শুধুই আম্পায়ারের ভুল নাকি আইসিসির পক্ষপাতমূলক আচরণের বলি বাংলাদেশ?
প্রকাশ : 2022-11-07 11:12:02১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
ক্রিকেটবিশ্বে বাংলাদেশ নামটা ধারে-ভারে এখনও অনেকটা ছোটই বলা যায়। বিশেষত, ক্রিকেটে তিন মোড়ল পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে থেকে তো অন্য দেশগুলোকে যেন গোনাতেই ধরে না স্বয়ং আইসিসি। দ্বিপাক্ষিক সিরিজে যেমন-তেমন, বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই বৈষম্যের প্রমাণ যেন বেশি পাওয়া যায় আইসিসির ইভেন্টগুলোতেই।
আইসিসির এই পক্ষপাতমূলক আচরণের সবচেয়ে বড় এবং আজ পর্যন্ত সবেচেয়ে বেশি শিকার হয়তো বাংলাদেশই। প্রায় সাত বছর আগে ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচ হয়তো ভুলে যাওয়ার কথা না বাংলাদেশি কোনো ক্রিকেটপ্রেমীরই।
শিখর ধাওয়ানের সেই বাউন্ডারি লাইনের ক্যাচ বা রোহিত শর্মাকে আউট করা রুবেল হোসেনের সেই 'উচ্চতার' নো বল, বিতর্ক উঠেছিলো দুই ঘটনা নিয়েই। বিসিবি তখন অভিযোগও জানিয়েছিলো আইসিসির কাছে, তবে সেটি আমলেই নেয়নি বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বরং শোনা গিয়েছিল এই অভিযোগের কারণেই নাকি তৎকালীন আইসিসি সভাপতি মুস্তফা কামালকে ফাইনালের শিরোপা মঞ্চ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিলো। পরে তো ওই পদ থেকে পদত্যাগই করেছিলেন সাবেক বিসিবি সভাপতি।
সাত বছর আগের পুরোনো হিসেব একটু নাহয় দূরেই সরিয়ে রাখি আপাতত, চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকা্পে সেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই পরপর দুই ম্যাচে বাংলাদেশের সঙ্গে আইসিসি বা আম্পায়াররা যে আচরণ প্রদর্শন করেছেন, তাতে স্পষ্টই প্রশ্ন উঠতে পারে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে।
বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভের হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি বাংলাদেশ। এই ম্যাচ জিতলেই বাংলাদেশের সামনে খুলে যেতে পারে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের দুয়ার। ভারত হারলে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার শঙ্কাতেই পড়ে যাবে হয়তো।
এমন ম্যাচে আগে ব্যাট করে ভারত তোলে ১৮৪ রান। জবাব দিতে নেমে দুরন্ত লিটন দাসের ব্যাটে চড়ে উড়ন্ত সূচনা পায় বাংলাদেশ। ৭ ওভার গড়াতেই অ্যাডিলেডের আকাশজুড়ে নামে বৃষ্টি। বাংলাদশ তখন মাঠ ছাড়ে বিনা উইকেটে ৬৬ রান নিয়ে। বৃষ্টি আইনে পার স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশ তখন এগিয়ে ১৭ রানে। মাঠে আর খেলা না গড়ালে ওই ১৭ রানেই জিতে যাবে বাংলাদেশ। সেই আশা আর পূরন হয়নি বাংলাদেশের। বৃষ্টি থামার পর আবার শুরু হয় ম্যাচ, বৃষ্টি আইনে বাংলাদেশ হারে ৫ রানে।
