সীমান্ত দিয়ে দিনে আসছে কোটি টাকার স্মার্টফোন, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
প্রকাশ : 2025-10-09 13:24:51১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক

চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় ৪০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা বহু বছর ধরেই মাদক, অস্ত্র ও চোরাচালানিদের নিরাপদ রুট হিসেবে পরিচিত। ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইনের পাশাপাশি এখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে ভারতীয় স্মার্টফোন চক্র। সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলোতে দিন দিন বেড়েই চলেছে ভারতীয় স্মার্টফোন চোরাচালান। অবৈধভাবে আসা এই ফোনগুলো সহজলভ্য হলেও সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। আর পকেট ভরছে চোরাকারবারিদের।
স্থানীয়রা বলছেন, জেলার সীমান্ত এলাকার বাজারগুলোতে অনেকটা প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় চোরাই স্মার্টফোন। অনেকে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করছেন এই মুঠোফোন। এমনকি ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় চোরাই মুঠোফোন ক্রয় করতে আসেন ব্যবসায়ীরা। পরে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন অঞ্চলে।
তিন ধাপে কাজ করছে চোরাই চক্র
প্রথম ধাপে সীমান্তের ওপারে ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে মোবাইল সংগ্রহ করা হয়। এসময় ভারতীয়দের সঙ্গে থাকেন বাংলাদেশিদের একজন। এরপর স্মার্টফোনগুলো সীমান্ত এলাকায় এনে পৌঁছে দেওয়া হয় শূন্য রেখায়। পরে এখানকার দ্বিতীয় চক্রটি শ্রমিক দিয়ে স্মার্টফোনগুলো সীমান্তের কাছাকাছি দোকানগুলোতে নিয়ে আসে। পরে এখান থেকে তৃতীয় চক্রটি বিভিন্ন স্মার্ট ফোনের যন্ত্রাংশ পরিবর্তন করে স্কুল ব্যাগ কিংবা বাংলাদেশি স্মার্টফোনে ঢুকিয়ে করে বিভিন্ন শহর অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়।
এসব কাজে চোরাকারবারিরা ব্যবহার করছে কম বয়সী তরুণদের। নদীপথ, ফাঁকা মাঠ কিংবা কৃষিপণ্যের বোঝার মাধ্যমে চক্রগুলো সুসংগঠিতভাবে কাজ করায় প্রশাসনের নজরদারি সত্ত্বেও প্রতিদিন সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে ভারতীয় লাখ লাখ স্মার্টফোন।
কেন এই ফোনে আকৃষ্ট মানুষ?
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও মনাকষা সীমান্ত এলাকায় কথা বলে জানা গেছে, ভারতীয় বাজারে স্মার্টফোনের দাম বাংলাদেশে তুলনায় অনেক কম। একটি নামিদামি ব্র্যান্ডের ফোন ভারতে যেটি ২০-২৫ হাজার টাকায় পাওয়া যায়, সেটি বাংলাদেশে ৪০-৫০ হাজার টাকার নিচে পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে ক্রেতারা ঝুঁকি জেনেও কম দামে এসব ফোন কিনতে আগ্রহী।
সরকারের ক্ষতি
কেবল ভোক্তারা নয়, এর প্রভাব পড়ছে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতেও। বৈধভাবে আমদানি করা প্রতিটি স্মার্টফোন থেকে সরকার রাজস্ব ও শুল্ক আয় করে থাকে। অথচ অবৈধভাবে ভারত থেকে আসা ফোনগুলো বাজারে চলে আসায় সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
সীমান্তে সক্রিয় চোরাচালান চক্র, দিনে আসছে কোটি টাকার স্মার্টফোন
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সীমান্ত পথে অবৈধ ফোন আসা বন্ধ না হলে তা দেশের বৈধ মোবাইল বাজারকে ধ্বংস করে দেবে। একইসঙ্গে বৈধ আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না।
জেলায় সবচেয়ে বেশি স্মার্টফোন আসে শিবগঞ্জ উপজেলার তেলকুপি, মনাকষা, চৌকা সীমান্ত দিয়ে। চৌকা সীমান্ত এলাকার আতিকুর রহমান সুজন বলেন, চৌকা সীমান্তে তারের বেড়া না থাকায় প্রতিদিন এই সীমান্ত ব্যবহার করে শত শত মোবাইল বাংলাদেশে আনছেন চোরাকারবারিরা। পরে গভীর রাতে ব্যাগে করে বাজারের বিভিন্ন দোকানে দিয়ে আসছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের একজন সদস্য ভারতেই অবস্থান করছেন। তিনি ভারতীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে মোবাইল সংগ্রহ করেন। পরে শূন্যলাইনে এসে ফেলে যান। আমরা তখন শ্রমিক দিয়ে মোবাইলগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসি।
তিনি আরও বলেন, আমরা ৬ জন মিলে গত ১ বছর ধরে এই ব্যবসা করে আসছি। দিনে অন্তত ১ কোটি টাকার স্মার্টফোন বিভিন্ন দোকানে আমরা বিক্রি করি। শুধু আমরা করছি, বিষয়টা এমন নয়। আমাদের মতো শত শত ব্যবসায়ীরা এখন এই ব্যবসা করে লাখপতি হয়েছেন। অনেকে রাজশাহীতে বাড়ি-গাড়ি কিনেছেন।
স্থানীয়দের উদ্বেগ
সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষের মতে, মাদক, অস্ত্র ও স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ চোরাচালান একইসঙ্গে চলছে। এতে শুধু সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে না, সমাজেও অপরাধ বাড়ছে। আর তরুণদের মধ্যে বাড়ছে সহজে অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের প্রবণতা।
স্থানীয় বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, সীমান্তে এসব কার্যক্রমের সঙ্গে বেশি জড়িত তরুণরা। অবৈধ স্মার্টফোনের দৌরাত্ম্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈধ ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। তাই চোরাই স্মার্টফোনের চোরাচালান বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় নজরদারি, গোয়েন্দা কার্যক্রম ও জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিবগঞ্জ থানায় কর্মরত এক পুলিশ সদস্য বলেন, সীমান্ত দিয়ে দিনে লাখ লাখ নামিদামি ব্যন্ডের স্মার্টফোন আসছে। কিন্তু অভিযান হচ্ছে অল্প। এই কার্যক্রমের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জড়িত।
তবে বিজিবির দাবি, সীমান্তে কড়া নজরদারি চালানো হচ্ছে। তবে চোরাচালানকারীরা আধুনিক কৌশল ব্যবহার করায় মাঝে মধ্যেই ফাঁকফোকর দিয়ে মোবাইল ফোন প্রবেশ করছে।
৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, আমরা গত এক বছরে ৩ হাজার ৩২৪টি ভারতীয় চোরাই মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছি। আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। এই চক্রটি মূলত তিনভাবে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে। আর কিছুদিন পরপর কৌশল পরিবর্তন করে এসব কার্যক্রম করে আসছে।
কা/আ
সৌজন্যে :জাগো নিউজ