সনাতন ধর্ম ও মূর্তি পূজা
প্রকাশ : 2021-10-12 10:58:38১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
অমলেন্দ্র সাহা
------------
সনাতন ধর্ম কি মূর্তি পূজাকে সমর্থন করে ? এ কথা শুনে অনেকেই চমকে উঠবেন, অনেকে বিরক্ত হবেন এবং বলবেন, “ বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ ধরে পূজা করে আসছি, এখন এ প্রশ্ন উঠছে কেন ? এটাতো ধর্ম বিরোধী কথা ।” সোজা-সরল নিরক্ষর মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষিত প্রায় সকল হিন্দুই যে এই “ অনেকের” দলে থাকবেন এটা প্রায় নিশ্চিত । মূর্তি পূজার সমর্থনে যারা নানা গ্রন্থের সূত্র উল্লেখ করেন সেগুলো প্রায় সবই সনাতন ধর্মগ্রন্থ বহির্ভূত গ্রন্থ । সনাতন ধর্মের উৎস এবং একমাত্র প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ মহাপবিত্র বেদ-বেদান্তে পরমেশ্বরের মূর্ত রূপের কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না । পরমেশ্বরের স্বরূপ বর্ণনা করতে যেয়ে মূখ্য উপনিষদসমূহের অনেক গ্রন্থে পরমেশ্বরকে নিরাকার, নিরবয়ব জ্যোতির্ময় এক দৈব সত্তা রূপে চিত্রিত করা হয়েছে । বৃহদারণ্যক উপনিষদে অবশ্য বলা আছে ( ২/৩/১ ), “ দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে মূর্তং চৈবামূর্তং ..... “ অর্থাৎ “ব্রহ্মের দু’টি রূপ - মূর্ত বা সাকার এবং অমূর্ত বা নিরাকার ।” এখানে মূর্ত রূপের যে কথা বলা হয়েছে তা’ শুধুমাত্র ব্রহ্ম বা পরমেশ্বরের সর্বময় ক্ষমতা প্রকাশের জন্যে এবং ব্রহ্মের এ মূর্ত রূপ নিত্য বা শাশ্বত নয় । বৃহদারণ্যক উপনিষদের এ মন্ত্রটি ছাড়া মূখ্য উপনিষদসমূহের আর কোন উপনিষদে মূর্ত রূপের কোন উল্লেখ নেই । বৃহদারণ্যক উপনিষদে মূর্ত রূপের যে উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে কিন্তু সে মূর্ত রূপের কোন বর্ণনা দেয়া হয় নি এবং মপ. বেদ-বেদান্তের কোথাও ব্রহ্মের মূর্ত রূপের কোন বর্ণনা নেই । বৃহদারণ্যক উপনিষদের অন্য কয়েকটি মন্ত্রে ( ৩/৮/৮, ৩/৮/১১, ৩/৯/২৬ ) ব্রহ্ম বা পরমেশ্বরকে নিরাকার হিসেবেই বর্ণনা বা ইঙ্গিত করা হয়েছে ।
ব্রহ্ম বা পরমেশ্বর যে নিরাকার এবং নিরবয়ব সে বিষয়ে মূখ্য উপনিষদসমূহে অজস্র মন্ত্র রয়েছে । ঈশ উপনিষদের ৮ম মন্ত্রে বলা হয়েছে, “ তিনি [ব্রহ্ম] সর্বগামী, জ্যোতির্ময়, অশরীরী [নিরাকার], ক্ষতরহিত, স্নায়ুহীন, শুদ্ধ ও অপাপবিদ্ধ । তিনি সর্বদর্শী, সর্বজ্ঞ, সকলের মধ্য বিরাজমান এবং সয়ম্ভূ । তিনি নিত্যকাল ব্যাপিয়া কর্মফল ও সাধনা অনুসারে সকলকে যথাযথ বিধান প্রদান করেন ।” কেন উপনিষদের ১/৫-৯ নং মন্ত্রসমূহে যথাক্রম বলা হয়েছে, “ যিনি বাক্য দ্বারা প্রকাশিত নন অথচ যাঁর দ্বারা বাক্য প্রকাশ পায়, যাঁকে মন দ্বারা মনন করা যায় না অথচ মন যাঁর দ্বারা জ্ঞাত বা অবগত হয়, যাঁকে চোখ দিয়ে দেখা যায় না অথচ যাঁর দ্বারা মানুষ বিভিন্ন বস্তু দেখে, কান