রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৮ বছর আজ
প্রকাশ : 2021-04-24 08:53:21১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার রানা প্লাজার আট তলা ভবন ধসে পড়ে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয় ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক। আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমজীবী মানুষ। এ ঘটনায় চারটি মামলা করা হয়।
দীর্ঘ আট বছরে চারটি মামলার মধ্যে সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে রানা ও তার মায়ের বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলা নিষ্পত্তি হলেও বাকি তিনটি মামলা নিষ্পত্তির মুখ দেখছে না। এরমধ্যে হত্যা ও ইমারত আইনের রাজউকের মামলাটি এখনও সাক্ষ্যগ্রহণই শুরু হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ‘দুজন আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য খোঁজ খবর নিলেও সাক্ষ্য নিতে পারছেন না রাষ্ট্রপক্ষ। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হবে।’
রানা প্লাজা হত্যা মামলা
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজার ১৩৬ জন। আহত হয়েছিলেন আরও সহস্রাধিক শ্রমিক। এ ঘটনায় পরদিন সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’র অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেন।
২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় অভিযোগ পত্রে ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়। আসামি ৪১ জনের মধ্যে তিন আসামি মারা যান। বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৩৮ জন।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করলেও এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মিজানুর রহমান বলেন, ‘হত্যা মামলাটির অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন ছয়জন আসামি। আবেদনের প্রেক্ষিতে ছয়জনের স্থগিতাদেশ দেন উচ্চ আদালত। পরবর্তীতে চারজনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। কিন্তু দুই আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাত উল্লাহ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষে এখনও স্থগিতাদেশ থাকায় মামলাটির বিচার কার্যক্রম বা সাক্ষ্যগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস কক্ষে চারবার লিখিত আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু তার কোনো উত্তর পাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ মামলায় ৫৯৪ জন সাক্ষী রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেক সাক্ষী সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য খোঁজ খবর নেয়। কিন্তু আমরা তাদেরকে বলেছি আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে আপনাদেরকে জানাব। একদিন একজন অসহায় এক সাক্ষী আদালতে হাজির হলেও মামলার স্থগিতাদেশ থাকায় বিচারক সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পারেননি। মূলত মামলায় দুজনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলেই আমরা মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করতে পারব বলে আশা করছি।
মামলায় দীর্ঘ সময় ধরে বিচারিক কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় বিচারে কোনো বিঘ্নিত ঘটবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তা তো কিছুটা হবেই। কারণ আসামিদের ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেললে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আর সাক্ষীদের ক্ষেত্রেও এরকম ঘটনা ঘটবে। এই মামলার সাক্ষীদের বেলায় তো ভিন্ন। কারণ এ মামলার সাক্ষীরা হচ্ছেন শ্রমিক, গরীব, অসহায় ও দিনমজুর। তাদের অনেকেই ভাসমান সাক্ষী।
ইমারত আইনে রাজউকের মামলা
আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ইমারত নির্মাণ আইনে সাভার থানায় আরেকটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ১৩০ জনকে মামলার সাক্ষী করা হয়।
২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। তবে এ মামলায় ও এখন পর্যন্ত কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, ‘এই মামলায় আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে গিয়ে অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন মামলা করেন। এরপর উচ্চ আদালত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। এই কারণে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে ঝুলে আছে।
ইমারত আইনে দুর্নীতি মামলা
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে দেখা যায়, রানা প্লাজা নির্মাণে ছয় তলার অনুমোদন থাকলেও আট তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। এ কারণে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় সাভার থানায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন একটি মামলা দায়ের করে দুদক। ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মফিদুল ইসলাম। বর্তমানে এ মামলা ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, ‘মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। করোনার কারণে আদালত বন্ধ থাকায় কার্যক্রম চলছে না। এ পরিস্থিতি কেটে গেলে মামলাটির বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারব বলে আশা করছি।’
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের অভিযোগ দুদকের মামলা
২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও তার মা মর্জিনা বেগমের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় রানা প্লাজার নির্মাণের তথ্য গোপন করে দুদকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯০০ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ করা হয়।
গত ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট এ মামলার রায় দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস। দুদকের দায়ের করা এই মামলার রায়ে সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ের আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই মামলায় তার মা মর্জিনা বেগমকেও তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে অবৈধভাবে অর্জিত সাভার বাজার রোডের ৬৯/১ বাড়িটির এক-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করারও আদেশ দেন আদালত।
আসামি রানার আইনজীবী ফারুক আহাম্মেদ বলেন, রানা প্লাজা হত্যা ও ইমারত আইনে দুইটি মামলায় দুই আসামি পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ আট বছরেও মামলাটির বিচার শুরু করতে পারেনি রাষ্টপক্ষ। এ মামলায় কারাগারে থাকা একমাত্র আসামি রানার ছাড়া সকলে জামিন আছেন। শুধু আসামি রানা জামিন পাচ্ছেন না। বিচারক রাষ্ট্রপক্ষকে কয়েকবার উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত দ্রুত নিয়ে আসতে বলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তা পারছেন না। বিনা বিচারে একজন আসামিকে এভাবে আটকে রাখা যায় না।’
ফারুক আহাম্মেদ আরও বলেন, ‘আমরা আদালতকে বলেছি, দুজন আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতে মামলার স্থগিতাদেশ রয়েছে। তাদের ছাড়া অপর আসামিদের মামলার বিচার নিষ্পত্তি করতে। কিন্তু বিচারক আমাদেরকে বলেন এভাবে সম্ভব না। রাষ্ট্রপক্ষ আদেশ নিয়ে আসুক। আদেশ নিয়ে আসলে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করব।’