রহস্যে ঘেরা রাজা হরিশচন্দ্রের দিঘি
প্রকাশ : 2021-09-26 14:49:56১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
মোহাম্মদ আবুল খায়ের মৃধা
-------------------------------
আষাঢ় মাস। আকাশ যখন-তখন রঙের খেলায় মেতে ওঠছে। এই মেঘ তো এই রোদ। বৃষ্টিস্নাত কদমের দেখা এখনো মেলেনি। তাই বলে কি কদম ফোটেনি? ফুটেছে কোথাও, চোখে পড়েনি।
সূর্যি মামা কয়েক দিন ধরে হাড়জ্বলা রোদ দিচ্ছে। রোদে দাঁড়ালে চামড়া পুড়ে যাওয়ার অবস্থা, বেশি সময় রোদে দাঁড়াতে পারছি না।
রোদবৃষ্টি মিশেলের দিনগুলোয় নিসর্গের গাছপালা ও লতাগুল্মের পত্রপল্লবেরা ঘনসবুজে নিজেদের রাঙাতে মেতে ওঠে। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে যতদূর চোখ যায় প্রশান্তিদায়ক সবুজ আর সবুজ, চোখ ফেরানো দায়।
লৌহজংয়ের তুলনায় টঙ্গিবাড়ি ও মুন্সীগঞ্জের জমি কিছুটা উঁচু। জমির এমনতরো সুবিধা নিয়ে বহুকাল ধরে এ অঞ্চলে সবজির চাষ হয়ে আসছে। নিত্যদিনের চাহিদা মেটাচ্ছে। রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহারের আশেপাশে সমান তালে মাচায় ঝুলে আছে ঝিঙে ও কহি। একবার ফল ধরেছে, আরও ফল ধরার আশায় শাদা ও হলুদ ফুলগুলো বিবাহযোগ্য বালিকার ন্যায় সৌন্দর্য বাড়ানোর কসরতে ব্যস্ত।
রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহারে মাঝারি আকারের তালগাছটায় জড়িয়ে রয়েছে অজস্র বুনো লতা-গুল্ম। যেন বহুদিনের বোঝাপরা-দুস্তি। সহসা বয়ে যাওয়া উদ্দাম হাওয়া সবচেয়ে দীর্ঘ লতাটির নুয়ে পড়া মাথাকে বারকয়েক ঝাকিয়ে গেল। হাওয়ার পেলব ছোঁয়া আমাদের তপ্ত শরীর মুহুর্তে জুড়িয়ে দিল। আচমকা গায়ে লাগা হাওয়ায় দেহ জুড়িয়ে আমাদের রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহার ভ্রমণ সাঙ্গ হলো।
রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহার পেছনে ফেলে রিজার্ভ করা ইজিবাইকে আমরা ছুটে চলেছি রাজা হরিশচন্দ্রের দিঘির দিকে। হানিফ চুপচাপ। নিরব। কথা বলছে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে হু হা করে উত্তর সারছে, তার মানে সে ফুরফুরে মেজাজে আছে, এমন সময়ে তাকে পটিয়ে কাজ উদ্ধার করা যায়। পটাবো কী, নিজে থেকে পটে বসে আছে। বিপ্লব ওর কাধের ওপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে কিন্তু কিছুই বলছে না সে, বিরক্ত হচ্ছে না মোটেও। জুয়েল বিপ্লবের হা-করা ঘুমন্ত মুখে মটর দানা পুরে দিল কয়েকটা। বিপ্লবের হা-করা মুখ থেকে লালাসমেত মটর দানা হানিফের উরুতে এসে পড়ল, প্যান্টের কিছুটা জায়গা ভিজে গেল। তাতেও হানিফ বিরক্ত হলো না, বরং বিপ্লবের ঘুমন্ত-শান্ত-মায়াভরা মুখ দেখে সে আরও স্নেহশীল হয়ে ওঠল। পৃথিবীর সকল ঘুমন্ত মানুষের মুখই মায়াভরা। যত চোর-ডাকাত-বাটপারই হোক, ঘুমোলে সে শান্ত-সমাহিত-মায়ামাখা।
রঘুরামপুর বৌদ্ধবিহার পেছনে রেখে বাঁয়ে ঘুরে পিচঢালা আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমরা চলে এলাম রাজা হরিশচন্দ্রের দিঘিতে। কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়াতলে দিঘির এক কোণায় এসে দাঁড়ালাম। সেখান থেকেই পুরো দিঘিটা ভালোভাবে দেখা যায়। দিঘির চারদিকে বসতি। আড়াআড়ি দুপারে শান বাঁধানো ঘাট। পিচঢালা পথ লাগোয়া শান বাঁধানো ঘাটের ঠিক পাশেই বালক বয়সী অশ্বত্থ গাছ। আর এর তলা ধরে কিছুটা জায়গা নিয়ে নেপিয়ার ঘাস। পুরুষেরা নাইছে সেই ঘাটে। জলে অজস্র ছোট ছোট তরঙ্গ সৃষ্টি করে হাপুস হুপুস ডুব দিচ্ছে। আমাদের কাছেই ছিল তক্তায় বানানো আরেকটি ঘাট।
তক্তায় বানানো ঘাটে গৃহস্থ বাড়ির মহিলারা সাবান ঘষে ঘষে নাইছে। সেদিকে আড় চোখে দেখা যায়। সরাসরি তাকানো যায় না, অশোভন ঠেকে। নূপুর-জড়ানো-ফর্সা পায়ে সাবান ঘষে ঘষে গল্প জুড়ে দিয়েছে এক তরুণী আরেক তরুণীর সঙ্গে। ওঠবার নাম করছে না। যেন কোনো তাড়া নেই। কাজ নেই। কোনো দায় নেই সমাজ-সংসারে। যেন সময় এসে থমকে গেছে তার পায়ের ওই নূপুরের কাছে। এ মুহুর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তার পা ঘষা। তার এই অগ্রাধিকারের কাছে বাকিদের সব কাজ যেন তুচ্ছ। মুরুব্বি গোছের এক মহিলা এসে ওদের তাড়া দিয়ে গেল। কিন্তু সেই তাড়া তুচ্ছ করে দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠল ওরা। হাসপি সাত-পাঁচ না ভেবে সেদিকে ক্যামেরা তাক করল। বোধহয় ওদের খিলখিল হাসি হাসপিকে মুগ্ধ করেছে। সেও তো ওদের মতোই তরুণ আর প্রাণশক্তিতে ভরা। সমাজ-সংসারের প্যাঁচঘোচ এখনো রপ্ত করতে পারেনি। শাদা মনে তাই ছবি তুলতে চাইল। আমার আপত্তিতে শেষে নিবৃত্ত হলো।
বালক বয়সী অশ্বত্থ গাছটা সামান্য ছায়া তৈরি করেছে। বেশকিছু ডালপালা নিয়ে ঝাঁকড়া মাথা। পাতার মাথায় কাকিলা মাছের ঠোঁটের মতো সূচালো লেজ। হঠাৎ বাতাসের দমকে পাতার দেহে পৌষের কাঁপন লেগে ঝনঝনিয়ে ওঠে। ঝোপালো ঝাঁকড়া মাথাটাকে নাড়া দিয়ে অপ্রস্তুত করে যায়। ঘুমিয়ে থাকা গাছটি যেন হঠাৎ সম্বিত ফিরে পায়। সজাগ হয়ে ওঠে। তার থেকে সবুজ নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। সূর্যের সাথে তার বড় সখ্য। স্বপ্ন তার সূর্যকে ছোঁবে। কত তাড়াতাড়ি কত দ্রুত সে সূর্যকে ছুঁতে পারবে এই তাড়না তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সব সময়। এই তাড়নাই একদিন মহীরুহ করে তুলবে তাকে। মানুষ-পশু-পাখি-প্রাণিকূলের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠবে সে। পাখিরা তার ডালে আশ্রয় নেবে। খাবার খাবে। দিশাহীন কিছু মানুষ তার তলে এসে মোমের শিখা জ্বেলে মানত করবে সুখ-স্বপ্ন-প্রশান্তির আশায়।
অশ্বত্থ তলের নেপিয়ার ঘাসগুলো হানিফ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আচমকা আমাদের অবাক করে দিয়ে একটা নেপিয়ার ঘাস উপড়ে ফেলল। শেকড় থেকে শুরু করে প্রতিটি অংশ পরখ করে দেখল। কী মনে করে যেন পাতার কিছুটা অংশ মুখে পুরে চিবাল কিছুক্ষণ। মুখ বিকৃত করে ওয়াক থু করে মাটিতে ফেলে দিল তারপর। সে খামার দেবে। যেখানেই খামার সম্পর্কিত কোনো কিছু দেখে, সেটা তার পরখ করা চা-ই চাই।
টলমল কালচে সবুজ জল। ছোট ছোট ঢেউ খেলছে। কচুরিপানা নেই একদমই দিঘিটায়। ওধারে তিন কিশোরী সাঁতার কাটছে। ঝাঁপাঝাঁপি দাপাদাপি করছে। জল ছুঁড়ে মারছে। শালিক পাখির মতো জলের ঝাঁপটা দিচ্ছে। একে অপরকে তলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে ওরা। চুপচুপে ভেজা মাথা থেকে মুখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে অবিরত। সাঁতরাতে সাঁতরাতে হাত-মুখে শ্যাওলা বসে গেছে। চোখগুলো গোলাপের মতো রক্তিম হয়ে ওঠেছে। ওদের মধ্য থেকে ছিপছিপে গড়নের শ্যাম বর্ণের বালিকাটি কয়েক ঢোক পানি গিলে ফেলল। খুক খুক করে কাশল কিছুক্ষণ।
