বাগেরহাট কেবি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ওমান-চীনের হিমায়িত মাছ
প্রকাশ : 2021-07-02 19:45:22১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র কেবি বাজারে (সামুদ্রিক মাছের পাইকারি হাট) বিক্রি হচ্ছে ওমান, জাপান ও চীনের হিমায়িত মাছ। প্রতিদিন ভোর থেকে বাগেরহাট, পিরোজপুরসহ আশপাশের জেলার পাইকাররা আসেন।
রাতে এসে অপেক্ষমাণ থাকা ফ্রিজিং গাড়ি থেকে প্যাকেটজাত মাছ নামানো হয় বিক্রির জন্য। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁক-ডাক আর দরকষাকষিতে বিক্রি হয় মাছ। দেশি সমুদ্রসীমায় মাছধরা বন্ধ থাকায় এ মাছের ওপর নির্ভর করছেন পাইকাররা। এসব হিমায়িত মাছই স্থানীয় বাজারে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে দেশি সামুদ্রিক মাছ হিসেবে, দামও চড়া। হিমায়িত এসব মাছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। তবে মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, আমদানিকৃত মাছে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানানো হবে।
বুধবার (৩০ জুন) ভোরে বাগেরহাট দড়াটানা নদীর তীরে অবস্থিত সামুদ্রিক মাছের অবতরণ কেন্দ্র কেবি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতা-বিক্রেতাদেরে হাঁক-ডাক। তবে ঘাটে কোনো ট্রলার নেই। ঘাটে ট্রলার না থাকলে আড়তে মাছও থাকার কথা না। কিন্তু বাজারে প্রচুর প্যাকেটজাত মাছ রয়েছে। যেগুলো রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে করে আনা হয়েছে। পাইকাররা প্যাকেট খুলে মাছ দেখছেন, পরে দরদাম করে কিনে নিয়ে পরিবহনযোগে ফিরছেন নিজেদের গন্তব্যে।
এসব প্যাকেটে ভাঙ্গান, চিতল, আড়াই, রূপচাঁদা, চন্দনা, ঢেলা, ফাইস্যা, ডুংকুর, টেংরা, সাদা চেলা, মোচন টেংরা, কাউয়া, কলম্বো, আর্জিনা, বেলে, চইটকা, বোতল, বৌ মাছ, পাতা কাউয়া, মাইকেল, কোয়েল, সুতাসহ বেশ কয়েক প্রজাতির সামৃদ্রিক মাছ রয়েছে। তবে কলম্বো, ভাঙ্গন, রূপচাঁদা, ঢেলা, কাউয়া, ঢেলা চেলা, ফাইস্যা মাছের পরিমাণ বেশি। রয়েছে ইলিশ সদৃশ্য এক প্রকার মাছ। যেগুলো খুচরো বাজারে চট্টগ্রামের ইলিশ বলে কম দামে বিক্রি করা হয়। ১০ ও ২০ কেজি ওজনের দুই ধরনের প্যাকেটে বিক্রি হয় হিমায়িত এ মাছ। চাহিদা অনুযায়ী মাছের সরবরাহ হয় এখানে। বছরে অধিকাংশ সময়ে এ মাছ বিক্রি হলেও সাগরে মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকার সময়ে চাহিদা বেড়ে যায় বিদেশি এসব মাছের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাগেরহাটের কচুয়া থেকে আসা এক মাছ বিক্রেতা বলেন, আমরা সারা বছরই এখান থেকে কিনে বিভিন্ন বাজারে মাছ বিক্রি করি। কিন্তু যখন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকে, তখনও বাজারে ক্রেতাদের মাছের চাহিদা থাকে। তাই বাধ্য হয়ে বিদেশি মাছ নিয়ে বিক্রি করি। কিন্তু ক্রেতাদের যদি বলা হয়, এটা বিদেশি কোল্ডস্টোরের (হিমায়িত) মাছ, তাহলে তারা এ মাছ কিনবে না। আবার কম দাম বললেও সন্দেহ করে, মনে করে, এ মাছে মনে হয় সমস্যা রয়েছে। তাই আমরা দেশি সাগর ও নদীর মাছ বলে বিক্রি করি খুচরো ক্রেতাদের কাছে।
চিতলমারী থেকে মাছ কিনতে আসা বেপারী বিষ্ণুপাত্র বলেন, প্যাকেটজাত মাছের দাম অনেক কম। যেমন ফইস্যা মাছের কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা। কলম্বো মাছের কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এক কেজি ফাইস্যা মাছ ২৫০ টাকার নিচে কেনার কোনো সুযোগ নেই। ট্রলারে নিয়ে আসা সাগরের কলম্বো কিনতে হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকা করে। তাই আমরা প্যাকেটজাত মাছ কিনি। ভ্যানে করে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে কম দামে বিক্রি করি। এতে বিক্রি যেমন বেশি হয়, লাভও বেশি হয়।