বিতর্কের শুর তখন থেকেই, বৃষ্টি থামার পর মাঠের যেমন অবস্থায় খেলা শুরু হয় সেখানে ফুটবল খেলা হতে পারে, অন্তত ক্রিকেট না। বৃষ্টি থামার পর খেলা শুরু এতো বেশি তাড়া ছিলো যা মাঠ ঠিকমতো শুকানোও হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকান আম্পায়ার মারাইস এরাসমাসের কাছে অভিযোগও জানিয়েছিলেন টাইগার অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। ওই অবস্থায় মাঠে না নামার ব্যাপারে অস্বীকৃতিও হয়তো জানিয়েছিলেন সাকিব। তবে সেসবের কোন কিছুই গ্রাহ্য করেননি এরাসমাস। এক প্রকার বাধ্য হয়েই মাঠে নামতে হয়েছে বাংলাদেশকে। খেলা শুরুর প্রথম ওভারেই ওই ভেজা মাঠে স্লিপ কেটে পড়ে রান আউট হয়েছেন বাংলাদেশকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেওয়া লিটন। জয়ের স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশ ম্যাচ হেরে গেছে ৫ রানে।
ম্যাচের শেষে বাংলাদেশের সহ-অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহানের কাছ থেকে এসেছে আরও এক অভিযোগ। বৃষ্টিতে খেলা থামার আগে ভারতের বিপক্ষে ফেইক ফিল্ডিংয়ের অভিযোগ তুলেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সেই অভিযোগ আমলেই নেননি মাঠের আম্পায়াররা। অথচ লেগ আম্পায়ারের ঠিক সামনেই ফেইক ফিল্ডিংয়ের ঘটনাটি ঘটান ভারতের তারকা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি। ফেইক ফিল্ডিংয়ের অভিযোগটি রিভিউ করা হলেই পেনাল্টিতে ৫ রান পেতো বাংলাদেশ, আর সেই ৫ রানেই ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। সংখ্যাটা কাকতালীয়ভাবে মিলে গেলেও ঘটেছে এমনই।
ঘটনার সময় উইকেটে থাকা ব্যাটসম্যান নাজমুল হোসেন শান্ত তাৎক্ষনিক অভিযোগ করেন আম্পায়ারের কাছে। তবে লেগ আম্পায়ার এরাসমাস সেটি আমলেই নেননি। তিনি শান্তকে জানান, এরকম কিছু তাদের চোখে পড়েনি। তবে পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সেখানে দেখা গেছে স্পষ্ট ফেইক ফিল্ডিংয়ের ঘটনা ঘটিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটার বিরাট কোহলি। শুধু তাইই নয়, সেই সময় কোহলির দিকেই নজর দিয়ে রেখেছিলেন আম্পায়ার এরাসমাস।
আগের ম্যাচের সেই বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালতেই যেন পণ করেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যচের থার্ড আম্পায়ার জিম্বাবুয়ের ল্যাংটন রুসেরে। বাংলাদেশের ইনিংসের তখন ১১তম ওভার চলে। সৌম্য আউট হওয়ার পর উইকেটে আসেন টাইগার কাপ্তান সাকিব আল হাসান। প্রথম বলেই শাদাবের গুগলিকে ডাউন দ্য উইকেটে খেলতে গিয়েছিলেন সাকিব। মিস করলেন, বল লাগলো সাকিবের বুটে। শাদাব খানরা আবেদন করার পর কিছু একটা ভেবেই আঙুল তুলে দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান আম্পায়ার আদ্রিয়ান হোল্ডস্টোক।
আম্পায়ারের আঙুল তোলা দেখেই অবাক হয়েছেন সাকিব। রিভিউ নিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গেই। মাঠের আম্পায়ার তাও দেখেছেন খালি চোখে এক পলকের দেখা। বিতর্কের সৃষ্টি থার্ড আম্পায়ারের কাছে রিভিউয়ের সিদ্ধান্ত গেলেই।
