বাংলার প্রথম এডিটোরিয়াল কার্টুনিস্ট প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী
প্রকাশ : 2022-11-08 13:29:58১ | অনলাইন সংস্করণ
নিউজ ডেস্ক
প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী (৮ নভেম্বর ১৯০০―২৭ অক্টোবর ১৯৭৫) 'কাফি খাঁ' বা পিসিয়েল নামে সমধিক পরিচিত বাঙালি ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী। বাংলা কার্টুনে পথিকৃত গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন তিনি। বাংলার প্রথম এডিটোরিয়াল কার্টুনিস্ট তিনিই।
প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ীর জন্ম বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা শহরে তার মাতুলালয়ে। পিতার নাম ফনীন্দ্রনাথ লাহিড়ী। ছোটবেলায় তিনি পড়াশোনায় ভালই ছিলেন। ইতিহাসের ছাত্র হয়ে প্রথম শ্রেণীতে এম.এ পাশ করেন। হাতের লেখা, ড্রয়িং আর মানচিত্র আঁকায় ক্লাসে বরাবর পুরস্কার লাভ করেন। ঢাকা কলেজে ইতিহাস পরীক্ষায় তার আঁকা ম্যাপ দেখে বিদেশি অধ্যাপক র্যামসবোথাম লিখেছিলেন -
This is the finest map I have ever seen drawn by a student.”
এমনকি তার আঁকা ম্যাপটি অধ্যাপকের এমন পছন্দের হয়েছিল যে, তিনি সেটি দেশে নিয়ে গিয়ে নিজের হলঘরের ম্যান্টলপিসের ওপর রেখে দিয়েছিলেন।
ইতিহাসে এম.এ পাশের পর ফেনি কলেজে ইতিহাস ও সিভিক্স বিষয়ে অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এর সাথে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে জড়িত থাকতেন। নিজে ভালো বেহালা বাজাতেন। ভারতীয় শিল্প ও মুসলমানি ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতের চর্চা করতেন। এর পাশাপাশি আঁকার কাজও চলছিল। অধ্যাপনা করার সময়েই তার প্রথম কার্টুন বেরোতে শুরু করেছিল শনিবারের চিঠি পত্রিকায় প্র-চ-লা ছদ্মনামে। তার প্রতিভা ইতিমধ্যে নজরে এসেছিল সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের। তার আহ্বানে এবং কলেজের সহকর্মী গোপাল হালদারের পরামর্শে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি কলকাতায় চলে আসেন প্রফুল্লচন্দ্র। দেশপ্রাণ যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের 'এডভান্স' কাগজে তৎকালীন শ্যামা হক মন্ত্রী সভার উপর তার ব্যঙ্গচিত্র বেরিয়েছিল ওই বছরের ১১ নভেম্বর, Diogenes ছদ্মনামে এবং এরপর নিয়মিত এই পত্রিকায় এঁকেছেন। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে অমৃতবাজার পত্রিকায় যোগ দিয়ে তার ইংরেজি নামের আদ্যাক্ষর 'Piciel' (PCL- পিসিয়েল) ছদ্মনামে অদ্ভুত চরিত্রের 'খুড়ো' - র স্ট্রিপ কার্টুন আঁকেন।[৩] ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় তিন দশক ধরে অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রতি মঙ্গলবার উঁকি দিত তার মানসপুত্র, গোঁফওয়ালা প্রৌঢ়ের - 'খুড়ো' - জীবনের দৈনন্দিন মজাদার অসঙ্গতি নিয়ে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে যুগান্তর পত্রিকা চালু হলে তিনি তাতে সম্রাট আকবরের বিখ্যাত পার্ষদের নাম - 'কাফি খাঁ' ছদ্মনামে 'শেয়াল পণ্ডিত' এর স্ট্রিপ কার্টুন ও রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতে থাকেন। 'খুড়ো' আর 'শেয়াল পণ্ডিত' এর মতো অবিস্মরণীয় দুটি কমিক-স্ট্রিপ চরিত্র তাঁকে খ্যাতি প্রদান করে। পরে প্রতি রবিবারে রামায়ণ ও মহাভারতের কথা, পুরোনো দিনের নানা কথা এবং শিক্ষাপ্রদ নানা বিষয় নিয়ে রেখাচিত্র এঁকেছেন। মহাকাব্য দুটির ঘটনা ও চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটিয়ে মজাদার ও কিম্ভুত পরিবেশ সৃষ্টিতে তার জুড়ি ছিল না। তার উল্লেখযোগ্য চিত্রকাহিনিগুলি হল -
'মাস্টারবাবু'
'ট্রলিবাবু'
'রিকশাওয়ালা',
'মহাভারতের কথা',
'সবজান্তা রাজা',
'ভীমের গল্প',
'কুম্ভকর্ণের কাণ্ড',
'মহাভারতের বনপর্ব',
'দুই বোকার গল্প' ইত্যাদি।
এই সময়ে তিনি নিয়মিত কাজ করেছেন বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমগুলোর জন্যও । সিগারেট, মাথার তেল, গুঁড়ো মশলা, কত অজস্র পণ্যসামগ্রীর জন্য যে তিনি কার্টুন এঁকেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তিনিই দেশে প্রথম বিজ্ঞাপনে কার্টুনের ব্যবহার শুরু করেন। 'সিজার্স' সিগারেটের বিজ্ঞাপনে নানা কার্টুন-সহ 'আপনি কি হারাইতেছেন আপনি তাহা জানেন না' ক্যাপশনটি বাংলায় সেসময় এক প্রবাদ-বাক্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামে কলকাতার স্কাইলাইন তারই আঁকা।
State Department Exchange Program-এ এডিটোরিয়াল কার্টুনিস্ট প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তার গন্তব্য তালিকায় ছিল হাভার্ড, বোস্টন, ইয়েল ও হনলুলু বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে বিভিন্ন আলোচনা ও মতবিনিময়ের কর্মসূচিতে অংশগ্ৰহণ করেন। পরিচয় হয় বিভিন্ন কার্টুনিস্টের সঙ্গে। তিনি ডিজনিল্যান্ডে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আমেরিকা থেকে ঘুরে আসার পর সেখানকার অনেক পত্র পত্রিকাতেও কার্টুন পাঠাতেন। শিশু সাহিত্য সংসদ হতে প্রকাশিত হয়েছিল তার চলন্ত ছবি - 'কাফিস্কোপ'।
ছোটদের জন্য তিনি বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। তার আঁকায় ও লেখায় সমৃদ্ধ ‘ছবি কথা’ বইটিতে পাতায় পাতায় ছবি এঁকে বুঝিয়েছিলেন কী ভাবে রেলইঞ্জিন কাজ করে, মোটরগাড়ি চলে বা এরোপ্লেন ওড়ে। দেশের মনীষীদের জীবন নিয়ে লিখেছেন,
সুভাষ-আলেখ্য
দধীচির অস্থি
সত্যের সন্ধানে
In Search of Truth
জীবনাবসান
প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে অক্টোবর ৭৫ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন।