শুরুতেই হোঁচট খেলো গোলাপি বাস
প্রকাশ : 2025-02-12 11:13:23১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
![শুরুতেই হোঁচট খেলো গোলাপি বাস শুরুতেই হোঁচট খেলো গোলাপি বাস](https://gramnagarbarta.com/storage/photos/1/thumbs/67ac2d19e208e.jpg )
রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারি উদ্যোগ এড়িয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাস চালু করে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। তবে চালুর চার দিনের মাথায় মালিক সমিতির সেই প্রচেষ্টা হোঁচট খেয়েছে। যদিও সাধারণ যাত্রীরা এই নতুন ব্যবস্থাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন, কিন্তু বাসচালক ও শ্রমিকদের আপত্তির কারণে কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফলে শৃঙ্খলা ফেরার পরিবর্তে যাত্রীদের দুর্ভোগ বেড়েছে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি নির্দিষ্ট রঙের ই-টিকিটিং ও কাউন্টারভিত্তিক বাস চালু উদ্বোধন করে মালিক সমিতি। এই পদ্ধতিতে বাস শ্রমিকরা নিজের হাতে ভাড়া তুলতে পারবেন না। যাত্রীরা কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে বাসে উঠবেন। প্রতিদিনের ভাড়া কোম্পানির তত্ত্বাবধানে জমা হবে এবং সেখান থেকে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বা মাসিক বেতন দেওয়া হবে।
প্রাথমিকভাবে আব্দুল্লাহপুর থেকে ঢাকায় প্রবেশকারী বাসগুলোকে গোলাপি রঙে রূপান্তর করে এই কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম ধাপে ২১টি কোম্পানির ১০০টি বাস দিয়ে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়। পরবর্তী ধাপে সংশ্লিষ্ট সব কোম্পানির সব বাসকে এই ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে মালিক সমিতি। শুধু আব্দুল্লাহপুর নয়, ঢাকাকে চারটি ভাগে বিভক্ত করে চারটি আলাদা রঙে এই ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
কিন্তু যাদের দ্বারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে সেই গণপরিবহন চালক-শ্রমিকরা এই ব্যবস্থাপনা চাচ্ছেন না। ফলে শুরুতে রুট অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানে বাসের কাউন্টার বসানো হলেও সেই কাউন্টারের সংখ্যা এখন কমে গেছে। সড়কে গোলাপি রঙের বাসের দেখাও মিলছে না তেমন একটা। কিছু দেখা গেলেও সেসব বাস কাউন্টার ছাড়াও যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে। এছাড়া প্রত্যেক স্টেশনে কাউন্টার না থাকায় ভাড়ারও সমন্বয় করা যাচ্ছে না। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে।
এদিকে ১০ ফেব্রুয়ারি সায়েদাবাদ এলাকায় কাউন্টারভিত্তিক বাস চলাচল ব্যবস্থা বন্ধ ও ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেন গণপরিবহন চালক ও শ্রমিকরা। তারা জানান, কাউন্টারভিত্তিক বাস চলাচলে আয় কম।
আব্দুল্লাহপুর থেকে ছাড়া গোলাপি রঙের আওতায় আসা বিভিন্ন বাস কোম্পানির চালক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, আগে প্রতি ট্রিপে নির্দিষ্ট আয় ছাড়াও বাড়তি কিছু আয় জমা হতো। যা তারা নিজেরা রাখতেন। কাউন্টার হওয়ায় এখন আর তারা নিজেরা ভাড়া তোলার সুযোগ পান না। ফলে চুক্তিতে যে টাকা পান দৈনিক, তা যথেষ্ট নয়। এছাড়া রাতে কোম্পানির অফিস থেকে দৈনিক মজুরি তুলতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়।
এদিকে নতুন ব্যবস্থাপনায় বিপাকে বাস মালিকরা। একাধিক বাস মালিক বলেন, ‘কাউন্টার থেকে টিকিট কাটা যাত্রীদের হিসাব আমরা পাই। কিন্তু চালক আর হেলপাররা কাউন্টারের বাহিরে লোক তোলে। এছাড়া সব জায়গায় কাউন্টার না থাকায় সব এলাকার যাত্রীর হিসাব আমরা পাই না। আমাদেরও লস গুনতে হচ্ছে।’
বাস মালিকদের মতে, অপরিপক্ব উদ্যোগের কারণে সমস্যার সৃষ্টি। তারা বলেন, ‘আগে থেকে এই বিষয়ে তেমন প্রস্তুতি ছিল না সমিতির। দ্রুত সময়ের মধ্যেই এই ব্যবস্থা চালু করায় এখনও অনেক জায়গায় কাউন্টার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চালক ও বাস মালিকরা কত আয় পাবে, কীভাবে আয় ভাগ হবে, এসব বিষয়ে এখনও খোলাখুলি আলাপ হচ্ছে না।’
এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ‘যেসব চালক-শ্রমিক এই ব্যবস্থার আপত্তি জানিয়েছে তারা চুক্তিভিত্তিক চলতে চায়। তারা চায় নিজেরা ভাড়া তুলে সেখান থেকে মালিককে দেবে। এতে তারা অধিক আয়ের আশায় সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। আমরা এসব আর হতে দেবো না। বাসগুলো রঙ করতে পাঠানোয় বাস সড়কে কিছুটা কম।’
বাস মালিকদের সঙ্গেও এ বিষয়ে বৈঠক হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন থেকে সব জায়গায় ঠিকভাবে গাড়ি চলাচল করবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসে একটি নীতিমালা ঠিক করবো আমরা।’
শৃঙ্খলা আসেনি বরং ভোগান্তি বেড়েছে
এদিকে নতুন ব্যবস্থাপনার কারণে ভোগান্তি বেড়েছে যাত্রীদের। ৪ ফেব্রুয়ারি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আব্দুল্লাহপুর থেকে বাড্ডা, রামপুরা রুটে নিয়মিত চলাচলকারী ভিক্টর পরিবহন, রাইদা ও তুরাগ পরিবহনের বাসের সংখ্যা হাতেগোনা। বাস সংকটের কারণে অনেক যাত্রীকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। বাস না পেয়ে অনেককে হেঁটে কিংবা বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।
সমাধানের কথা বললেও মঙ্গলবারও (১১ ফেব্রুয়ারি) সড়কে তেমন গোলাপি রঙের বাস দেখা যায়নি। এমনকি বিমানবন্দর থেকে বাড্ডা রামপুরা হয়ে যাত্রাবাড়ী ও গুলিস্তান রুটের যেসব কোম্পানির বাস কাউন্টারভিত্তিক চলাচলের আওতায় এসেছে, সেগুলোসহ অন্যান্য বাসও তেমন চলাচল করতে দেখা যায়নি।
মহাখালীর একজন যাত্রী রুকাইয়া ইসলাম বলছেন, ‘বাস শ্রমিকরা সবসময় তাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে। এর জন্য সড়কে শৃঙ্খলা না এলেও তাদের কিছু যায় আসে না। কারণ তারা এভাবেই অভ্যস্ত। তারা সবসময় আমাদের জিম্মি করে রাখে। ভেবেছিলাম অন্তর্বর্তী সরকারের সময় একটা সুস্থ সমাধান আসবে। কিন্তু কোনও কিছুই হচ্ছে না।’
অফিসগামী আরেক যাত্রী নিয়ামুল হাসান বলেন, ‘পরিবহন সেক্টর পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষের যে কষ্ট হয় এই বিবেকটা পরিবহন শ্রমিকদের নাই। তাদের জীবনে শৃঙ্খলা নাই, মানুষকেও সেই কষ্টে রাখে।’
অনিশ্চয়তায় ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ প্রকল্প
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির উদ্যোগে এখন চাপের মুখে ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ প্রকল্প। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি এই প্রকল্প ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে চালু হওয়ার কথা। এ নিয়ে কয়েক মাস ধরে কাজও করে যাচ্ছে সরকারি সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। তবে মালিক সমিতি আগে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় চালু করায় এখন তা কীভাবে চালু হবে এ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বাস রুট রেশনালাইজেশন চালুর বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ধ্রুব আলম বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। মাঝে একটা রিভিউ মিটিং আছে, তারপর দেখছি কী হয়।’
তিনি বলেন, ‘মালিক সমিতি সমন্বয় করছে না। আমরা তো আর বিদ্যমান সব বাস চালতে দেবো না। ফিটনেসসহ অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করবো। এগুলো তো সময়সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু তারা যেমন আছে ওভাবেই চালাতে চায়। কোনও সময় দেবে না।‘
কেউই কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না
বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির বা ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি কারোর উদ্যোগই টেকসই নয় বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, স্থায়ী সমাধানে না গিয়ে বিষয়টি জটিলভাবে দেখছে উভয়পক্ষ। এভাবে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকার বাস ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে সরকারের উচিত নিজের আওতায় একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য প্রয়োজন অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া। এই টাকায় ঢাকার যত বাস আছে, সব কিনে নিয়ে ভালোগুলো রেখে বাকিগুলো ভেঙে ফেলা এবং কোম্পানিতে দক্ষ জনবল নিয়োগ করা। ঢাকায় ২০ শতাংশ যাত্রী বহনের জন্য যদি ৩০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে একটি মেট্রোরেলের লাইন তৈরি করা যেতে পারে, তাহলে বাকি যাত্রীদের সুবিধার্থে ৪ হাজার কোটি টাকা বেশি নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার কোম্পানিটিকে একটি লাভবান ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে পারলে পরিবহন ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। ঢাকার মধ্যে গুলশান ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কিন্তু এ ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যথায় যে পদ্ধতিতে ডিটিসিএ এবং মালিক সমিতি যে পরিকল্পনা করছে তা এতটা সহজ হবে না।’
কা/আ