মুক্ত চিন্তা নিয়ে দর্শন সম্মোলন হলো সৌদিআরবে!
প্রকাশ : 2021-12-18 12:17:27১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক নাগরিককে জেলে পাঠানো সৌদি আরবে সম্প্রতি তরুণদের ‘মুক্তচিন্তায় উৎসাহিত’ করতে দর্শনের উপর একটি বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেল।
রিয়াদে গত সপ্তাহে হওয়া তিনদিনের এই সম্মেলনে বিশ্বের নামি অনেক অধ্যাপক অংশ নিয়েছেন; তাদের মধ্যে মার্কিন দার্শনিক মাইকেল সান্ডেলও ছিলেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।
ভার্চুয়ালি উপস্থিত হয়ে হার্ভার্ডের এ অধ্যাপক সম্মেলনের আয়োজকদের বলেন, তিনি লেকচার দিতে চান না, তার বদলে সৌদি তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চান।
কিং ফাহাদ ন্যাশনাল লাইব্রেরির কনফারেন্স সেন্টার থেকে ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচারিত এই সেশনে সান্ডেল সৌদি আরবের চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে ক্রিটিকাল রিজনিং ও নৈতিক দর্শন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন।
ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতাবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলার চর্চা যে দেশে নেই বললেই চলে সেখানে এই ধরনের আয়োজন বেশ অস্বাভাবিকই, বলেছে বিবিসি।
সান্ডেল করোনাভাইরাস মহামারী প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্কে শিক্ষার্থীদের প্ররোচিত করেন; তারপর একটি নৈতিক প্রশ্নের দিকে আলোচনা ঘুরিয়ে নেন। প্রশ্নটি হচ্ছে- খুনি কারও আত্মীয় হলে, তার কি উচিত খুনিকে ধরিয়ে দেওয়া, নাকি বাঁচানো? এর উত্তরে এক শিক্ষার্থী বলেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
“এমনকী বাবা যদি খুনি হয়, তাহলে তাকেও ধরিয়ে দেবো,” তার এই উত্তরে উপস্থিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বড় অংশই করতালি দেয়। শিক্ষার্থী যখন এ উত্তর দিচ্ছিলেন, তখন কনফারেন্স সেন্টারে তার বাবাও উপস্থিত ছিলেন।
সান্ডেল এরপর চীনের একটি প্রাচীন গল্প শোনান, যেখানে একজন শাসক তার বাবার খুনের কথা জানতে পেরে কি করবেন তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন।
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশুগজি হত্যাকাণ্ডে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের হাত আছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, তার সঙ্গে চীনা এ গল্পের সংযোগের বিষয়টি কারওই চোখ এড়াবে না। রিয়াদ অবশ্য শুরু থেকেই খাশুগজি হত্যাকাণ্ডে ক্রাউন প্রিন্সের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা, সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক খাশুগজিকে ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর হত্যা করা হয়।
ওয়াশিংটন পোস্টের কলামনিস্ট খাশুগজি সৌদ রাজপরিবার, বিশেষ করে যুবরাজ মোহাম্মদের কিছু কাজ নিয়ে সমালোচনা করে কলাম লিখেছিলেন। এর বাইরেও সৌদি আরবে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দমনপীড়ন চালানোর অসংখ্য নজির আছে।
গত মাসেও এক সৌদি নাগরিককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মত প্রচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ইয়েমেনি এক সাংবাদিককে দেওয়া হয়েছে ১৫ বছরের কারাদণ্ড।
‘ডি ফ্যাক্টো’ শাসক মোহাম্মদ বিন সালমানের আমলে ইসলাম প্রচারক থেকে শুরু করে লুজাইন আল-হাথলুলের মতো নারী অধিকার কর্মী, অনেককেই কারাগারে যেতে হয়েছে। সৌদি আরবে দর্শন সম্মেলেনে অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে সান্ডেল পরে বিবিসিকে বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া তাকে মুগ্ধ করেছে।
যাদের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে তারা কেউই দর্শন নিয়ে পড়েনি, অথচ নৈতিক প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কে তাদের ক্ষুধা তাকে চমকে দিয়েছে।
“অংশগ্রহণকারীরা যদি সেশন শেষ হওয়ার পরও আমরা যা নিয়ে আলোচনা করেছি সেই নৈতিক দ্বিধা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রাখতে পারে, তাহলে আমি একে সাফল্যই বলবো, অন্ততপক্ষে প্রথম ধাপ বলবো। সৌদি সমাজব্যবস্থা আদতে তাদেরকে কতটুকু অনুমতি দেবে তাও অবশ্য দেখার বিষয়,” বলেছেন সান্ডেল।
দর্শন সম্মেলনে অংশ নিতে পারা শিক্ষার্থীরাও বেশ খুশি। এদের একজন বলছেন, এই আয়োজন তার চোখ খুলে দিয়েছে। এক হাজার বছর আগেও আরব চিন্তকরা দর্শন অধ্যয়নে সামনের সারিতে ছিলেন, তারা আরবি ভাষায় ভাষান্তরিত করে প্রাচীন গ্রিক চিন্তাকে সংরক্ষণে সহায়তাও করেছেন।
সেদিন অনেক আগেই গত হয়েছে। সৌদি আরবের প্রভাবশালী মুসলিম ধর্মগুরুরা অনেকদিন ধরেই জ্ঞানকে কুরআন ও অন্যান্য পবিত্র গ্রন্থ মুখস্ত রাখা ও তার ব্যাখ্যা জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
গত বছর সৌদি আরবের তখনকার শিক্ষামন্ত্রী পাঠ্যক্রমে ক্রিটিকাল থিংকিং ও দর্শন যুক্ত করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে ঘোষণা করেছিলেন। এরপরই তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়; এবং ওই পরিকল্পনাও এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।