বাঙালি মুসলমানের প্রাণের কবি এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক নজরুল

প্রকাশ : 2023-06-26 12:20:22১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

বাঙালি মুসলমানের প্রাণের কবি এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক নজরুল

কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি মুসলমানের প্রাণের কবি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে তিনি তার সৃষ্টিকর্ম দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর যাপনকে তিনিই প্রথম তুলে ধরেছেন সাহিত্যের উপাদান হিসেবে। মহররম থেকে শুরু করে ফাতেহা-ই-দোয়াজ-দহম হয়ে ঈদ উৎসব- কোনোটাই তিনি বাদ রাখেননি সাহিত্যে নতুনভাবে পরিচয় ঘটাতে, রূপদান করতে।
ঈদ সম্পর্কিত নজরুলের বিশাল সৃষ্টিসম্ভার তার পূর্বেকার, সমকালীন এবং পরবর্তী বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের থেকে বেশ আলাদা, দীর্ঘ। নজরুল প্রথম কবি যিনি তার গানে ঈদকে আনন্দ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছেন। চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা যে কয়টি গান শুনে আসছে, জনপ্রিয় হয়েছে- তার সবকটির গীত নজরুল রচনা করেন। এমন জনপ্রিয় ইসলামিক গান নজরুলের আগে-পরে তেমন করে রচনা করেনি। এ জন্য নজরুলের গান আজও বাঙালি মুসলমানের ঈদ উদযাপনের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে মিশে আছে। ঈদের আগমন মানেই যেন নজরুলের গান।
ঈদ বিষয়ে নজরুলই সবচেয়ে বেশি বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন তার কবিতা, গান ও গজল দিয়ে। ‘শহীদী ঈদ’, ‘ঈদের চাঁদ’, ‘কৃষকের ঈদ’, ‘বকরীদ’, ‘ঈদ-মোবারক’, ‘জাকাত লইতে এসেছে ডাকাত চাঁদ’, ‘কোরবানি’, ‘আজাদ’ এগুলো তার ঈদের কবিতা। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’, ‘নতুন ঈদের চাঁদ’, ‘চলো ঈদগাহে’, ‘ঈদ ঈদ ঈদ’, ‘নাই হল মা বসন-ভূষণ এই ঈদে আমার’, ‘ছয় লতিফার ঊর্ধ্বে আমার আরাফাত ময়দান’, ‘ঈদুজ্জোহার তকবির শোনো’, ‘ঈদ মোবারক হো’, ‘ঈদের খুশির তুফানে আজ ডাকল কোটাল বান’, ‘ফুরিয়ে এলো রমজানেরই মোবারক মাস’, ‘নতুন চাঁদের তকবির, ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ’, ‘দে জাকাত দে জাকাত, তোরা দেরে জাকাত’, ‘ঈদ মোবারক হোক ঈদ মোবারক হোক’, ‘ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক’- এগুলো নজরুলের ঈদবিষয়ক জনপ্রিয় গান। আর ‘ঈদজ্জোহা’ ও ‘ঈদুল ফেতর’ দুটি নাটিকা।
১৯৩১ সালের কথা। তখনো রমজান মাস শুরু হয়নি। তবে মাসিক মোহাম্মদীর ঈদ সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। একদিন বিকাল ৪টার দিকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আসলেন মোহাম্মদী’র সম্পাদক মওলানা আকরম খাঁর কাছে তার কলকাতার অফিসে। এসেই বললেন, চার আনা পয়সা দেন চাচা দুপুরে খাইনি। পকেটে হাত দিয়ে একটা সিকি বের করে দিয়ে মওলানা আকরম খাঁ বললেন, এই নাও চার আনা, বাইরে থেকে খেয়ে এসো। তারপর একটা কবিতা দিয়ে যাবে মাসিক মোহাম্মদীর ঈদ সংখ্যার জন্য। কিন্তু খেতে গেলেন না নজরুল। কলম হাতে নিয়ে লিখতে বসে গেলেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে কবিতা লেখা শেষ করে মওলানা আকরম খাঁর হাতে খাতাটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন- কবিতাটি পড়েন চাচা, আমি খেয়ে আসি। এটাই সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ/ তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ’। প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, মুসলিম রেনেসাঁর কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতার গান সময়ের আবর্তে পুরো অঞ্চলের মুসলমানদের ঈদের অনিবার্য অনুষঙ্গ পরিণত হলো। রমজান মাস শেষে পশ্চিম আকাশে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে এই গান প্রচারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালি মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। গত ৯১ বছর ধরে এটি অবধারিত রেওয়াজ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। কাজী নজরুল ইসলামের ঈদের কালোত্তীর্ণ এই গানটিতে আনন্দ- উচ্ছাস, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব, ইসলামের মমার্থ, ঈদের তাৎপর্য নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে।

জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
এক বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পাজরের হাড়?
-কৃষকের ঈদ

চধর্মে নজরুল মুসলিম হলেও তিনি নিজেকে সর্বজনগ্রাহ্য মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন আজ অবধি। এ জন্যই তিনি আমাদের হৃদয়ের কবি, আমাদের জাতীয় কবি, রেনেসাঁর কবি। নজরুল শুধু ইসলামী ভাবধারায় কবিতা বা গান লেখেননি বরং একটি তাত্ত্বিক কৌশলগত উদ্দেশ্য থেকে এসব রচনা করেছিলেন। মাতৃভাষায় সৃজনশীল প্রকাশের মাধ্যমে ধর্মকে বা ধর্মের বাণীকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। তেমন একটি উদাহরণ পাই কৃষকের ঈদ কবিতায়-

‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে,
লুকাইয়া আছো লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে।
হের ঈদগাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত কংকাল,
কসাইখানায় যাইতে দেখেছো শীর্ণ গরুর পাল?
রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রæ সলিলে হায়,
বেলাল! তোমার কণ্ঠে বুঝির আজান থামিয়া যায়!
থালা, ঘটি, বাটি বাধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে,
তীর-খাওয়া বুক, ঋণে বাধা শির লুটাতে খোদার রাহে।’
কৃষকের ঈদ’

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে বিশ্বব্যাপী হতাশা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ভারত স্বাধীনতা আন্দোলন এবং নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্তের স্বপ্ন-সম্ভাবনা নজরুলের কবি মানসকে করে তুলেছে বিদ্রোহী, প্রতিবাদী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি একাকী বিদ্রোহ করেছেন সরকার, দেশ, সমাজ, প্রচলিত ধর্ম ব্যবসার বিরুদ্ধে। পরম আশাবাদী নজরুল স্বদেশের মুক্তি প্রত্যাশা করেছেন, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করেছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর কৌশলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে ভারতের দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায়কে পরস্পর বিভেদে লেলিয়ে দেন, যার ফলে ১৯৪৬ সালে সংঘটিত দাঙ্গায় রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানরা।

তৎকালে নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দোহায় দিয়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো, দাঙ্গা সংঘটন এক ধরনের অলিখিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ধর্ম ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এসব থেকে মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি কাব্যে যেমন বিদ্রোহী ছিলেন, বাস্তবেও ছিলেন তেমনি বিদ্রোহী। মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা চেতনা আর নারী-পুরুষ সাম্য রক্ষা তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে।
নজরুল যে কতটা অসাম্প্রদায়িক চিন্তক ছিলেন তা ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি লিখেছেন:
‘নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ প্রশ্ন করার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু, তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ন হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি, আমারই মতো একজন মানুষকে।’
সমস্ত ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে তিনি সর্বদা চেয়েছেন জাতভেদের ঊর্ধ্বে মানবধর্ম প্রতিষ্ঠার কথা। তাই তো তিনি লিখেছেন-
‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া,
/ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া।
/হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি-ভাবি- এতেই জাতির জান,
তাই ত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে এক শ’-খান!
এখন দেখিস্ ভারত জোড়া প’চে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া।’
সব মানুষ যে একই উৎস থেকে সৃষ্ট, এই পরম সত্যটি তিনি এভাবে তুলে ধরেছেন-

‘সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এ বিশ্ব-মায়ের বিশ্ব-ঘর,
/মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্ম পর।
/বলতে পারিস, বিশ্ব-পিতা ভগবানের কোন সে জাত
কোন্ ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
নারায়ণের জাত যদি নাই,/তোদের কেন জাতের বালাই?
(তোরা) ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মা’র মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া।
ভগবানের ফৌজদারী-কোর্ট নাই সেখানে জাত-বিচার,
পৈতে টিকি টুপি টোপর সব সেথা ভাই একাক্কার।
জাত সে শিকেয় তোলা রবে,/কর্ম নিয়ে বিচার হবে।’

কবি নজরুল তার ব্যক্তি জীবনেও লালন করেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। নজরুল তার চারজন সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরানের আলোকে। তার প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মুহাম্মদ। বাকিদের নামকরণ করা হয়- অরিন্দম খালেদ, কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ।
সকল ধর্মের সর্বজনীন মূল্যের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় আস্থা। আর এই আস্থা তাকে হিন্দু কিংবা মুসলমানের কবি না করে, করেছে বাংলা ও বাঙালির কবি। বিশ্বময় ধর্মীয় যে রক্তপাত ঘটছে এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন-
‘হয়তো আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা,
কে জানে কাহার অন- ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়তো উহারই বুকে ভগবান জাগিছেন দিবা-রাতি!’

