শচীন টেন্ডুলকারের ইতিহাস গড়ার সাক্ষী বাংলাদেশ ও ঢাকার দর্শক

প্রকাশ : 2021-03-17 11:19:42১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

শচীন টেন্ডুলকারের ইতিহাস গড়ার সাক্ষী বাংলাদেশ ও ঢাকার দর্শক

ক্রীড়া ডেস্ক: দিবারাত্রির টেস্ট তখন ছিল না, ফ্লাডলাইটের কৃত্রিম আলোর নিচে ওয়ানডে ম্যাচের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না সে সময়টায়। ভারতের কোনো ওয়ানডে ম্যাচ শেষে বা টেস্ট ম্যাচের দিনের খেলা শেষে শচীন টেন্ডুলকার সংবাদ সম্মেলনকক্ষে ঢুকলেই অন্য রকম একটা আভা ছড়িয়ে পড়ত। ডুবন্ত সূর্যের আলো ম্লান হয়ে আসত, সংবাদ সম্মেলনকক্ষে জ্বলে উঠত বিজলিবাতি। কিন্তু বিজলিবাতির আলোকে ম্লান করে দিয়ে কক্ষজুড়ে ছড়িয়ে পড়ত টেন্ডুলকার–আভা!

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকেরা এমন একটি বিশেষ সন্ধ্যার সাক্ষী হয়েছিলেন ২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বর। ঘড়ির কাটা বিকেল পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনকক্ষে শচীন টেন্ডুলকার ঢুকতেই খানিক নীরবতা নেমে আসে। ঢাকা টেস্টের দ্বিতীয় ছিল সেটি। নিজেদের প্রথম ইনিংসে টেস্ট ক্যারিয়ারের ৩৪তম সেঞ্চুরি করে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন টেন্ডুলকার। যে সেঞ্চুরিটি ছিল টেস্ট ক্রিকেটে সুনীল গাভাস্কারকে ছুঁয়ে ফেলা সেঞ্চুরি।

ক্যামেরা, মিনি ক্যাসেট প্লেয়ারের রেকর্ড বোতাম অন–টন করে দেওয়ার পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। শুরুতেই তরুণ এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বের ছোট একটা সেশন হয়ে যায়। টেন্ডুলকার আর সেই সাংবাদিকের কথপোকথন ছিল এ রকম—

প্রশ্ন: দেখেছি আপনি সেঞ্চুরি করার পর মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার সময় সুনীল গাভাস্কার আপনাকে বুকে টেনে নিয়েছেন। একই সঙ্গে কিছু বলেছেনও উনি। কী বললেন?

টেন্ডুলকার: প্রথমে তিনি তাঁকে ছুঁয়ে ফেলার জন্য আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এরপর কানে কানে বলেছেন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করতে।

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করা সম্ভব?
টেন্ডুলকার: আমি আসলে কোনো রেকর্ড–টেকর্ড গড়ার জন্য খেলি না। আমি দলের জন্য খেলি, দলকে জেতাতে রান করি। সেটা করতে গিয়েই সেঞ্চুরি হয়ে যায়। কখনো কখনো রেকর্ডও হয়। কিন্তু রেকর্ড, মাইলফলক; এগুলো মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে নামি না আমি।

প্রশ্ন: সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করা কি সম্ভব?
টেন্ডুলকার: ওই যে বললাম আমি দলের জন্য খেলি। যত দিন পারি দলের জন্য খেলব। যদি ও রকম কিছু হয়ে যায়, তাহলে হবে!

গাভাস্কার যেদিন টেন্ডুলকারের কাছে সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করার দাবি রেখেছিলেন, সেদিন টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি ছিল ৭১টি (টেস্টে ৩৪, ওয়ানডেতে ৩৭)। তখনো টেন্ডুলকার ভালো খেলছিলেন, ছিলেন ছন্দে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে শুরু ক্যারিয়াটা যে সে সময় মধ্যগগণে ছিল, তা বলা যাবে না। ক্যারিয়ারের দেড় দশক পেরিয়ে গেছে তখন। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন হয়তো তাঁর ক্যারিয়ার ভাটার টানে।

২০০৪ সালের পর কয়েকবার টেন্ডুলকারের ফর্ম নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। কয়েকবারই তাঁর ক্যারিয়ারের এপিটাফও লিখে ফেলেছিলেন অনেকে। কিন্তু খেলোয়াড়টি যখন টেন্ডুলকার, তখন ছাইভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো তো জেগে উঠতেই পারেন। উজানে তরী বেয়ে বেয়ে আরও ৯ বছর ক্যারিয়ারটা টেনে নিয়ে গেছেন। ব্যাটটা শোকেসে তুলে রেখেছেন ২০১৩ সালে। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বর সুনীল গাভাস্কার তাঁর কাছে যে দাবিটি তুলেছিলেন, সেটি নিয়ে টেন্ডুলকার কোনো কথা দেননি। তবে উত্তরসুরির দাবিটি হয়তো মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছিলেন। তাই তো সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি করেই ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন।

প্রথম এবং এখন পর্যন্ত ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০০ (টেস্টে ৫১, ওয়ানডেতে ৪৯) সেঞ্চুরি করা একমাত্র ক্রিকেটার টেন্ডুলকার। এই যে অনির্বচনীয় এক ইতিহাস রচনা হলো টেন্ডুলকারের ব্যাটে, এর দাবিটি কিন্তু উঠেছিল ঢাকাতেই। হতে পারে কাকতাল, হতে পারে অদ্ভুত; কিন্তু গাভাস্কারের সেই দাবি টেন্ডুলকার পূরণ করেছেন ঢাকাতেই। এবার শুধু স্টেডিয়ামটা বদলেছে। ২০১২ সালের ১৬ মার্চ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টেন্ডুলকার তাঁর শততম সেঞ্চুরিটি পেয়েছেন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে।

টেন্ডুলকার ৯০–এর ঘরে ঢোকার পর থেকেই তাঁর প্রতিটি রান হাততালিতে বরণ করে নিচ্ছিলেন শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের দর্শক। ইতিহাসের সাক্ষী হতে উদগ্রীব বাংলাদেশের সমর্থকেরা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন টেন্ডুলকারের একেকটি রান ভারতের স্কোরবোর্ডে যোগ হচ্ছিল বাংলাদেশের জন্য বোঝা হিসেবে। আসলে ইতিহাসের ডাকেই সেসব ভুলে গিয়েছিল তাঁরা! টেন্ডুলকার যখন ৯৯ রানে, তাঁকে বোলিং করছিলেন আবদুর রাজ্জাক। তাঁর দুটি বলে মুখোমুখি হয়েও রান পাননি টেন্ডুলকার।

পরের ওভারটি করেছেন সাকিব আল হাসান। ওভারের চতুর্থ বলটিতে মুখোমুখি হন টেন্ডুলকার। স্কয়ার লেগে বল ঠেলে দিয়েই একটি রান নিয়ে ইতিহাস হয়ে যান টেন্ডুলকার। দিবারাত্রির ম্যাচটিতে তখন ফ্লাডলাইটের কৃত্রিম আলো ম্লান করে দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে টেন্ডুলকারের আভা! শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তখন অন্য রকম এক দৃশ্য। পুরো গ্যালারি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে টেন্ডুলকারকে। সবার চোখেমুখে তখন ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারার আনন্দ–আভা!

টেন্ডুলকারের ইতিহাস গড়া ম্যাচটি জিততে পারেনি ভারত। এশিয়া কাপের ম্যাচটি বাংলাদেশের কাছে হেরেছে তারা ৫ উইকেটে। কিন্তু অমন ঐতিহাসিক ম্যাচে হার–জিত নিয়ে কেই–বা আর ভাববে। ম্যাচ শেষে মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ক্রিকেট ইতিহাসের নায়ক শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের সংবাদ সম্মেলনটি। কে জানে আবেগঘন সেই সংবাদ সম্মেলনে সেদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ২০০৪ সালের ১১ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনটির কথা মনে পড়েছিল কি না টেন্ডুলকারের!

তা সেটি তাঁর মনে পড়ে থাকুক আর নাই থাকুক; শেরেবাংলার সংবাদ সম্মেলনে ৮ বছর আগের সেই টেন্ডুলকারই ধরা দিলেন! ক্রিকেট ইতিহাসে এমন এক অমরাবতী রচনা করেও যিনি বরাবরের মতোই মহাবিনয়ী আর সাদাসিধে এক মানুষ! কীভাবে? সেদিনের সেই সংবাদ সম্মেলন আর ১৬ মার্চ ২০২১ সালের সংবাদ সম্মেলনে তাঁর বলা কথাগুলো মিলিয়ে দেখলেই সেটা স্পষ্ট হবে। এমনিতে মাঠেও ক্যারিয়ারের ১০০তম সেঞ্চুরিটাও নিজের আর দশটা সেঞ্চুরির মতোই উদযাপন করেছেন। যেখানে ছিল না আবেগের কোনো বাড়াবাড়ি।

১৬ মার্চ, ২০১২ সালের সংবাদ সম্মেলনে টেন্ডুলকার বলেছেন, ‘আমি এ মাইলফলক নিয়ে কখনো ভাবিইনি। সংবাদমাধ্যমই আসলে এটা শুরু করেছে। রেস্তোরাঁ, রুম সার্ভিস; আমি যেখানেই যেতাম—সবাই ১০০তম সেঞ্চুরি নিয়ে কথা বলতে চাইত। আমি যে এর আগে ৯৯টি সেঞ্চুরি করেছি, সেটা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলত না। এ সেঞ্চুরিটি করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। বল ঠিকভাবে ব্যাটে আসছিল না। কিন্তু কীভাবে সেঞ্চুরি পেলাম, সেটা ব্যাপার নয়। আপনাকে মাথা নিচু করে দলের জন্য রান করে যেতে হবে।’

শত কোটি ভারতীয়দের কাছে টেন্ডুলকার ক্রিকেট–দেবতা। কিন্তু দিন শেষে তিনিও তো রক্তমাংসে গড়া একজন মানুষই। তাই তো সংবাদ সম্মেলনের এক ফাঁকে আবেগ আর ধরে রাখতে পারেননি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ফেললেন, ‘স্বপ্ন কখনো না কখনো সত্যি হয়ই। এই যে বিশ্বকাপের কথাই ধরুন না, একটি বিশ্বকাপ জয়ের জন্য আমি ২২ বছর অপেক্ষা করেছি!’

আজ ছিল টেন্ডুলকারের সেই শততম সেঞ্চুরির নবম বছর পূর্তি। ২২ বছরের অপেক্ষার পাওয়া বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের মুহূর্তটা যেমন টেন্ডুলকার ভুলতে পারবেন না, ভুলতে পারবেন না শততম সেঞ্চুরি পাওয়ার মুহূর্তটিও। এ কারণেই তো ভারতের রায়পুরে রোড সেফটি ওয়ার্ল্ড সিরিজ খেলতে গিয়েও দিনটি মনে রেখেছেন টেন্ডুলকার। উপলক্ষটি উদযাপন করেছেন কেক কেটে। কে জানে হয়তো ভারত লেজেন্ডস দলের সতীর্থদের পীড়াপিড়িতেই সেটা করেছেন!