দিয়ে যাঁকে শুনা যায় না অথচ যাঁর দ্বারা শ্রুত বিষয়াদি জ্ঞাত হওয়া যায়, নাক দিয়ে যাঁর আঘ্রাণ নেয়া যায় না অথচ যাঁর দ্বারা বিভিন্ন বস্তু আঘ্রাত হয় তিনিই ব্রহ্ম বলে ব্রহ্মবিদগণ বলেছেন । যে সকল দৃশ্যমান বস্তুকে [অগ্নি, বরুণ প্রভৃতি দেবতা] লোকে ‘ইনিই ব্রহ্ম’ বলে উপাসনা [পূজা] করে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্ম নন ।” এ উপনিষদের ২/৩ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে, “ ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধির অগোচর অর্থাৎ অমূর্ত । পক্ষান্তরে অজ্ঞানীদের কাছে তিনি [ব্রহ্ম] ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধির গোচর অর্থাৎ মূর্ত ।”
কঠ উপনিষদের ১/২/২২ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে, “ শরীরেষু অশরীরম্ “ অর্থাৎ “জীবের শরীরে অবস্থিত থেকেও তিনি [ব্রহ্ম] নিজে শরীরবিহীন ।” এ উপনিষদের ২/৩/৯ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে, “ ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চনৈনম্ “ অর্থাৎ “এ পরমপুরুষের প্রকৃত স্বরূপ আমাদের প্রত্যক্ষ দৃষ্টির বিষয় নয়, তাই চোখ বা অন্য কোন ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা তাঁর স্বরূপ প্রত্যক্ষ করতে পারি না ।” একই উপনিষদের ২/৩/১২ নং মন্ত্রে উল্লিখিত আছে, “ নৈব বাচ্য ন মনসা প্রাপ্তুং শক্যো ন চক্ষুষা “ অর্থাৎ “পরমাত্মা [ব্রহ্ম] বাক্য দ্বারা প্রাপ্ত নন, মন ও চোখ দ্বারাও নন [কারণ তিনি অমূর্ত] ।”
মুণ্ডক উপনিষদের ১/১/৬ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে, “ অদৃশ্য, অগ্রাহ্য, রূপহীন, চোখ-কান প্রভৃতি জ্ঞানেন্দ্রিয় বর্জিত ও হাত-পা প্রভৃতি কর্মেন্দ্রিয় বর্জিত অবিনাশী, ব্যাপক, সর্বগত [সর্বজীবে অনুপ্রবিষ্ট], অতিসূক্ষ্ম, যিনি সকল জীবের উৎপত্তির কারণ - সেই অক্ষর ব্রহ্মকে জ্ঞানীগণ জ্ঞান দিয়ে দর্শন করেন ।” এ উপনিষদের ২/১/২ নং মন্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, “ দিব্যো হ্যমূর্ত: পুরুষ: ...... “ অর্থাৎ “সেই দিব্য বা জ্যোতির্ময় পুরুষ [ব্রহ্ম] অমূর্ত বা মূর্তিহীন ।” একই উপনিষদের ৩/১/৮ নং মন্ত্রে উল্লিখিত আছে , “ ন চক্ষুষা গৃহ্যতে নাপি বাচা ন-অন্যৈ:-দেবৈ:- তপসা কর্মণা বা । জ্ঞানপ্রসাদেন বিশুদ্ধসত্ত্বস্ততস্তু তং পশ্যতে নিষ্কলং ধ্যায়মান: ।” অর্থাৎ “ব্রহ্মকে চোখ দিয়ে গ্রহণ করা যায় না, বাক্য দিয়েও তিনি গ্রহণীয় নন, অন্য কোন ইন্দ্রিয় দিয়ে, তপস্যা বা কর্ম দিয়েও তাঁকে পাওয়া যায় না । জ্ঞানের উজ্জ্বল্য বা আনুকূল্য দিয়ে যার চিত্ত নির্মল হয়েছে সেই ব্যক্তি ধ্যান করতে করতে সেই নিষ্কল [নিরাকার] পরমপুরুষকে নির্মল হৃদয়াকাশে দেখতে পান ।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৩/১৯ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে, “ অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা পশ্যত্যচক্ষু: স শৃণোত্যকর্ণ: । স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা ..... “ অর্থাৎ “তাঁর ( ব্রহ্মের ) হাত না থাকলেও তিনি গ্রহণ করেন, পা না থাকা সত্বেও তিনি দূরগামী, চোখ না থাকা সত্বেও সকল কিছুই দেখেন, কান না থাকা সত্বেও তিনি সকল কিছুই শুনেন । জ্ঞাতব্য সকল বিষয়ই তিনি জানেন, কিন্তু কেউ তাঁকে জানে না ।” এ উপনিষদের ৪/২০ নং মন্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, “ ন সন্দৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চনৈনম্ ।” অর্থাৎ “পরমেশ্বরের স্বরূপ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, কেউ তাঁকে চোখ দিয়ে দেখতে পারে না ।” এ উপনিষদেরই ৬/১৯ নং মন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, “ নিষ্কলং নিষ্ক্রিয়ং শান্তং নিরবদ্যং নিরন্জনম্ । অমৃতস্য পরম্ সেতুং দগ্ধেন্ধনমিবানলম্ ।” অর্থাৎ “যিনি নিষ্কল বা নিরাকার, নিষ্ক্রিয়, শান্ত বা বিকারবিহীন, নির্দোষ, নির্লিপ্ত, অমৃত লাভের সেতু বা উপায় এবং জ্বলন্ত কাঠের মত দীপ্যমান আমি সেই পরম পুরুষের শরণ নিচ্ছি ।
বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৩/৮/১১ নং মন্ত্রে দেখা যায় ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য ঋষিকা গার্গীকে বলছেন, “ এ অক্ষরকে ( ব্রহ্মকে ) দেখা যায় না কিন্তু তিনি দেখেন, তাঁকে শুনা যায় না কিন্তু তিনি শুনেন, তাঁকে মনন করা যায় না কিন্তু তিনি মনন করেন, তাঁকে জানা যায় না কিন্তু তিনি সবই জানেন ।”
উপরে বর্ণিত কোন কোন মন্ত্রে সরাসরি স্পষ্ট ভাষায় ব্রহ্ম বা পরমেশ্বরের অমূর্ত বা নিরাকার রূপের কথা বলা হয়েছে এবং কোন কোন মন্ত্রে ব্রহ্ম বা পরমেশ্বরের অমূর্ত বা নিরাকার রূপের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে । উল্লিখিত মন্ত্রসমূহ ছাড়া এ রকম আরো বেশ কিছু মন্ত্র আছে যেখানে পরমেশ্বরের অমূর্ত রূপের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে ।
পরমেশ্বরের মূর্ত রূপের এবং বহু দেবতার পূজারী বা উপাসকগণ মূর্ত রূপের এবং বহু দেবতার পক্ষে ঋগ্বেদের ১/১৬৪/৪৬ নং মন্ত্রটিকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেন যেখানে বলা হয়েছে, “ .... একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি ..... “ অর্থাৎ এক পরমেশ্বর বহু রূপে বর্ণিত । তবে ঋগ্বেদের ৩য় মণ্ডলের ৫৫তম সূক্তের সর্বমোট ২২টি ঋকের শেষেই বলা হয়েছে, “ মহৎ দেবানাং অসুরত্বং একং “ অর্থাৎ “সকল দেবতাদের মহৎ বল একই ( একই মহাশক্তি থেকে উদ্ভূত ) ।” এ মন্ত্র কিন্তু পরমেশ্বরের মূর্ত রূপের সমার্থক নয় এবং পরমেশ্বর যে এক জ্যোতির্ময় মহাশক্তি তা’ এ ঋকসমূহ থেকে স্পষ্ট ।
উপরুক্ত ধর্মীয় বিধি-বিধান বা বাণীসমূহ বহুজনকে বিশেষত শিক্ষিত যুব সমাজকে ভীষণভাবে বিভ্রান্ত করে । এর উপর মূর্তি বা প্রতিমা ধ্বংসকারীদের ( iconoclasts ) অপপ্রচার হিন্দু যুব সমাজকে ধর্ম-বিমুখ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্ম বিরোধী করে তুলছে । মূর্তি পূজার যথার্থতা সম্পর্কে শিশুকাল থেকে অস্পষ্ট ধারনা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ভুল ব্যাখ্যার কারণে যুবা বয়সে এসে নিজ স্বাধীন মত বা চিন্তাধারার সাথে প্রচলিত ধর্মীয় মতাদর্শ মিলাতে ব্যর্থ হয়ে হিন্দু যুবক-যুবতীরা দিকভ্রান্ত হচ্ছে এবং বিধর্মীদের অপপ্রচারে বিমুগ্ধ হয়ে বহু যুবক-যুবতী ধর্মান্তরিত হচ্ছে ।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ সনাতন ধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ । সে গ্রন্থের ২/৩/১ নং মন্ত্রটিকে ভিত্তি করে পরমেশ্বরের মূর্ত রূপের পূজাকে মান্যতা দেয়া যেতে পারে এবং ঋগ্বেদের ১/১৬৪/৪৬ নং ঋকটিকে ভিত্তি করে বহু দেব-দেবীর পূজাকেও মান্যতা দেয়া যেতে পারে, তবে সে সকল দেব-দেবীকে পরমেশ্বরের বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ হিসেবে মেনে নিলেও তাঁদের সৃষ্টি বা উৎপত্তির বিষয়ে যে সকল পৌরাণিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী গাঁজাখুরি, আজগুবি এবং অনেক ক্ষেত্রে অশ্লীল গল্পের উদ্ভব হয়েছে সেগুলোকে কোনওভাবেই মান্যতা দেয়া যায় না । বর্তমানে প্রচলিত মূর্ত-দেবতাবাদের জন্ম পৌরাণিক যুগে শুরু এবং সে সময় নানা গাঁজাখুরি গল্প ফেঁদে নানা দেব-দেবীর সৃষ্টি হতে থাকে । দেব-দেবীর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রায় সীমাহীন পর্যায় পৌঁছে যায় । তবে এর সাথে “ ৩৩ কোটি দেবতার “ যে প্রবাদটি জুড়ে দিয়ে বিধর্মীরা হিন্দুদেরকে বিদ্রূপ ও অপদস্ত করতে সচেষ্ট হয় এবং এ বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে হিন্দুরা এর যথাযথ প্রত্যুত্তর দিতে অপারগ হয় । এ প্রবাদটি যে পরমেশ্বরের মূর্ত রূপের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ নয় সে কথাটি হিন্দুদের অধিকাংশ ব্যক্তিই জানেন না, কারণ সে শিক্ষা তাদেরকে কেউ দেন না । মহাপবিত্র বেদের দেবতার সাথে বর্তমানে পূজিত দেব-দেবীর কোন মিল নেই - মপ. বেদের দেবতা হচ্ছে কোন ঋক বা মন্ত্র যেই বিষয়কে ( Subject ) কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে । পৌরাণিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী দেব-দেবীদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা, কর্ম সবই মানুষের মত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অত্যন্ত নোংরা মানসিকতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বহি:প্রকাশও দেখা যায় । দেব-দেবীরা বিয়ে করছেন, তাঁদের সন্তান হচ্ছে, তাঁরা পরস্পর ঝগড়া বিবাদ করছেন, কোন কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ করছেন, কেউ কেউ প্রতারণা করছেন, এমন কি কেউ কেউ ধর্ষণের মত চরম নোংরা কাজেও লিপ্ত হয়েছেন । যাঁরা পরমেশ্বরের শক্তির প্রকাশ তাঁরা মধ্যে কি কখনো মানব সদৃশ দোষ-গুণের প্রকাশ ঘটতে পারে ? তাঁরাওতো হবেন পরমেশ্বরের মতই নির্গুণ । তাঁদের মধ্যেই যদি এ ধরণের অন্যায় ও অশ্লীল কাজের প্রকাশ ঘটে তা’ হলে মানুষ কি শিখবে বা এ সকল কাহিনীকে কি দৈব কাহিনী হিসেবে কোন জ্ঞানী পুরুষ বা যুক্তিবাদী মানুষ মেনে নেবেন ? নৈব নৈব চ ।
জ্ঞান অর্জনের প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণ ও দান করতে যেয়ে যেমন শিক্ষার মাধ্যম অক্ষরকে মূর্ত রূপ দিতে হয় তেমনি ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের বা উপাসনার প্রাথমিক পর্যায়ে পরমেশ্বরের প্রতি গভীর অনুরাগ বা পরমেশ্বরের সাথে একাত্বতা অনুভব করতে তাঁর মূর্ত প্রতীককে সামনে রেখে উপাসনা করা যেতেই পারে, তবে তা’ যেন যৌক্তিকতার সীমারেখা অতিক্রম করে না যায় । সাধারণ শিক্ষায় যারা উচ্চ পর্যায়ে উঠে যান তাদের জন্যে যেমন প্রতিটি বিষয় বুঝতে প্রতীকের সাহায্য নিতে হয় না, তেমনি যারা মূর্তি পূজা করতে করতে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উচ্চ স্তরে উঠে যান তখন তাদের আর পরমেশ্বরকে খুঁজার জন্যে মূর্ত প্রতীকের প্রয়োজন হয় না । দুর্ভাগ্যবশত বিষয়, যারা মূর্তি পূজার অনুসারী তারা সনাতন ধর্মের প্রকৃত তত্ত্ব না জেনেই নিরাকার পরমেশ্বরের সাধকগণকে ‘নির্বিশেষবাদী’ বলে উপহাস করেন । এ যেন প্রাইমারী পাস ব্যক্তির বিশ্ববিদ্যালয় পাস ব্যক্তির জ্ঞান বা বিদ্যা নিয়ে উপহাস করা !
স্বামী বিবেকানন্দ পরমেশ্বরের মূর্ত রূপের পূজা বা আরাধনা সম্পর্কে বলেছেন, “পুতুল পূজা করে না হিন্দু কাঠ মাটি দিয়ে গড়া । মৃন্ময় মাঝে চিন্ময় হেরে হয়ে যায় আত্মহারা ।” স্বামীজীর এ বাণীটিকে গ্রহণ করে প্রত্যেকটি দেব-দেবীকেই যদি পরমেশ্বরের বিশেষ বিশেষ শক্তির মূর্ত রূপ হিসেবে পূজা করা হয় তা’ হলে সনাতন ধর্ম বিরুদ্ধ কাজও হয় না এবং যারা ধর্ম মানেন এমন যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষেও তা’ মেনে নেয়া অসম্ভব হবে না । এমন ক্ষেত্রে দেব-দেবীকে কেন্দ্রে করে গাঁজাখুরি ও অশ্লীল কল্পকথার অবসান ঘটাতে হবে এবং দেব-দেবীর পূজায় যে সকল অদ্ভুত আচার পালন করা হয় তার আমূল পরিবর্তন করতেই হবে । নইলে পূজার নামে বর্বরোচিত বহু আচারের কারণে নিশ্চিতভাবে বহু শিক্ষিত হিন্দু মূর্তি পূজা থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নেবেন । ঐ সকল বর্বরোচিত আচারকে মান্যতা দেয়ার জন্যে যতই তার উপর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব কথার প্রলেপ দেয়া হোক না কেন আজকের যুগের জ্ঞানী ও যুক্তিবাদী কেউ আর ঐ সকল ছেলে ভুলানো গল্পে ভুলতে নারাজ ।
ওঁ শুভমস্তু ( পরমেশ্বর সকলের কল্যাণ করুন ) ।