মহাতিলোত্তমায় রবীন্দ্র সাহিত্য
প্রকাশ : 2021-05-09 10:31:58১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
‘বহু মানব তাদের বহু দিবসের শ্রম তিলে তিলে দান করে গড়ে তুলেছে এই তিলোত্তমা মূর্তি...।’ আমাকে বিস্মিত করে এমন কিছু দেখলেই রবি ঠাকুরের উক্ত লেখাটি আমার মনে পড়ে। যেমন, মহাস্থানগড়, সোমপুর বিহার, হার্ডিঞ্জ ব্রীজ, যমুনা ব্রীজ ইত্যাদি। কোটি কোটি মানুষের কর্মের ফলে এসব র্কীতি গড়ে উঠেছে। ঠিক তেমনি করে রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পুরুষ, একান্নবর্তী পরিবার , তার লেখা এবং তার লেখার উপর অগণন লেখক ও পাঠকদের পরিশ্রমের ফলে রবীন্দ্রনাথ ও তার সাহিত্যকর্ম বিশ্বসাহিত্য সভ্যতার মহাতিলোত্তমার আসনে অধিষ্ঠিত --তা অনুধাবন করতে পাঠক, লেখক ও তার ভক্তদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না বরং প্রতি পদে পদে, প্রতি মুহুর্তে বিস্মিত হতে হয় রবীন্দ্রনাথের একটা একটা লেখা নিয়ে ভাবলে। মনে হয়, রবীন্দ্র সাহিত্য বহু তিলোত্তমা যোগে গড়া মহাতিলোত্তমার ছায়া রূপে কায়া মূর্তি।
প্রশান্ত কুমার পালের নয় খন্ডের ‘রবি জীবনী’, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র জীবন কথা’, রবীন্দ্র নাথকে ঘিরে অজস্র চিঠি-পত্র, তার অগণন ভক্ত, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, ঠাকুরবাড়ী কেন্দ্রিক লেখক ও স্মৃতিচারণকারীদের হাজার হাজার পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে অর্ধেক জীবন পার হয়ে যাবে। বাকী অর্ধেক জীবন পার হবে রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক পড়ে, রবীন্দ্র সংগীত পড়ে, শুনে এবং তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে ভেবে। আর সাহিত্য পাঠসহ এক জীবনে তাঁর স্মৃতিস্থান ঘুরে দেখতে চাইলে, একশ বছর সুস্থ আয়ুষ্কাল থাকলে হয়তো রবীন্দ্র সভ্যতার স্বাদ কিছুটা নেওয়া যেতে পারে। ‘তাঁর সাহিত্য ও তাকে ঘিরে’--এই এক জীবন পাড় করে দেওয়ার মত লেখা কর্মযজ্ঞকে তিলে তিলে গড়া তিলোত্তমা রূপে বিস্ময়কর ‘রবি সাহিত্য সভ্যতা’ বলা যেতে পারে।
আর এই সাহিত্য সভ্যতার ভ্রণ নিয়ে সামান্য আলোকপাতঃ জোড়াসাঁকো। কলকাতার মেছুয়া বাজার এলাকায় অখ্যাত পাড়া, পাড়া থেকে গ্রাম। ইতিহাসে যে কোন সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে এবং ইতিহাসে ব্যক্তি অথবা পরিবার সম্ভ্রান্ত, ঐশ্বর্যশালী হয়েছে হাট-বাজার-নগরকে কেন্দ্র করে--তা বালিহাটির জমিদার হোক আর ভাগ্যকূলের জমিদারই হোক--সবাইকে পরিশ্রম করে, ব্যবসা করে অঢেল অর্থ রোজগার করে জমিদারী কিনতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ নীলমণি ঠাকুর ১৭৮৪ সালে জোড়া সাঁকোতে বসবাস করতে শুরু করেন। কোথা থেকে তারা এখানে এলেন--তা জানা যায় না, কেউ বলেন, খুলনা বা যশোহর থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষরা এখানে এসেছে। কথিত আছে যে, শুরুতে তাদের ঠাকুর উপাধী ছিল না--ছিল ‘কুশারী’ উপাধী। তবে রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথকে এই উপাধী ধারণ করতে হয়নি--জন্ম থেকেই তারা ঠাকুর উপাধী ধারণ করেছেন।
সে যাই হোক, নীলমণির দুই ছেলে সম্পর্কে জানা যায়--রামলোচন ও রামমনিঃ রামমণির ছোট ছেলে দ্বারকানাথ জন্মের এক বছরের মধ্যে মাকে হারান। রামলোচন একমাত্র কন্যা শিবসুন্দরীর অকাল মৃত্যুর পর দ্বারকানাথকে দত্তকপুত্র হিসাবে গ্রহন করেন। রামলোচনের অঢেল সম্পতি ছিল এবং তিনি তা অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুর কিছুদিন আগে ১৩ বছর বয়সী দত্তক পুত্র দ্বারকানাথকে উইল করে দিয়ে যান, যা দিয়ে যান, তা হল (উইলের ভাষায়)ঃ ‘যশোহর জেলার জমিদারী পরগণা বহরামপুর শহর কলিকাতার মধ্যে ডোম পিদরু সাহেবের দখলাধীন জায়গা রামদেব বাইতির দখলাধীন জায়গা কৃঞ্চচদ্র রায় কবিরাজের দখলাধীন জায়গা তিলক বসাকের দখলাধীন জায়গা শঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের দখলাধীন বাটী রতন বাড়ের দখলাধীন বাটী --‘এই বাটী তোমার মাতাকে দিয়াছি’ নিজ বাটী ধর্ম্মশার বাটী বড়বাজারের বটতলার বাটী জানবাজারের হাড়িগোলার জায়গা ডোমটোলার জায়গা মান্নতের দখলাধীন জায়গা কলিঙ্গা ব্রহ্মচারীর দখলাধীন জায়গা ব্রহ্মতের জমি মৌজে কপিলেশ্বর দখলাধীন জায়গা ব্রহ্মত্তর জমি...।’ রামলোচনের এতসব সম্পত্তির কারনেই তারা ছিলেন বিখ্যাত ঠাকুর জমিদার পরিবার।
