মাদারীপুরে দশ বছরে বিলীন ৩৭ হাজার খেজুর গাছ

প্রকাশ : 2021-12-30 15:17:45১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

মাদারীপুরে দশ বছরে বিলীন ৩৭ হাজার খেজুর গাছ

এক সময় মাদারীপুরে গ্রাম-গঞ্জে মাঠে ঘাটে খেজুর গাছ দেখা গেলেও কালের আবর্তে তা হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা বিলুপ্তির পথে খেজুর গাছ। আগের সেই খেজুর গাছের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখাও যায় না। গেলো দশ বছরে মাদারীপুর থেকে বিলীন হয়েছে ৩৭ হাজার খেজুর গাছ। এমন তথ্যই দিয়েছে মাদারীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

খেজুর গাছ বিলীন হওয়ার পিছনে জ্বালানির জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, পরিবেশ দূষণ, আবাদি জমিতে বসতভিটা ও ইট ভাটার কারণকেই দুষছেন পরিবেশবাদীরা। ফলে আগের মতো আর গাছি বা শিয়ালদের রস সংগ্রহ করতে দেখা যায় না। তারাও পেশা পাল্টে নিচ্ছেন।

মাদারীপুর সদরের বেশ কয়েকটি প্রত্যন্ত গ্রাম ঘুরে গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, শীত আসলেই গাছিরা খেজুর গাছকে বিশেষ কায়দায় ছাল তুলে রস সংগ্রহের উপযোগী করে তোলেন। পরে সেখানে হাড়ি বসিয়ে রস সংগ্রহ করা হতো। তারপর ওই রস থেকে খেজুরের গুড় তৈরি করে তা বিক্রি হতো হাট-বাজারে। কেউ বা কাঁচা রস কিনে নিতেন গাছিদের কাছ থেকে। কেউবা গাছের রস রক্ষার জন্য রাত জেগে খেজুর গাছ পাহারা দিতেন। পুরো শীত মৌসুম জুড়েই থাকতো খেজুর গাছের কদর। এখন শীত মৌসুম চলছে কিন্তু দেখা মিলছে না গাছিদের।

কথা হলো সদর উপজেলার চরগোন্দ্রিপুর গ্রামের ৩০ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটা বাবুল শিকদারের সাথে। তিনি বলেন, ‘আগে কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে বের হয়ে দুই-তিন ঘন্টা খেজুরের রস সংগ্রহ করতাম। পরে রস জ্বলিয়ে গুড় তৈরি করতাম। কিন্ত তা কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে এখন আর সেই আগের ব্যস্ততা নেই। শীত আসলে কিছু গাছ কেটে পরিবার আর এলাকার চাহিদা মিটিয়ে স্বল্প আয় হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘আগে আমাদের অনেক খেজুর গাছ ছিলো কিন্তু এখন আছে মাত্র ১০টা। অনেক গাছ মরে গেছে। এখন মাত্র তিনটি গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ করি। আর অন্যের কিছু গাছ কেটে কোন রকম চলে যাচ্ছে। আগামীতে আমাদের সন্তনরা হয়ত এ পেশায় থাকবে না।’

এ.আর হাওলাদার জুট মিল এলাকার মোস্তাক উদ্দিন বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও যে দিকে তাকাতাম, সে দিকেই ছিলো খেজুর গাছ। শীতের দিনে তো গাছে গাছে ছিলো হাড়ি। গাছ ছোলার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন গাছিরা। রস বিক্রি আর গুড় তৈরির ধুম পড়ে যেতো পুরো এলাকায়। রসের জন্য মানুষের সিরিয়াল পড়তো। কিন্তু এখন আর সেই চিত্র নেই। নানা কারণে খেজুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, সামন্য কিছু গাছ থাকলেও আগের মত রস সংগ্রহের সেই ধুম নেই। ’ 

সদর উপজেলার কুনিয়ার গাছি জাহাঙ্গীর শরীফ বলেন, ৪০ বছর ধরে খেজুরের গাছ থকে রস সংগ্রহের কাজ করছি, আগে প্রচুর পরিমাণে রস সংগ্রহ করতাম। পুরো শীতের মৌসুম কাটতো খেজুর গাছ নিয়ে। এখন মাত্র ২০-৩০ টি গাছ নিয়েই আছি। খেজুর রস ও গুড়ের ব্যাপক চাহিদা থাকা স্বত্বেও গাছ না থাকায় সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না। ইটভাটা মালিকেরা খেজুর গাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছে, অনেকে বেশি টাকার আশার গাছ বিক্রি করছেন। আবার অনেক সময় অজ্ঞাত কারণে গাছ মরে যাচ্ছে।’

একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী শিহাব হাওলাদার বলেন, ‘খেজুর গাছ একদিকে গ্রামের শোভা বর্ধন করে অন্যদিকে মুখরোচক খাবার রসও পাওয়া যায়। এখনই যদি খেজুর গাছ রক্ষণাবেক্ষণ ও নতুন করে গাছ রোপণ করা না হয় তাহলে অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে খেজুর গাছ। আমরা বাপ-দাদাদের মুখে রসের যে কাহিনী শুনি, তা আমাদের কাছে অবাস্তব মনে হয়। আগামীতে রস না থাকলে পরের প্রজন্মের কাছে এসব গাল-গল্প মনে হবে।’

এব্যাপারে মাদারীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, গেলো ১০ বছর আগে মাদারীপুর জেলায় ৭৫ হেক্টর জমিতে ৮৪ হাজার ৯৮৫ টি খেজুর গাছ ছিল। বর্তমানে সেখানে ৪৫ হেক্টর জমিতে ৪৭ হাজার ৭৩১টি খেজুর গাছ রয়েছে। ফলে কৃষকদের খেজুর গাছ চাষের প্রতি উদ্ধুদ্ধ করতে নানা আহবান করছি।’

তিনি আরো বলেন, খেজুর গাছ না কাটার জন্য আমরা জনগনকে সচেতন করছি। মাঠ পর্যায়ে আমাদের অভিযানও চলে। ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ। কেউ যদি আইন অমান্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া অন্য কারণেও যদি কাটে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযান চালানো হবে।