কিছুদিন পেরোলে ওই তিন কিশোরীর নারী হওয়ার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে থাকবে। মুক্ত হাঁসের মতো ঢলোঢলো জলে এমন করে সাঁতরাবে না আর। রাখঢাকের ব্যাপার চলে আসবে। ওদের জায়গা হবে ঘাটের সিঁড়িতে, সেখান থেকে গোসল করবে। এটা যে কেউ বলে দেবে, তা না। সমাজ-সংসারে চলতে চলতে নিজেরাই বুঝে নেবে কী করতে হবে, কী হবে না। ত্বকের যত্ন নেওয়া শুরু করবে একসময়। প্রতিদিনই সুন্দরী হওয়ার ব্যাকুলতায় নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা হবে। মন ভরবে না কিছুতেই। বিয়ের আগ পর্যন্ত চলবে এমন করেই। শিগগিরই সমাজে তাদের চলন-বলন ধর্তব্যের মধ্যে চলে আসবে ।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে রাজা হরিশচন্দ্রের দিঘির অবস্থান। এর জন্মকাল কেউ ঠিক মতো বলতে পারে না। ধারনা করা হয়, ১০৯১ থেকে ১১০৩ পর্যন্ত পাল রাজাদের শাসনামলে দিঘিটি খনন করা হয় এবং বৌদ্ধ রাজা হরিশচন্দ্র এটি খনন করেন। দিঘিটি সম্পর্কে লোকমুখে নানা রকমের কথা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, মাঘী পূর্ণিমায় নাকি এটি রহস্যময় হয়ে ওঠে। তাই এ রহস্যকে ঘিরে এখানে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমায় মেলা বসে। মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, তৈজসপত্র–এসবের পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এসে মানত করে। মানত পূরণ হলে পরের বছর এসে সিন্নি দেয়। ব্রিটিশ শাসনামলে নাকি একবার দিঘিটির পানি সেচে পুরোপুরি শুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু পানি না কমার কারণে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। আর জনৈক জমিদার নাকি দিঘিটি পরিস্কার করার জন্য হাতি ও কিছু লোক নিয়োগ করেছিল, পরিস্কার তো কিছু হয়ই নি, বরং হাতি ও লোকগুলো অপঘাতে মরেছে-এসবই জনশ্রুতি। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত জনশ্রুতি হলো, দিঘিটির সঙ্গে কোনো বেয়াদবি হলে লোকেদের অনিষ্ট হয়। (চলবে)
প্রয়োজনীয় তথ্য: ঢাকার গুলিস্তান সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটের সামনে থেকে বাবুবাজার ব্রিজ হয়ে ঢাকা-মাওয়া রোডে মুন্সীগঞ্জগামী গাঙচিল পরিবহনের বাস কিছুক্ষণ পরপর বালিগাঁওয়ের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৭০ টাকা। সেখান থেকে ইজিবাইকে সুখবাসপুর দিঘি পর্যন্ত ভাড়া নেবে ৩০ টাকা। সুখবাসপুর দিঘি থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় রঘুরামপুর রাজা হরিশচন্দ্রের দিঘি ২০ টাকা ভাড়া। আর যদি বালিগাঁও থেকে ইজিবাইক রিজার্ভ নিতে চান, তবে আপডাউন ভাড়া পড়বে কমবেশি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। এক্ষেত্রে দরদাম করে নেবেন। তা ছাড়া নৌপথে ঢাকার সদরঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জগামী লঞ্চে করেও যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ভাড়া পড়বে ৫০ টাকার মতো। বালিগাঁও, সিপাহিপাড়া ও মুক্তারপুর ব্রিজের কাছে কয়েকটি খাবার হোটেল আছে। আপনার সুবিধা মতো জায়গায় খাওয়াদাওয়া করে নেবেন। দিনে গিয়ে দিনেই ঘুরে আসতে পারবেন। আর যদি থাকার ইচ্ছে হয়, তবে মুন্সীগঞ্জ শহরে কয়েকটি হোটেল আছে, সেখানে খোঁজখবর নিয়ে পছন্দ মতো হোটেলে থাকতে পারবেন।
বিক্রমপুরের হীরা-মানিকের খোঁজে' পূর্ববর্তী পর্বের লিংকগুলো পেতে নিচে ক্লিক করুনঃ
(পর্ব-১) https://cutt.ly/RQSRLZS
(পর্ব-২) https://cutt.ly/PQSR6Ue
(পর্ব-৩) https://cutt.ly/3QSTfo7
(পর্ব-৪) https://bit.ly/3yqUsmh
(পর্ব-৫) https://cutt.ly/TEn5u0J