অনেক বিজ্ঞ ইতিহাসবিদ বলেন, রাজা রামমোহন রায় এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কারনেই আধুনিক বাংলার গোড়াপত্তন। তবে আশ্চর্য এই যে, দৌহিত্র রবীন্দ্রনাথ পিতামহের বিষযে কোথাও তেমন কিছু লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। এই অঢেল সম্পত্তির জমিদার পরিবার থেকে জন্ম নেওয়া, পরবর্তীতে নোবেল জয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হওয়া--যার লেখা গান দুই দেশের (বাংলাদেশ, ভারত) জাতীয় সংগীত হিসাবে মর্যাদা পাচ্ছে। শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত রচয়িতা আনন্দ সামারাকুন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শিষ্য, বলা হয়ে থাকে, সামারাকুন এর জাতীয় সংগীতের গানে রবীঠাকুর সুরকার ছিলেন।
বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ, কৃষ্ণাত্রয়োদশীর শেষ রাতে ৬ নং দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলির মহর্ষি ভবনে ১৪শ সন্তান বা ৮ম পুত্র হিসাবে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। ৫ বছর বয়সে ভ্রাতা সোমেন্দ্রনাথের সাথে হাতে খড়ি। ৮ বছর বয়সে কবিতা লেখা আরম্ভ। ১২ বছর বয়সে প্রথম অপৌত্তলিকভাবে রবীন্দ্রনাথসহ তিন জনের উপনয়ন এবং গায়ত্রীমন্ত্র সম্পর্কে তার অর্থবোধের চেষ্টা। বাড়ীতে স্কুলের মত পরিবেশে সংস্কৃত ‘কুমার সম্ভব’ ও ইংরেজী ‘ম্যাকবেথ’ নাটক পাঠ এবং তা বাংলায় রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদ করতে হয়।
তিলোত্তমায় উঠার সিঁড়িঃ ১২ বছর বয়সে বালক রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘অভিলাষ’ কবিতা ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৪ বছর বয়সে হিন্দু মেলার বার্ষিক উৎসবে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। এই কবিতা ‘হিন্দুমেলার উপহার নামে দ্বিভাষী ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই সময়ে ‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ মাসিকে ১২৮২ অগ্রহায়ণ হতে ১২৮৩ কার্তিক পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের বনফুল কাব্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৫ বছর বয়সে ভূবনমোহিনী-প্রতিভা, প্রলাপ নামে লিরিক কবিতা এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৬ বছর বয়সে দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পাদিত ‘ভারতী’ মাসিক পত্রিকায় তার লেখা গান, ভানুসিংহের পদাবলী, মেঘনাথবধ কাব্যের সমালোচনা, বড় গল্প ভিখারিণী, প্রথম উপন্যাস (অসম্পূর্ণ) ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। ১৭ বছর বয়সে ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য বিলেত গমন, একই সময় কাব্য ‘কবি কাহিনী’, বিভিন্ন প্রবন্ধ ভারতীতে প্রকাশ হয় এবং নিজ গানে প্রথম নিজে সুরারোপ করেন। ১৮ বছর বয়সে বৌঠাকুরাণী কাদম্বরী দেবীর নিকট প্রেরিত পত্র ‘য়ুরোপযাত্রী কোন বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা’ নামে একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৮-১৯ বছর বয়সে গ্রন্থ আকারে ‘কবি কাহিনী’ এবং বনফুল কাব্য প্রকাশিত হয়। ২০ বছর বয়সে ব্রাহ্ম সমাজের মাঘোৎসবের জন্য ৭ টি ব্রহ্ম সংগীত রচনা করেন এবং এই সময়ে বাল্মীকী প্রতিভা, ভগ্নহৃদয়, চন্ডালিকা, য়ুরোপপ্রবাসীর পত্র গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়। ২১ বছর বয়সে ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’ মাসিক ভারতীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় এবং গ্রন্থ আকারে সন্ধ্যাসংগীত, কালমৃগয়া প্রকাশিত হয়। ২২ বছর বয়সে বউ ঠাকুরাণীর হাট, প্রভাতসংগীত, বিধিধ প্রসংগ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ২৩ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় ছবি ও গান, প্রকৃতির প্রতিশোধ, নলিনী, শৈশব সংগীত, ভানুসিংহের পদাবলী গ্রন্থ। ২৪ বছর বয়সে রামমোহন রায়, আলোচনা, রবিচ্ছায়া গ্রন্থ এবং ২৫ বয়সে কড়ি ও কোমল, বাল্মীকি প্রতিভা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
৩৭ (১৮৯৮ খ্রীঃ) ও ৫২( ১৯১৩ খ্রীঃ) বছর--তাঁর জীবনে এ দুটি বয়স বাদে ১৮ ( ১৮৭৯ খ্রীঃ) থেকে ৮০ (১৯৪১ খ্রীঃ) বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি বছর তাঁর এক বা একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মাত্র ১২- ১৩ বছর বয়সে রচিত তার কবিতা ‘অভিলাষ’ ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটাই তার প্রথম মুদ্রিত কবিতা। ১৮ বছর বয়সে ১৮৭৯ সালে তার প্রথম গ্রন্থ কবি কাহিনী, ১৮৮৩ সালে ‘বৌঠাকুরানীর হাট’ প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত কবি। কবি পরিচিতি ছাড়াও তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, ছড়াকার, নট ও নাট্যকার , চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, সুরকার, কন্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। ১৯১৩ সালে ৫২ বছর বয়সে গীতাঞ্জলী কাব্যের উপর বাংলা সাহিত্যে প্রথম ( এখন পর্যন্ত ২য় কেউ অর্জন করেনি) নোবেল প্রাইজ অর্জন করেন।
মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি কাব্য রচনা শুরু করেন। তার প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। কবিতা ও গান ছাড়াও তিনি ১৩ টি উপন্যাস, ৯৫টি ছোটগল্প, ৩৬ টি প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র রচনা ৩২ খন্ডে এবং তার সব চিঠিপত্র উনিশ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তবে যে যাই বলুক, বাঙ্গালী সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রধানত রবীন্দ্র সঙ্গীত স্রষ্টা হিসাবে। তার রচিত গানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। নৃত্যকলায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত নৃত্যশৈলী ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ নামে পরিচিত। তাঁর আঁকা ছবির সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। তাঁর কিছু বিখ্যাত লেখার নামঃ কাব্যগ্রন্থ-- মানসী(১৮৯০), সোনারতরী(১৮৯৪), গীতাঞ্জলী(১৯১০), বলাকা(১৯১৬) ইত্যাদি; উপন্যাস-- বৌঠাকুরাণীর হাট(১৮৮৩), রাজর্ষি(১৮৮৭), চোখের বালি(১৯০৩), নৌকাডুবি(১৯০৬), ঘরে বাইরে(১৯১৬), মেষের কবিতা(১৯২৯) বৌঠাকুরাণীর হাট(১৮৮৩), রাজর্ষি(১৮৮৭), চোখের বালি(১৯০৩), নৌকাডুবি(১৯০৬), ঘরে বাইরে(১৯১৬), শেষের কবিতা(১৯২৯)ইত্যাদি। তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক ছোট গল্পকার। বিখ্যাত গল্প--কঙ্কাল,নিশীথে, মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ, কাবুলীওয়ালা, হৈমন্তী, দেনা-পাওনা, মুসলমানীর গল্প ইত্যাদি; শেষ জীবনে ‘লিপিকা’, ‘সে ও তিন সঙ্গী’ গল্পগ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্প রচনা শুরু করেছিলেন। নাটক--রক্তকরবী(১৯২৬), তাসের ঘর(১৯৩৩), কালের যাত্রা(১৯৩২), ডাকঘর ( ১৯১২), অচলায়তন( ১৯১২) ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত নাট্যগ্রন্থ।
তিনি বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তাঁর রচনা আজ বিশ্বের নানা ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ঠাকুর পরিবারের সাহিত্য সভ্যতার ভ্রণ থেকে এভাবেই গড়ে উঠেছে আজকের তিলোত্তমা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর সুবিশাল সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে তাঁর মত দু’হাত উজার করে এত রত্নভান্ডার আর কেউ দান করতে পারেনি। বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্বের সেরা সাহিত্য শ্রেনীর উচ্চ আসনে বসিয়েছেন। সারা জীবন সাহিত্যের সব শাখায় নিরলস নিরন্তন কাজ করেছেন।