মাদারীপুরের ৭ যুবককে লিবিয়ায় জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়
প্রকাশ : 2022-08-24 15:18:21১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
পরিবারের চাহিদা মেটাতে উন্নত জীবিকার আশায় মাদারীপুরের অনেক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের পাঠানো হচ্ছে লিবিয়া দিয়ে ইতালিতে।
ইতালির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো রবিন সিকদারের মা নুরজাহান কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলেকে জিম্মি করে ১০ লাখ টাকা দাবি করছে দালাল হারুন । এর আগেও প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়েছি। এখন আমি এতো টাকা কোথায় পাবো? হারুন দালালের মাধ্যমে লিবিয়া দিয়ে ইতালিতে পাঠানোর কথা হয়েছিলো।হারুন দালাল আমার ছেলেকে লিবিয়ায় মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এর কয়েক মাস পরে ঐ দালাল আমাদের কাছে আরো ৯লাখ ৫০হাজার টাকা দাবি করে। না দিলে আমার ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।এবং অত্যাচার করে সেই ভিডিও আমাদের ফোনে পাঠায়। এর পরে আমরা তাকে আমাদের বাড়ি-ঘর,জমি ইত্যাদি বিক্রি করে ৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা দিলে কয়েক দিন ভাগিনার সাথে যোগাযোগ করতে দেয় দালাল চক্র। কয়েকদিন পর যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে ওই চক্র আমার ছেলেকে অসাভাবিক মারধোর করে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করে ইমোতে কল দিয়ে তা আমাদের দেখায়। আমরা এখন নিরুপায়। টাকা না দেওয়ার কারণে ছেলের সাথে যোগাযোগ এখন আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে মাফিয়া দালাল চক্র। এখন আমার ছেলেকে ফেরত আনার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই। আমার ভাগিনাকে ফেরত চাই।’৫ মাস আগে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়ায় পাড়ি জমান মাদারীপুরের সাত যুবক।এর মধ্যে লিবিয়ায় পৌঁছালেও এরপর থেকে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পরিবারের।তাদের স্বজনরা জানান, লিবিয়ায় ওই যুবকদের জিম্মি করে বাড়িতে ভিডিও কল দিয়ে মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে। টাকা না দিলে তাদের নির্যাতনের হুমকি দিয়েছে জিম্মিকারীরা।
ভুক্তভোগী এসব পরিবারের মুক্তিপণের টাকা দেয়ার সাধ্য তাদের কারও নেই। এ অবস্থায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। সন্তানদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আকুতি জানিয়েছেন তারা।
ওই ৭ যুবক হলেন মাদারীপুর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের আবুল হোসেন হাওলাদারের ছেলে রকিব হাওলাদার,আবদুল হাকিম খলিফার ছেলে এলেম খলিফা, শিরখাড়া ইউনিয়নের রব সিকদারের ছেলে রবিন সিকদার ,বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মিঠাপুর গ্রামের ফুকু বেপারীর ছেলে জসিম বেপারী,মিঠাপুর এলাকার আসমত আলীর মোল্লার ছেলে ইব্রাহীম মোল্লাসহ আরো অনেকে।তাদের বয়স ১৯ থেকে ২১ বছরের মধ্যে। লিবিয়ায় বন্দী রবিন সিকদারের মামা ইব্রাহিম মোল্লা বলেন,,হারুন দালালের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া, লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য বডি কন্ট্রাক্ট হয়েছে ৯লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। লিবিয়া পৌছানোর কয়েকদিন পর অর্থাৎ ( ২৬ মে২০২২) রবিন সিকদার শিরিয়া থেকে ফোন কল করে জানায় দালাল হারুন তাকে সহ আরো কয়েকজনকে অন্য মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন যদি আরো ৯ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা এই মুহুর্তে না দেওয়া হয়। তাহলে মাফিয়ারা তাকে মেরে ফেলবে। পরবর্তীতে তার হাত থেকে দালাল ফোন কেরে নিয়ে কথা বলে যেকোন কিছুর বিনিময় হলেও আপনার ভাগিনার নিকট টাকা পাঠাইয়া দেন। টাকা না পাঠালে আর তাকে পাওয়া যাবে না। এইবলে ফোনে নির্যাতনের ভিডিও দেখায় পরে ফোন কেটে দেয় মাফিয়া চক্রের সদস্যরা।তারপরে কোন উপায় না পেয়ে দিশা হারা হয়ে নিজের বসত-বাড়ি, জমিজমা বিক্রি করে দালালকে ৯ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা এক সপ্তাহের মধ্য পাঠিয়ে দেন ভুক্তভোগীর পরিবার।
একাধিক ভুক্তভোগী পরিবার জানান, ইতালি যেতে চন্ডিবর্দি এলাকার হারুন দালালের সঙ্গে কথা হয় তাদের।আলোচনায় ঠিক হয়, তাদের লিবিয়া হয়ে ইতালি নিয়ে যাওয়া হবে। জন প্রতি, ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা লাগবে । চুক্তি অনুযায়ী, হারুনের কাছে সাড়ে ৯ লাখ ৬৫হাজার টাকা করে পরিশোধ করে ওই ৭ যুবকের পরিবার।
এরপর লিবিয়ার উদ্দেশ্যে তারা দেশ ছাড়েন দেড় মাস আগে। এরই মধ্যে তারা লিবিয়ায় গিয়ে পৌঁছায়। সেখান থেকে গত ২৬ মে ইতালি যেতে সাগর পাড়ি দেয়ার কথা বলে নিয়ে তাদের জিম্মি করা হয়।
পরিবারের সদস্যদের দাবি, এরপর প্রত্যেক যুবকের পরিবারের কাছে তাদের সন্তানদের দিয়ে ভিডিও কল করিয়ে ৯ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়।এক মাস না যেতেই আবার ১০লাখ টাকা দাবি করেন।
ইতালির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো এলেম খলিফার বাবা আবদুল হাকিম খলিফা বলেন, ‘আমার ছেলেকে জিম্মি করে ৯ লাখ টাকা দাবি করছে। এখন আমি এতো টাকা কোথায় পাবো? যে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাঠিয়েছি, তাকেও পাওয়া যাচ্ছে না।
‘এখন আমার ছেলেকে ফেরত আনার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই। আমার ছেলেকে ফেরত চাই।’
ইউনুস শেখের বাবা সিরাজ শেখ বলেন, ‘ধার-দেনা করে পোলারে বিদেশ পাঠাইলাম। এখন আর টাকা দেয়ার মতো সাধ্য আমার নেই। দালালের ধর্না দিয়েও কোনো কাজে আসছে না।টাকা না দিতে পারায় আমার ছেলের সাথে আজকে পাঁচ মাস ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় মাফিয়া চক্র।
‘কীভাবে আমারা আমাদের সন্তানকে ফিরে পাব? সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই, আমি আমার পোলা ফেরত চাই।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত হারুন দালালের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মেসেজ দিয়েও তার সাড়া মেলেনি।
তার গ্রামের বাড়িতে যোগাযোগ করলে, কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। অপরদিকে দালাল হারুন দালাল গ্রামের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন।
মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোঃ মনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘ভুক্তভোগী পরিবারগুলো মানবপাচার মামলা করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযুক্তদের খুঁজে বের করা হবে। মাদারীপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাইনউদ্দীন বলেন,দালালদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং দালাল চক্র ধরার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।