা করো আর ভালোবাসো।’
যে-প্রশ্ন করেছিল, সে চোখ বুজে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
সুনীলের ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ পড়ে আমি প্রেমিক হয়েছি। স্বপ্নে তাদের ছবি এঁকেছি। কল্পনায় প্রেমিকার অসুখ সারানোর মোনাযাত করেছি। প্রেমিকাদের দিকে ছুড়ে দিয়েছি; ‘ লক্ষী মেয়ে, একবার চোখে চাও, আয়না দেখার মতো দেখাও ও-মুখের মঞ্জুরী।’
কৈশোরের উন্মত্ত সময়ে স্বপ্নভঙ্গের বেদনার সময়ে ''কেউ কথা রাখেনি'' কবিতায় নিজের ছায়া দেখে ভেবেছি এইতো আমি ।
কবিতার জন্য অমরত্বকে অস্বীকার করা সুনীল দেশভাগ নিয়ে একটি উপন্যাস 'পূর্ব পশ্চিম' লিখে ছেন আর কোন লিখা না লিখলেও অমরত্বের পেতেন ।
অবোধ শিশু রাসেলের হত্যায় সভ্যতাকে অস্বীকার করেন , জনকের রক্তমাখা সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গে যেতেও রাজি হন না এই মহাপ্রাণ ।
 
নীললোহিত ছদ্মনামে পায়জামা পরা ভবঘুরে বেকার চরিত্রটিকে একটা গোটা প্রজন্মের কাছে প্রায় আইকন করে তুলতে পেরেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
 
প্রেম , বিষণ্ণতার,জীবনের অতুলনীয় কথাকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিতে। 
অকাতরে লিখতেন। বেশি লেখা ভাল কি না, এ নিয়ে খুব একটা ভাবতেন না। নিজেকে বেশি গুরুত্ব দিতেও চাইতেন না। প্রিয় বই কী, জিজ্ঞেস করলে বলতেন, মহাভারত। সেই মহাভারত লেখাতেই হাত দিয়েছিলেন। শেষ হল না। সুনীলও কথা রাখলেন না। জীবনটা অর্ধেকই রয়ে গেল।
শুভ জন্মদিন নীললোহিত