বাংলাদেশে করোনায় মারা গেছেন ৩৪ সাংবাদিক, ব্রাজিল শীর্ষে ১৭৩

প্রকাশ : 2021-04-15 21:30:13১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

বাংলাদেশে করোনায় মারা গেছেন ৩৪ সাংবাদিক, ব্রাজিল শীর্ষে ১৭৩

দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৩৪ জন সাংবাদিক। আর করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ১৪ জন। করোনাক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে আছেন খ্যাতিমান সাংবাদিক কামাল লোহানী, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান ও দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান।

সাংবাদিকদের ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ ‘আমাদের গণমাধ্যম, আমাদের অধিকার’ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খোঁজ নিয়ে একই তথ্য পাওয়া গেছে। করোনায় মৃতদের মধ্যে আছেন খন্দকার মোজাম্মেল হোসেন (গেদু চাচা), যুগান্তরের মালিক নূরুল ইসলাম বাবুল, এনটিভির অনুষ্ঠান প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ। গত দুই সপ্তাহে দেশে মারা গেছেন চার সাংবাদিক। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি থাকা আরও বেশ কয়েকজন করোনাক্রান্ত সাংবাদিককে নিয়ে শঙ্কায় আছেন সহকর্মীরা।

রিপোর্টারদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মসিউর খান বলেন, সংগঠনের অন্তত ৫০ সদস্য এ মুহূর্তে করোনায় আক্রান্ত। সবার জন্য হাসপাতাল পাওয়া যায়নি। বেশি জটিল ২০ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কাউকে কাউকে বাসায় অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়েছে।

সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে ২০০৪ সাল থেকে কাজ করছে জেনেভাভিত্তিক সংগঠন প্রেস এমব্লেম ক্যাম্পেইন (পিইসি)। সংস্থাটি বলছে, ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের ৭৪টি দেশে ১ হাজার ৬৩ জন সাংবাদিক মারা গেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭৩ জন মারা গেছেন ব্রাজিলে। আর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৪৮ জন। করোনায় সাংবাদিক মৃত্যুর দিক থেকে ষষ্ঠ অবস্থানে বাংলাদেশ। অথচ ওয়ার্ল্ডোমিটার বলছে, করোনায় মোট মৃত্যুর দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৮তম।

করোনায় সাংবাদিক ‍মৃত্যুর শীর্ষ ১০ দেশ
ব্রাজিল ১৭৩
পেরু ১৩৮
মেক্সিকো ৯৩
ভারত ৬৩
ইতালি ৫১
বাংলাদেশ ৪৮
যুক্তরাষ্ট্র ৪৭
ইকুয়েডর ৪৫
কলম্বিয়া ৪০
যুক্তরাজ্য ২৮
মার্চ ২০২০-১৩ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত
তথ্যসূত্র: প্রেস এমব্লেম ক্যাম্পেইন

পিইসি বলছে, কিছু দেশে নির্ভরযোগ্য তথ্যেরও অভাব আছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে এই প্রথম দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এত বেশি সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। সাংবাদিকদের দ্রুত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনা উচিত।

জেনেভার এই বেসরকারি সংস্থাটির স্থানীয় সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করে ‘আমাদের গণমাধ্যম, আমাদের অধিকার’। দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই সাংবাদিকদের করোনায় আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর হিসাব রাখছে তারা। এ গ্রুপের তথ্য বলছে, সারা বিশ্বেই করোনা ও করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু একসঙ্গে যুক্ত করে হিসাব করছে পিইসি। দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে গত বছরের ২৮ এপ্রিল প্রথম মারা যান দৈনিক সময়ের আলোর নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবির খোকন। আর সর্বশেষ ১০ এপ্রিল মারা যান জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার। শাহরিয়ারের করোনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলেও একাধিক উপসর্গ ছিল বলে জানিয়েছেন সহকর্মীরা। চিকিৎসকেরাও করোনা ধরে নিয়েই তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন। এর এক দিন আগে ৯ এপ্রিল মারা যান দৈনিক লাখো কণ্ঠের গাজীপুর প্রতিনিধি রোমান শাহ আলম। আর ২ এপ্রিল করোনায় মারা যান ফরিদপুরের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জগদীশ চন্দ ঘোষ।

রোমান শাহ আলমের স্ত্রী রাজিয়া খাতুন বলেন, পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস করোনায় হারিয়ে গেছেন। দুটি মেয়ে নিয়ে তিনি এখন আয়হীন সংসারে হিমশিম খাচ্ছেন। কোনো সংগঠন থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাননি। রাজিয়া জানান, ২৫ মার্চ জ্বর এলেও করোনা শনাক্ত হয় ১ এপ্রিল। ওই দিনই হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালেও যথাযথ অক্সিজেন না পাওয়ায় রোগীর উন্নতি হয়নি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রোমান।

জানা গেছে, করোনা ও করোনার উপসর্গ নিয়ে এক মাসে সর্বোচ্চ ৯ জন সাংবাদিক মারা যান গত বছরের জুনে। এ বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সাংবাদিক আক্রান্তের ঘটনা অনেকটা কমে আসে। ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ মার্চ কেউ আক্রান্ত হননি। এরপর গত ২৮ মার্চ থেকে প্রতিদিন আক্রান্ত হতে থাকেন সাংবাদিকেরা। গত এক মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১২২ জন।

দেশে গত বুধবার পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২১২টি গণমাধ্যমের ১ হাজার ২৭৩ জন কর্মী। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ১২৩ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার সাংবাদিক আছেন ৯৪৫ জন ও ঢাকার বাইরের ৩২৮ জন। আক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২৮টি সংবাদপত্র, ৩২টি টেলিভিশন চ্যানেল, ৪৫টি অনলাইন পোর্টাল, ৫টি রেডিও এবং ২টি সংবাদ সংস্থা রয়েছে। এর বাইরে আরও আক্রান্ত সংবাদকর্মী থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া আক্রান্তদের অধিকাংশের পরিবারের সদস্যরাও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তাঁদের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।

তবে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে করোনা প্রতিরোধে কাজ করলেও অন্যদের মতো কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না গণমাধ্যমকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, সম্মুখসারির অনেকে প্রণোদনা পেলেও গণমাধ্যম পায়নি। গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকে নিয়মিত বেতন পাচ্ছে না, চাকরি হারাচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের মতো গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য অন্তত চিকিৎসায় অগ্রাধিকার সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি সাংবাদিকদের।

এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, কোনো সাংবাদিক মারা গেলে কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে তাঁর পরিবারকে সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। আর সংবাদকর্মীর বাইরে গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট অন্য কর্মীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় সুবিধা দিতে পারে সরকার। ব্যক্তিগত সচেতনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা ও সরকারের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে।