সব কীছু নিয়ে লেখা যাবে কীন্তু -----!!
প্রকাশ : 2021-04-30 09:22:48১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
তাদের রাগ, সাংবাদিকরা কেন মামুনুল হকের কাহিনী প্রকাশ করে দিল। বেশি রাগ ৭১ টিভির উপর, কারণ এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি পাইওনিয়ার হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। আমার উপর তাদের অনেক রাগ, কারণ হেফাজতে সন্ত্রাস এবং মামুনুল হক নিয়ে আমি অনেকবার লিখেছি। হুমকি এবং গালিগালাজের শেষ নেই। হত্যাবাদী হেফাজতিরা সুযোগ পেলে আমাকে ছেড়ে দেবে না –এটা ভাল করেই বুঝি। তাদের মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়েই এযাবতকাল লিখে এসেছি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এভাবেই আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চর্চা করি।
বাংলাদেশে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের স্বাধীনতা এরকম অনেকগুলো জটিল বাস্তবতার মধ্যদিয়ে প্রকাশমান। ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস এবং চিন্তার পরিসর, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, মিডিয়ার মালিকানা, আইন, রাজনীতি, সমাজনীতি, ব্যাপক জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ইত্যাদি সবকিছুই এই জটিল বাস্তবতার অন্তর্গত। যেমন ধরুন গত দুদিন থেকে আমাকে এবং সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকতাকে গালি দেওয়া হচ্ছে, আমরা কেন বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভির বিরুদ্ধে লিখেছি না, বা খবর দিচ্ছি না। আরে ভাই, মিডিয়া যদি এই খবর না দিয়ে থাকে তাহলে বিষয়টি আপনি জানলেন কিভাবে? মিডিয়া প্রকাশ করেছে বলেই আপনি জানতে পেরেছেন। তবে ঐ খবরে আপনার মন ভরেনি, তাই গালিগালাজ করছেন। না, শুধু সেটাই নয়; আপনার বুকের ভেতরে এখনো জ্বলজ্বলে ক্ষোভ আছে— কারণ মিডিয়া মামুনুল হকের কীর্তি ফাঁস করেছে। সেটা আপনার পছন্দ হয়নি, কিন্তু এটাতে আপনার ব্যাপক আগ্রহ!
আপনাদের এই আগ্রহ এবং অনাগ্রহের কানাগলির মাঝখানে দাঁড়িয়েই এদেশে প্রেসফ্রিডম প্র্যাক্টিস করতে হয়। এই কানাগলির অন্ধকারে অনেকগুলো এবড়ো খেবড়ো খাম্বা আছে, যেগুলো ডিঙিয়ে –কখনো কখনো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে সাংবাদিকরা আপনার জানার অধিকার জোগায়।
আপনার এই জানার দাবিটা আপনি সেক্যুলার মিডিয়ার কাছেই রাখছেন, এজন্য আপনাকে ভালবাসি। আপনি জামাত, হেফাজত, বিএনপি ইত্যাদি যাই হন, তথ্য জানার জন্য আপনি দৈনিক দিনকাল, সংগ্রাম, নয়াদিগন্ত বা ইনকিলাবের উপর নির্ভর করে বসে থাকেন না। আপনি বিবিসি, ডয়েচেভেলে, প্রথম আলো, কালের কন্ঠ, জনকণ্ঠ, ভোরেরকাগজ ঘুরে শেষে ৭১টিভির সামনে বসে পরেন। আমার প্রতি আপনার এই আস্থার জন্যই আপনি মানুষ, আপনাকে ভালবাসি। কিন্তু আপনাকে ভালবেসে আপনার সবচাহিদা পুরণ করতে পারিনা। এর প্রধান প্রতিবন্ধক আপনি নিজে। কারণ আরও আছে, তবে প্রধান প্রতিবন্ধকতা মানুষ আপনি নিজেই। আপনি আপনার মনমতোটা চান, আপনার বিশ্বাসের বিপরীতটা চান না।
আমি আপনারই মতো একজন মানুষ। আমার আরও কিছু বাড়তি প্রতিবন্ধকতা আছে। কারণ চাকরিটা আপনি দেন না, রক্ষা করার দায়িত্বও নেন না। নিঃসন্দেহে এ আমার সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে যিনি বিপ্লবী অবস্থান নিতে পারেন তাকে প্রণাম করি। কিন্তু যে পারলোনা তাকে সবসময় ঘৃণা করতে পারিনা। বাংলাদেশে কালোটাকার মালিকানা ছাড়া, বিতর্কীত অর্থবিত্তের মালিকানা ছাড়া মিডিয়ার মালিকানা কোথায়, কয়টি আছে একবার দেখিয়ে দেন দেখি! গত ২০/৩০ বছরে যে নতুন পুঁজির বিকাশ ঘটেছে তারই উপর দাঁড়িয়ে আছে বিকশিত নতুন মিডিয়া। এই নতুন মিডিয়াই দলীয় রাজনীতিনির্ভর সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে ন্যুজ হয়েছে –সেটাও সত্য। প্রতিটি পয়েন্ট ব্যাখ্যা করলে লেখা বেশি লম্বা হয়ে যাবে। আলোচনার উপলক্ষে ফিরছি।
একটি মেয়ের করুন মৃত্যু এবং এর সঙ্গে শিল্পপতি ও মিডিয়া টাইকুন সায়েম সোবহানের নাম জড়িয়ে যাওয়া মিডিয়ার কাছে কতটা গুরুত্বের? পাঠক হিসেবে আপনার চাহিদা যতটুকু তার চেয়ে বেশিকিছু নয়। এরকম হাজার হাজার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে, সেগুলোর সব সমভাবে মিডিয়া ফোকাসে আনতে পারেনা। অথচ মানবিক আবেদন কোনটিরই কম নয়। মামুনুল হকরা রাজনীতির এবং সমাজের মেনটর। কিন্তু সায়েম সোবহান জনমানসের মেনটর নন। তাঁর বিষয়টিতে প্রধান লক্ষ্যনীয় হল, সবলের কাছে দুর্বল অসহায় কিনা? অর্থের কাছে আইন অসহায় কিনা? বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে কি-না? তা যদি না হয়, যদি আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে, তবে এক্ষেত্রে মিডিয়ার উপর কোনো বাড়তি দায়িত্ব বর্তায়না –নিছক আপনাদের (পাঠক মনস্তত্ত্বের) খোরাক জোগানো ছাড়া। এই খোরাক জোগানোর কাজে সকল মিডিয়া সবসময় সমভাবে সফল হয়না। আবার বলছি, সেই সফলতা মানুষ চায়না বলেই সাংবাদিকতার পথ বেশি দুর্গম।
এদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার একনম্বর অন্তরায় হল মানুষের অন্ধ বিশ্বাস। সবকিছু নিয়ে লেখা যাবে, কিন্তু মানুষের বিশ্বাসের জায়গায় হাত দেওয়া যাবেনা। এরকম একটি একটি করে যদি বিভিন্ন কারণ উদাহরণসহ বলি তবে দেখবেন, "সবকিছু নিয়ে লেখা যাবে, 'কিন্তু'....। " এরকম কিন্তুর শেষ নেই। মানবের জন্য বিকশিত, স্বাধীন, মুক্ত পৃথিবী পেতে চাইলে এরকম 'কিন্তুর' সংখ্যা কমাতে কমাতে শূন্যে নিয়ে যেতে হবে। জয় মানুষ।