মাছ ব্যবসায়ী সিরাজ, হারুণ, হাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন বলেন, বাজারে সব সময়ই সাগরের মাছের চাহিদা থাকে। খুচরো বিক্রি করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ক্রেতা আমরা পাই। তাই আমরা স্বাভাবিক সময়ে স্থানীয় ট্রলারের মাছের পাশাপাশি প্যাকেটজাত হিমায়িত মাছও কিনি। যে ক্রেতা কম পয়সায় মাছ কিনতে চায়, তার কাছে প্যাকেটজাত মাছ বিক্রি করি। তবে এ মাছের স্বাদ অনেক কম বলে স্বীকার করেন ব্যবসায়ীরা।
ওমান, জাপান ও চীনের মাছ বাগেরহাটে কীভাবে আসে এমন প্রশ্নের উত্তরে বাগেরহাট উপকূলীয় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি শেখ ইদ্রিস আলী বলেন, বাংলাদেশি কিছু ব্যবসায়ী ওমান, জাপান ও চায়না থেকে মাছ আমদানি করেন। তাদের আমদানিকৃত মাছ জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। আমদানিকারকরা পরিবহনে করে সেসব মাছ খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠায়। এর পরের ধাপের ব্যবসায়ীরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে কেনা মাছ ফ্রিজিং (শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত) গাড়িতে করে বাগেরহাট আড়তে নিয়ে আসে। সাগরে মাছ কম ধরা পড়ায় এবং বেশিরভাগ সময় মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে এ মাছের চাহিদা বেড়েই চলছে।
বাগেরহাট কেবি বাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আড়ৎদার সমিতির সভাপতি আবেদ আলী বলেন, আমাদের আড়তে প্রায় সাত-আট বছর ধরে কমবেশি হিমায়িত মাছ বিক্রি হয়। তবে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে এ মাছের চাহিদা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। করোনাকালেও প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ মেট্রিক টন মাছ বিক্রি হয়। যা স্বাভাবিক সময়ে প্রায় ৫০ টনের ওপরে।
এদিকে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), বাগেরহাটের সভাপতি বাবুল সরদার বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য বিক্রি করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। আমদানিকৃত এ মাছগুলো দীর্ঘদিন যেহেতু ফ্রিজিং করা থাকে। তাই এর গুণাগুণ পরীক্ষাসহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টিও দেখা প্রয়োজন। এ বিষয়ে ক্রেতাদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বাগেরহাট সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদাউস আনছারি বলেন, দেশের বাইরে থেকে আসা আমদানিকৃত মাছে কোনো অপদ্রব্য বা ক্ষতিকর কিছু রয়েছে কিনা, সেটা বন্দরের কোয়ারেন্টিন অফিসে পরীক্ষা করে দেশের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। আর এ মাছগুলো যেহেতু দেশের বাইরে থেকে আসে, যার ফলে তাদের আবহওয়া, জলবায়ু ও পানির গুণাগুণের কারণে স্বাদ আমাদের দেশের মাছের মত নয়। তাই ক্রেতাদের কেনার ক্ষেত্রে বুঝে শুনে কেনা উচিত। এছাড়াও এ মাছে কোনো প্রকার স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে কি না, সে বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানানো হবে বলে জানান তিনি।
১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাগেরহাট সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ১৮ জন আড়ৎদার রয়েছেন। স্বাভাবিক সময়ে ফজরের আজান থেকে কয়েক ঘণ্টায় প্রতিদিন কোটি টাকার ওপরে সাগরের মাছ বেচা-কেনা হয় এ বাজারে।