সাহিত্য সম্রাটের অজানা গল্প
প্রকাশ : 2022-06-27 10:48:47১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
তাপতী বসু
-----------------
বঙ্কিচন্দ্রের জন্ম ১৮৩৮ সালের ২৬শে জুন, ১৩ আষাঢ় ১২৪৫,কাঁঠালপাড়া গ্রাম, নৈহাটি, কলকাতা। তাঁর কর্মজীবনে শুরু যশোর - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে।যোগদানের তারিখ: ১৮৫৮, ৭ আগস্ট। এ বাদেও তিনি খুলনা - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর (যোগদানের সাল: ১৮৬০, ৯ নভেম্বর ) ও ঝিনাইদহ - ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ( ১৮৮৫, ১ জুলাই ) ছিলেন।
খুলনায় থাকার সময় "Rajmohans Wife" ১৮৬৪ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস। এটি ১৮৬৪ সালে 'Indian Field' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জনের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৫৬ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। পরের বছর প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৫৮ সালে বিএ পরীক্ষা প্রবর্তিত হলে ১৩ জন এই পরীক্ষা দেন। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন মাত্র দু’জন - যার একজন বঙ্কিম।
১৮৫৮ সালের ২৩ আগস্ট তিনি ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে নিয়োগ পান। যশোর শহরে এসে তিনি এই পদে যোগ দেন। অভিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা ছিল যশোর। ১৭৮১ সালে মিঃ টিলম্যান হেংকেলকে কালেক্টর হিসাবে নিয়োগের মাধ্যমে যশোরের জেলা প্রশাসনের কাজ শুরু হয়। তখন জেলা সদর কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল যশোর শহরের মুড়লীতে। মুড়লী ছিল এক সময় সমতট রাজ্যের রাজধানী। এখানে বৌদ্ধ মঠও ছিল। মুড়লী থেকে নতুন কালেক্টর ভবনে প্রশাসনের সমস্ত কর্মকর্তারা চলে আসেন ১৮০১ সালে। ওটিই ছিল যশোরের প্রথম কালেক্টর ভবন। নির্মিত হয় ১৮০১ সালে। উল্লেখ্য বর্তমানের কালেক্টরেট ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। পুরানো কালেক্টরেট যেখানে স্থাপিত হয় তার নাম ছিল সাহেবগঞ্জ - নতুন নাম কসবা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই কালেক্টর ভবনে এসেই ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে চাকরিতে যোগদান করেন। এই ভবনেরই একটি কক্ষে ছিল তাঁর কার্যালয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন, তখন যশোর ছিল আধা গ্রাম। ম্যালেরিয়া রোগে ভরা- দুষিত জল আর অস্বাস্থ্যকর জায়গাটির কথা তিনি শুনেছিলেন কলকাতায় বসেই। তবুও তাঁর প্রথম কর্মস্থলের অপ্রিয় শহরটিকে একদিন ভালবেসে ছিলেন।
সে সময় যশোরের সাথে কলকাতার যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্গম। রেল লাইন বসেনি- নৌকা পথে যশোরে আসতে ব্যয় হতো তিন থেকে চার দিন। যদিও কলকাতা থেকে যশোরের দুরত্ব মাত্র ১শ’ ১০ কিলোমিটার। ভাগীরথী, আপার ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কপোতাক্ষ ও লোয়ার ভৈরব দিয়ে যশোরে আসতে হতো। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নৌকা ছাড়াও ব্যবহার করতেন পালকী। যশোর থেকে তখন কলকাতা পর্যন্ত যশোরের কালীপোদ্দারের একক ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে একটি কাঁচা সড়ক। আজ আজকের প্রখ্যাত যশোর রোড নামে পরিচিত। বঙ্কিমচন্দ্র সাধারনত কলকাতা থেকে যশোরে যাতায়াত করতেন পালকীতে।
যশোর শহরের চারপাশে তখন ঘনজঙ্গল। ম্যালেরিয়ায় হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর শহর জন মানবহীন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল পত্রে জানা যায়-প্রথম প্রথম যশোর শহর বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে অসহ্য ঠেকত। তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হবার ভয়ে ভীত থাকতেন। কিছু দিন পর এই শহর তাঁর ভাল লেগে যায়।
যশোর থাকাকালীন ম্যালেরিয়া রোগের বিরুদ্ধে মানুষজনকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতেও তিনি সচেস্ট হন।
এখানে তার পরিচয় ঘটে ‘নীলদপর্ন’ নাটকের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের সাথে। দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন যশোর ডিভিশনের পোষ্ট অফিস সুপারিনটেনডেন্ট। ‘প্রভাকর’ ও ‘সাধুরঞ্জন’ পত্রিকা সূত্রে একে অপরের পরিচিত ছিলেন। যশোরে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব হয়।
১৮৫৪ সালে যশোরে স্থাপিত হয়েছিল পাবলিক লাইব্রেরি। লাইব্রেরির সাথে খেলাধুলার ব্যবস্থাও ছিল। তাঁরা এই লাইব্রেরিতে যেতেন নিয়মিত।
১৮৪৯ সালে তাঁর বিয়ে হয়। স্ত্রীর নাম ছিল মোহিনী দেবী। স্ত্রীর বয়স যখন পনের আর বঙ্কিমের বয়স বাইশ,তখন তিনি তাকে যশোরে কর্মস্থলে নিয়ে আসেন। যশোরে থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী জ্বরে আক্রান্ত হন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। কয়েক দিন রোগ ভোগের পর মারা যান তাঁর স্ত্রী। বঙ্কিমের দাম্পত্য জীবন যশোরে শুরু হয় এবং তা ছিল মাত্র এক বছরের। এই বিয়োগযন্ত্রণায় তিনি লিখেছিলেন -
‘মনে করি কাঁদিব না রব অন্ধকারে
আপনি নয়ন তবু ঝরে ধারে ধারে
গোপনে কাঁদিব প্রাণ সকলি আঁধার
জীবন একই স্রোতে চলিবে আমার।’
১৮৬০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্কিম চন্দ্র যশোরে ছিলেন। এ সময় সর্বত্র নীলকরদের অত্যাচার শুরু হয়েছে। এ সংক্রান্ত ঘটনার বিভিন্ন তদন্তে তিনি কৃষকদের আনুকুল্য দেখাতেন। এ জন্য নীলকররা তাঁকে প্রাণহানির হুমকিও দিয়েছিল। যশোর থেকে বদলী হয়ে যান মেদিনীপুর জেলার নাগোয়াতে। সেখান থেকে পুনরায় আবার তাঁকে যশোরে বদলী করা হয়। যশোরে কয়েকদিন থাকার পর তাঁকে পাঠানো হয় খুলনাতে।
খুলনায় থাকাকালীন ১৮৬১সালের শেষ দিকে মোরেলগঞ্জের বারুইখালিতে নীলকরদের সাথে কৃষকদের সংঘর্ষ হয়। তাতে কৃষক নেতা রহিমুল্লাহ সহ ১৭জন নিহত হন। এই মামলার তদন্তে বঙ্কিমচন্দ্র নীলকরদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন- তাদের দায়ী করেন । যা তাঁকে ইংরেজদের কাছে অপ্রিয় করে তোলে।
কিন্তু প্রথম বাঙ্গালী আমলা হিসেবে তিনি ঐ সময়ে স্থানীয় মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন।