বহুমুখী প্রতিভার দৃষ্টান্ত ওমর খৈয়াম

প্রকাশ : 2023-05-18 12:46:19১ |  অনলাইন সংস্করণ

  নিউজ ডেস্ক   

বহুমুখী প্রতিভার দৃষ্টান্ত ওমর খৈয়াম

সৃষ্টির রহস্য জানো না তুমি, জানি না আমি

এ এমন এক জটিল বাক্য যা পড়তে পারো না তুমি, না আমি
পর্দার আড়ালে তোমায় ও আমার মাঝে চলছে এ আলাপ
পর্দা যেদিন উঠে যাবে সেদিন থাকবে না তুমি ও আমি।
(ওমর খৈয়াম)

 

ওমর খৈয়াম (গিয়াসউদিন আবুল‌ ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-খৈয়াম নিশাপুরি) একজন ইরানের কবি, গণিতবেত্তা, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ। ইরানের নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করার পর যুবা বয়সে তিনি সমরখন্দে চলে যান এবং সেখানে শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এর পর বুখারায় নিজেকে মধ্যযুগের একজন প্রধান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার বীজগণিতের গুরুত্বপূর্ণ “Treatise on Demonstration of Problems of Algebra“ গ্রন্থে তিনি ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধানের একটি পদ্ধতি বর্ণনা করেন। এই পদ্ধতিতে একটি পরাবৃত্তকে বৃত্তের ছেদক বানিয়ে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করা হয়। ইসলামি বর্ষপঞ্জি সংস্কারেও তার অবদান রয়েছে।

তিনি তার কবিতা সমগ্র, যা ওমর খৈয়ামের রূবাইয়াত নামে পরিচিত, তার জন্য বিখ্যাত। কাব্য-প্রতিভার আড়ালে তাঁর গাণিতিক ও দার্শনিক ভূমিকা অনেকখানি ঢাকা পড়েছে। ধারণা করা হয় রনে দেকার্তের আগে তিনি বিশ্লেষণী জ্যামিতি আবিষ্কার করেন। তিনি স্বাধীনভাবে গণিতের দ্বিপদী উপপাদ্য আবিষ্কার করেন। বীজগণিতে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান তিনিই প্রথম করেন। বহুমুখী প্রতিভার দৃষ্টান্ত দিতে বলা হলে বিশ্বসাহিত্য কিংবা ইতিহাসে যাদের নাম উপেক্ষা করা কঠিন ওমর খৈয়াম তাদের মধ্যে অন্যতম ও শীর্ষস্থানীয়।

দর্শন ও শিক্ষকতায় ওমরের কাজ তার কবিতা ও বৈজ্ঞানিক কাজের আড়ালে অনেকখানি চাপা পড়েছে বলে মনে করা হয়। মধ্যযুগের মুসলিম মনীষা জামাকসারি ওমর খৈয়ামকে “বিশ্ব দার্শনিক” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেক সূত্রে জানা গেছে তিনি নিশাপুরে তিন দশক ধরে শিক্ষকতা করেছেন। ইরান ও পারস্যের বাইরে ওমরের একটি বড় পরিচয় কবি হিসাবে। এর কারণ তার কবিতা বা রুবাই এর অনুবাদ এবং তার প্রচারের কারণে। ইংরেজি ভাষী দেশগুলোতে এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যায়। ইংরেজ মনীষী টমাস হাইড প্রথম অ-পারস্য ব্যক্তিত্ব যিনি প্রথম ওমরের কাজ সম্পর্কে গবেষণা করেন। তবে, বহির্বিশ্বে খৈয়ামকে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় করেন এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড। তিনি খৈয়ামের ছোট ছোট কবিতা বা রুবাই অনুবাদ করে তা রুবাইয়্যাতে ওমর খৈয়াম নামে প্রকাশ করেন। সুলাইমান নদভী খৈয়াম রচনা করে তার ব্যাপারে বিভিন্ন অভিযোগ জবাব দিয়েছেন।

জীবদ্দশায় ওমরের খ্যাতি ছিল গণিতবিদ হিসাবে। ইসলামী সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সোনালী যুগে তথা এখন থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে বীজগণিতের যেসব উপপাদ্য এবং জ্যোতির্বিদ্যার তত্ত্ব ওমর খৈয়াম দিয়ে গেছেন সেগুলো এখনও গণিতবিদ এবং মহাকাশ গবেষক বা জ্যোতির্বিদদের গবেষণায় যথাযথ সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি পরাবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন। এছাড়া তিনি দ্বি-পদী রাশিমালার বিস্তার করেন। ওমরের আর একটি বড় অবদান হলো ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা যা পরবর্তী সময়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করে।

১০৭০ খ্রিস্টাব্দে তার পুস্তক মাকালাত ফি আল জাবর্ আল মুকাবিলা প্রকাশিত হয়। এই পুস্তকে তিনি ঘাত হিসাবে সমীকরণের শ্রেণীকরণ করেন এবং দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধানের নিয়মাবলি লিপিবদ্ধ করেন। এই পুস্তকে তিনি কোনিক সেকশনের বিভিন্ন ছেদকের সাহায্যে নানারকম ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধান করেন। অর্থাৎ জ্যামিতিক পদ্ধতিতে বাস্তব মূর আছে এমন ত্রিঘাত সমীকরণ প্রথম সমাধান করেন। তিনি বর্তমানে প্যাসকেলের ত্রিভুজ নামে পরিচিত দ্বিপদী সহগের ত্রিভুজাকার এরেও লিখেছিলেন।

ওমর খৈয়াম জ্যোতির্বিদ হিসাবেও সমধিক পরিচিত ছিলেন। সেলজুকের বাদশাহ মালিক শাহ ১০৭৩ সালে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে ওমরকেও আমন্ত্রণ জানান একটি মানমিন্দর নির্মাণের জন্য। ওমর তখন অত্যন্ত সফলভাবে (দশমিকের পর ছয় ঘর পর্যন্ত) সৌর বছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন। তার হিসাবে এটি ছিল ৩৬৫.২৪২১৯৮৫৮১৫৬ দিন। এই ক্যালেন্ডারের হিসাবে প্রতি ৫,৫০০ বছরে এক ঘণ্টার গড়মিল হয়ে থাকে। আমরা যে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করি তাতে প্রতি ৩,৩০০বছরে একদিন গোলমাল হয়ে থাকে। কীভাবে পারস্য পঞ্জিকা সংশোধন করতে হবে তাও তিনি হিসাব করেন। ১০৭৯ সালের ১৫ মার্চ সুলতান জালাল আল-‌দিন মালিক শাহ সালজুক ওমরের সংশোধিত বর্ষপঞ্জী চালু করেন। ওমর একটি তারাচিত্র বা খ‌ন্ড চিত্রও তৈরি করেন তবে সেটি এখন আর পাওয়া যায় না।

মার্কিন কবি জেমস রাসেল লোয়েল ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতাগুলোকে "চিন্তা-উদ্দীপক পারস্য উপসাগরের মনিমুক্তা "বলে অভিহিত করেছেন। ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চারপংক্তির কবিতাগুলো প্রথমবারের মত ইংরেজিতে অনূদিত হয় খৃষ্টীয় ১৮৫৯ সালে। এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের এই অনূবাদের সুবাদেই ওমর খৈয়াম বিশ্বব্যাপী কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। এ অনুবাদের মাধ্যমে ফিটজেরাল্ড নিজেও খ্যাতিমান হয়েছেন। তার এই অনুবাদ গ্রন্থ দশ বার মুদ্রিত হয়েছে এবং ওমর খৈয়াম সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার প্রবন্ধ ও বই লিখিত হয়েছে।

ফার্সি কাব্য-জগতে ওমর খৈয়াম এক বিশেষ চিন্তাধারা ও বিশ্বদৃষ্টির পথিকৃৎ। তিনি এমন সব চিন্তাবিদ ও নীরব কবিদের মনের কথা বলেছেন যারা সেসব বিষয়ে কথা বলতে চেয়েও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তা চেপে গেছেন। কেউ কেউ ওমর খৈয়ামের কবিতার নামে বা তার কবিতার অনুবাদের নামে নিজেদের কথাই প্রচার করেছেন। আবার কেউ কেউ ওমর খৈয়ামের কবিতার মধ্যে নিজের অনুসন্ধিৎসু মনের জন্য সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন।

অসাধারণ জ্ঞানী ওমর খৈয়াম জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের অনেক কঠিন রহস্য বা প্রশ্নের সমাধান দিয়ে গেলেও অনেক অজানা বা রহস্যময় বিষয়গুলোর সমাধান জানতে না পারায় আক্ষেপ করে গেছেন। তাই তিনি জীবন এবং জগতের ও পারলৌকিক জীবনের রহস্য বা দর্শন সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এসব প্রশ্ন শুধু তার মনেই নয়, যুগে যুগে জ্ঞান-তৃষ্ণার্ত বা অনুসন্ধানী মানুষের মনের প্রশান্ত সাগরেও তুলেছে অশান্ত ঝড়। দার্শনিকরা এ ধরনের প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন। দর্শনের যুক্তি দিয়ে অনেক কিছু বোঝানো সম্ভব হলেও তারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। দর্শন বা বিজ্ঞান দিয়ে যে ভাব তুলে ধরা যায় না খৈয়াম তা কবিতার অবয়বে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর তাই যুক্তি ও আবেগের করুণ রসের প্রভাবে ওমর খৈয়ামের চার-লাইন বিশিষ্ট কবিতাগুলো কবিতা জগতে হয়ে উঠেছে অনন্য। 

ইরানি কবি ওমর খৈয়াম এর কবিতার একটি লাইন

নিশাপুরে ওমরের সমাধি দেখতে অনেকটা তাঁবুর মতো। তার কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা সেখানে উৎকীর্ণ করা আছে। তার ৯৭১ তম জন্মদিনে গুগল ডুডল তৈরি করে সম্মাননা প্রদান করে।