মানুষকে এবং মানুষের ধর্মকে নজরুল বড় করে দেখেছেন আজীবন। তাই হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়, বিদ্রোহের জন্য মানুষের প্রতিই ছিল তার উদাত্ত আহ্বান। তিনি কল্পনা করেছেন এক সাম্যবাদী সমাজের, যেখানে থাকবে না শোষণ, বৈষম্য আর সাম্প্রদায়িক বিভেদ। তাই তিনি লিখেছেন,
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’
সাম্যবাদী
মানুষের প্রতি নজরুলের ছিল গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বিশ্বাস। এ কারণেই চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কালেও কবি নজরুল রচনা করেন শ্যামা সংগীত আর বৃন্দাবন গীত, অন্যদিকে তিনি লিখেছেন গজল, ইসলামিক গান, কবিতা, প্রবন্ধ। ৪৬ সালে সংঘটিত দাঙ্গার পটভূমিতে তিনি লিখেছেন, ঐতিহাসিক কবিতা ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, উচ্চারণ করেছেন অসামান্য এই চরণগুচ্ছ,

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
কাণ্ডারী হুঁশিয়ার

উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রভুরা, সমাজপতিরা নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রথম থেকেই সহ্য করতে পারেননি। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থান্বেষী চক্র তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে, তার সাহিত্যে খুঁজেছে সংকীর্ণতার, সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ। মুসলিমরা ক্ষেপেছেন নজরুলের কবিতা ও গানে হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখে; আর হিন্দুরা ক্ষেপেছেন, যখন দেখেছেন নজরুলের কবিতায় পশ্চিম এশিয়ার ঐতিহ্য জায়গা পেয়েছে, আর যখন লিখেছেন তিনি ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন, তখন। অথচ, বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি কামনার জন্যই তিনি কবিতায়-গানে একই সঙ্গে আল্লাহ-ঈশ্বর, মসজিদ-মন্দির-গির্জা, মোহাম্মদ-কৃষ্ণ-খালেদ-অর্জুন, কোরান-বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটক প্রভৃতি অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন।
ধর্ম মনের অভ্যন্তরে জন্ম নেয়া একগুচ্ছ বিশ্বাসের সমষ্টি। এই উপমহাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে দুটি ধর্মের অনুসারী, তাদের তিনি একই বৃন্তে ফোটা দুটি ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবি শুধু প্রতীকী অর্থে নয়, বাস্তবতার নিরিখেই বলেছেন,

‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে/যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।’

নজরুল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, প্রত্যেক মানুষ স্বাধীনভাবে তার নিজ ধর্ম পালন করবে, এতে কোনো বাধা-বিপত্তির প্রশ্ন থাকবে না। একজন মানব সন্তানের বড় পরিচয়, সে মানুষ। সেই বিষয়টি সবচেয়ে জোরালোভাবে উচ্চারণ করেছেন তিনি। এই কারণে এই উপমহাদেশে যখন রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মচর্চা বড় হয়ে যাচ্ছিল, গোটা বিশ্বে যখন ধর্মীয় বিভেদের কারণে হানাহানি বেড়ে যাচ্ছিল, তখনই তিনি পদ রচনা করলেন এইভাবে,

গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
মানুষ, সাম্যবাদী

কবি নজরুল সব ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। এক্ষেত্রে নজরুল আবিষ্কার করলেন আরেকটি সূত্র। মানুষই ধর্মকে তৈরি করেছে, ধর্ম মানুষ তৈরি করেনি। নজরুল তাই দৃপ্ত কণ্ঠে ওই একই কবিতায় লিখেছেন,
‘-মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’

নজরুল বাল্যকাল থেকেই চারিত্রিক সারল্যতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করতেন। এটি অতি সহজ সরলিকরণে আবদ্ধ করলে নজরুলকে আবিষ্কার ও পাঠ সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। এটা বোঝা, ভাবা প্রয়োজন যে, নজরুল কেবল বাংলাভাষী নয়, গোটা ভারতবর্ষের মানুষকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য, উদ্দীপিত করার জন্য সাহিত্য চর্চায় প্রয়াস নেন। একই সাথে বিদেশি শব্দ ও অলংকারকে সহজ, সুন্দর অনুবাদে ব্যবহার করে বাংলাভাষার শব্দ সম্ভারকে ঋদ্ব করেছেন। অন্যদিকে ধর্মীয় পুস্তিকাদি বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে এবং গল্প ও আখ্যানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য সাহিত্যরস সৃষ্টি করে অসাম্প্রদায়িকতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পরধর্মসহিষ্ণুতা অনুশীলনের ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন।
মুসলিম ঈদবিষয়ক কবিতা, গীত তথা ইসলামিক সাহিত্য রচনায়, কাব্যে-গানে অসাম্প্রদায়িকতার সৃজনে নজরুল ইসলাম কতটা এই মুহূর্তে বা তৎকালে প্রাসঙ্গিক তা নয়, বরং সবসময় নজরুলচর্চাকে করা আবশ্যিক বিষয় হিসেবে গণ্য করা যায়।