রিভিউয়ের পর টেলিভিশন রিপ্লেতেও দেখা গেছে আউট হননি সাকিব। রিপ্লেতে দেখা যায় বল সাকিবের বুটে ঠিকই লেগেছে তবে তার আগে ছুঁয়ে গেছে সাকিবের ব্যাটের কানা। আল্ট্রা এজের স্পাইকে স্পষ্ট দেখা গেছে ব্যাটে বল লাগার চিত্র। জিম্বাবুয়ের টিভি আম্পায়ার ল্যাংটন রুসেরের কথা ছিল, সেই স্পাইকটা ছিল ব্যাটের মাটি স্পর্শ করার স্পাইক। ইমপ্যাক্টও ছিল ৩ মিটারের বাইরে।
ঠিকভাবে দেখার প্রয়োজনও মনে করেননি রুসেরে। শেষ পর্যন্ত ফিল্ড আম্পায়ারের এলবিডব্লিউয়ের সিদ্ধান্তই বহাল রাখেন তিনিও। তবে সামনে থেকে দেখানো টেলিভিশনে রিপ্লেতে স্পষ্ট দেখা গেছে, সাকিবের ব্যাট ওইসময় মাটিতে স্পর্শই করেনি। ব্যাট আর ব্যাটের ছায়ার ভেতরেই ছিল বিস্তর ফারাক।
আগের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে আম্পায়ারদের পক্ষপাতমূলক আচরণের পর পাকিস্তানি সাবেকরা সোচ্চার হয়েছিলেন বাংলাদেশের পক্ষেই। আজ সেই পাকিস্তানের বিপক্ষেই অবিচারের শিকার বাংলাদেশ। এবার তারা কি বলবেন?
বাংলাদেশের বিপক্ষে বারবার কেন এমন আচরণ আম্পায়ারদের? এটা কি শুধু তাদের ভুল নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো রহস্য? যদি শুধুই আম্পায়ারদের ভুল হয়ে থাকে তাহলে আজকের ম্যাচের সাকিবের এলবিডব্লিউ রিভিউটা কিভাবে ভুল হয়। টিভি আম্পায়ার তো আজ আরেকটু দেখেশুনে, বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।
ভারতের বিপক্ষে আগের ম্যাচে কোহলির ফেইক ফিল্ডিং নজর এড়িয়ে গেলেও বৃষ্টির পরে খেলা শুরুর এতো তাড়া কেনো দেখালেন আম্পায়াররা? মাঠটা কি আরেকটু শুকানোর পর খেলা শুরু করা যেত না?
ভারত ম্যাচের বিতর্কিত ঘটনা নিয়েই আইসিসির কাছে অভিযোগ করতে চেয়েছে বিসিবি। তবে সেই অভিযোগ করে লাভ কি হবে আদৌ? এর আগেও তো একই রকম ভাবে অভিযোগ করা হয়েছিলো, তবে সেই অভিযোগ আমলেই নেয়নি আইসিসি।
আলোচনা-সমালোচনার জন্ম এখানেই। গুঞ্জন আছে ভারতকে নাকি সবসময়ই বেশি গুরত্ব দেওয়া বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি। তিন মোড়ল তত্ত্বের প্রবর্তনের সময় থেকেই নাকি ভারতের আধিপত্য বেশি আইসিসিতে। কারণও আছে এর পেছনে, ভারতের ক্রিকেট বাণিজ্যের যে প্রসার তাতে আইসিসি তাদের বাড়তি সুবিধা দিবে, এটাই যেন কাম্য।
আবার পাকিস্তান বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল উঠলে যে পরিমান দর্শক উন্মাদনা তৈরি হবে বিশ্বজোড়া ক্রিকেট প্রেমীদের মধ্যে, সেটাও তো আইসিসির বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক। আবার ভারত-পাকিস্তান ফাইনাল হলে তো যেন আইসিসির জন্য সোনায় সোহাগা।
প্রশ্ন তাই উঠেই যায়, বাংলাদেশের বিপক্ষে এমন আচরণ বা বৈষম্য, এটা কি শুধুই আম্পায়ারদের ভুল নাকি আইসিসির কোনো বৃহৎ স্বার্থ জড়িত এখানে? বারবার কেন এমন বঞ্চনার শিকার হতে হবে বাংলাদেশকেই?